জাল পরা বাসন্তি আর পানিতে নামাজ পড়া একই সূত্রে গাঁথা
১৯৭৪ সালে পাক-মার্কিন পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে কুড়িগ্রামের চিলমারির প্রত্যন্ত অঞ্চলের জেলেপাড়ার এক হতদরিদ্র পরিবারের বাক্ ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বাসন্তীকে নিয়ে একটি ট্র্যাজেডি নাটকের মঞ্চায়ন করা হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে তা আপনারা অবহিত আছেন।
কুড়িগ্রাম জেলার প্রত্যন্ত এলাকা চিলমারীর জেলে পাড়ার বাক প্রতিবন্ধী বাসন্তী ও তার কাকাতো বোন দুর্গতির জাল পরিহিত লজ্জা নিবারণের একটি ছবি ১৯৭৪ সালে ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। অভাবের তাড়নায় সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারছিল না বলে ছবিটিতে দেখানো হয়।
সেই বহুল আলোচিত ছবির ফটোগ্রাফার ছিলেন ইত্তেফাকেরই নিজস্ব আলোক চিত্রি, রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া থানার মহিপুরের আফতাব আহমদ। পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে ছবিটি ছিল সম্পূর্ণ সাজানো। বঙ্গবন্ধুকে ব্যর্থ প্রমান করতে বাসন্তী ও দুর্গতিকে নিয়ে প্রকাশিত সাজানো সেই ছবিটি ছিল হলুদ সাংবাদিকতা ও নোংরা রাজনীতির খেলা। যে খেলার মুখোশ উম্মোচিত হলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেক প্রতিবেদনও ছাপা হয়।
এ ফটো সাংবাদিক আফতাব উদ্দিন জামাত নেতা ইউপি চেয়ারম্যান আনসার আলীকে ইউনিয়ন পরিষদ সভাকক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে দু’জনে নাটক সাজানোর জন্য চলে যান জেলে পল্লীতে। সেখানে পরিকল্পিতভাবে বাসন্তীর সমস্ত শরীরে মাছ ধরার জাল পড়িয়ে লজ্জা নিবারণের মিথ্যে সান্তনা বুকে নিয়ে একটি মেয়ে কলা গাছের ভেলায় চড়ে পাতা সংগ্রহ করছেন, বন্যার পানিতে আরেকজন সাদৃশ্য নারী শ্রীমতি দূর্গতি রাণী বাঁশ হাতে ভেলার অন্য প্রান্তে বসে নিয়ন্ত্রণ করছেন ভেলাটিকে।
পরে এ ছবি ও একটি প্রতিবেদন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া মাত্রই দেশে-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। ছবিটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্ব মানবতার মনকে নাড়া দিয়ে ওঠে। ওই ছবিটিকে সম্বল করে জনতার সামনে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসে এতটুকুও ত্রুটি রাখেনি স্বাধীনতা বিরোধীরা। বাসন্তির জাল পরা ছবিটিকে ঘিরে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ক্ষমতাসীন মুজিব সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে ছবিটিকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছিল বিষয়টি পরিকল্পিত ছিল।
১৯৭৪ এর পর ২০২০ সালের সাতক্ষিরার কয়রা অঞ্চলে চুয়াত্তরের মত আরেকটি নাটক মঞ্চায়ন হয়েছে গতকাল ঈদের দিন। ২১ মে আম্পানে দেশের দক্ষিন পশ্চিমাঞ্জলে ক্ষয়িক্ষতি হয়েছে, জলোচ্ছাস হয়েছে। অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ঘরবাড়ী পানিতে তলিয়ে গেল। মানুষ অসহায় হয়ে পরলো। এলাকার লোকজন মিলে সেখানে ভাঙ্গা বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করলো।
দুষ্টচক্ররা সেখানকার ক্ষতিগ্রস্থ মানুষগুলোর সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে চুয়াত্তরের মত ২০২০ সালে আরেক আফতা উদ্দিন খুলনা দক্ষিন জেলা জামায়াতের আমীর ও কয়রা উপজেলার প্রাক্তন চেয়ারম্যান মাওলানা তমিজ উদ্দিন এর মঞ্চে আবির্ভাব হলো। ১৪/৮/২০১৪ সালে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা তমিজ উদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ১৫/৮/২০১৪ দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় তার মুক্তি চেয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। তার সাথে যুক্ত হলো জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির এক নেতা যার বাড়ী কয়রা অঞ্চলে।
ঈদের দিন তারা কয়রা এলাকায় এসে যারা বাঁধ নির্মানের চেষ্টা করছিল তাদেরকে জড়ো করে সেখানকার পানিতে নেমে ঈদের নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা করা হয়। অথচ যে যায়গায় পানিতে নামাজ পড়া হয়েছে তার আসে পাশের এলাকায় শুকনো যায়গা ছিল। কিন্তু তারা সেখানে না গিয়ে পানিতেই ঈদের নামাজ পড়েছে। পুরো ঘটনাটি পরিকল্পিতভাবে ভিডিও এবং ছবি তুলেছে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রটি যার সাথে শিবিরের সংল্লিষ্টতা রয়েছে বলে প্রচার আছে। নামাজের পরপরই সেই ছবি তুলে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ছবিটি ব্যাপক প্রচারিত হলে এর পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা শুরু হয়। তারই প্রেক্ষিতে অনুসন্ধন করে এবং ঐ এলাকার অনেকের সাথে আলাপ করে জানা যায় এমন একটি নাটক মঞ্চস্থ করা হবে তার পরিকল্পনা করা হয় দুদিন আগেই। অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরো কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য বের হয়ে আসে। পানিতে দাড়িয়ে যে ঈদের নামাজ পড়া হয়েছিল সে নামাজে ঈমামতি করেছে সেই ২০১৪ সালে গ্রেফতার হওয়া জামাত নেতা। এতে আর বুঝতে বাকি থাকে না যে ঘটনাটি কি ঘটেছিল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরুর পর নামাজের পক্ষে কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন এটি ছিল প্রতিকি প্রতিবাদ। এবার দেখা যাক পানিতে নামাজ পড়া নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুজি।
১। কয়রা অঞ্চলে যেখানটা প্লাবিত হয়েছে সেখানে বা তার আসেপাশে এমন কোন উচু যায়গা কি ছিল না যেখানে নামাজ পড়া যায় ? অনেকেতো এক কিলোমিটার হেটে গিয়েও নামাজ পড়েন। এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি তাদের কাছে।
২। নামাজ , পূজা ধর্মীয় বিষয়। এগুলো করতে হয় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র যায়গায়। তারা পানিতে যেখানে নামাজ পড়েছে সে যায়গাটি কি পবিত্র ছিল। জলোচ্ছাসে সারা এলাকার মল মুত্রে সয়লাব ছিল যায়গাটি। এছাড়া নামাজ পড়তে হলে অজু করতে হয়। অপবিত্র যায়গায় নামার সাথে সাথেইতো তাদের অজু নষ্ট হয়ে গেছে। নামাজের মত ধর্মীয় একটি বিষয় নিয়ে তামাশা করা হয়েছে সেটাও গর্হিত কাজ হয়েছে। এর উত্তরও পাওয়া যায়নি।
৩। নামাজের ৩০ মিনিটের মধ্যে এই ছবি এবং ভিডিও মিডিয়াতে চলে আসলো কিভাবে সেটাও প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। আজাদ নামের যে ছেলেটি ছবি এবং ভিডিও করেছে সে তার ফেসবুকে একটি স্টেটাস দিয়েছে এ ঘটনার দুদিন আগে এমন একটি নামাজ হবে তার প্রচারণা চালানো হয়েছিল। সেও ছবি তোলার জন্য প্রস্তুত ছিল।
১৯৭৪ সালে বাসন্তিকে জাল পরানো হয়েছিল, নাকি দারিদ্র্যের কারণে তিনি নিজেই জাল পরে সম্ভ্রম রক্ষা করেছিলেন, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক চলেছিল । কিন্তু ৭৪-এর দুর্ভিক্ষের পর বাসন্তির আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কেউ আর বাসন্তির খোজ খবর রাখেনি।
এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি বেদনাময় অধ্যায়ের নাম ‘বাসন্তি’। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছিল ইত্তেফাকের এক প্রভাবশালি ব্যক্তি এবং আফতাব উদ্দিনের সাজানো নাটক। বঙ্গবন্ধু সরকারকে সারা বিশ্বে হেয় করার জন্য এ নাটক মঞ্চায়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৪ এ বাসন্তী-দুর্গতি নাটকের কুশিলব মইনুল কারাগার থেকে মুক্তি পান কিছুদিন আগে আর আফতাব আহমেদ পরপারে,
২০২০ সালে এসে আফতাব উদ্দিনের বংশধররা আরেকটি বাসন্তি নাটকের মঞ্চায়ন করতে চেয়েছিল। এ ছবি এবং ভিডিওটি বর্হিবিশ্বে এবং দেশে প্রচারের কাজে লাগাবে যে শেখ হাসিনার সরকার মসজিদে নামাজ পড়তে দিচ্ছেন না। তাই মানুষ পানিতে নামাজ পড়ছে এমনটা যে করবে না সেটার কি নিশ্চয়তা আছে। বা প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ ক্ষুন্ন করার জন্য এ ছবি দিয়ে নানা রকম নেতিবাচক প্রচারনা চালাবে। কিন্তু তারা জানে না এটা ১৯৭৪ সাল নয়। এটা শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের ২০২০ সাল। কোন সত্য তথ্যকে বিকৃত করার যায় না সেটা যতই প্রত্যন্ত অঞ্চলের হোক।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিটি আসার সাথে সাথেই সারা বাংলাদেশ থেকে প্রতিবাদ উঠে। এবং সাজানো নাটকটি মাঝপথেই
এর সমাপ্তি হয়। স্বাধীনতা বিরোধীরা আবার জোট বাধবে সুযোগ পেলেই বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য। কয়রাতে যারা এ নাটকের কুশীলব ছিল অনুসন্ধান করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।