• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

তিন মেয়েসহ সগিরা, এখন মেয়েরা অনেক বড় হয়ে গেছ

ওটা ছিল পরিবারের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, বেরিয়ে এলো ৩০ বছর পর!

প্রকাশ:  ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৩:২৭
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

 

অ- অ

১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই। রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা। মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিলেন সগিরা সালাম মোর্শেদ। স্কুলের কাছে দুই ছিনতাইকারী তাঁর রিকশা থামায়। পালানোর চেষ্টা করলে দুর্বৃত্তরা সগিরাকে গুলি করে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই ওই হত্যাকাণ্ডে তছনছ হয়ে যায় তাঁর তিন মেয়ের জীবন। আদালতের নির্দেশে দীর্ঘ ৩০ বছর পর আবার মামলাটির তদন্তে নেমেছে পিবিআই। তদন্তে বেরিয়ে আসে এত দিনের এক অজানা কাহিনি। ওটা স্রেফ ছিনতাইকালে খুনের ঘটনা ছিল না। ছিল পরিবারের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। 

১৭ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ঢাকা মেট্রো (দক্ষিণ) অফিসে হত্যা মামলাটি তদন্তের জন্য আসে। ৩০ বছর আগে সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ডের মামলা। ছিনতাইকারীর গুলিতে নিহত হন গৃহবধূ সগিরা মোর্শেদ সালাম। এক ছিনতাইকারীর বিরুদ্ধে চার্জশিটও দেয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারপর একটি রিটের কারণে থেমে যায় মামলার কার্যক্রম। উচ্চ আদালতের নির্দেশে সেই মামলা এখন নতুন করে তদন্ত করতে হবে। সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৬০ দিন। শুরু হলো নতুন চ্যালেঞ্জ। অনেকটাই অসাধ্য সাধন করতে নামলেন তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক এসপি শাহাদাৎ হোসেনসহ পিবিআই।

ডকেটে (মামলার নথিপত্র) অনেক কিছু থাকবে, এই আশায় শুরুতেই ডকেট উদ্ধার অভিযানে নামলেন তদন্ত কর্মকর্তা। সাধারণত আদালতের নির্দেশের কপি দেখিয়ে আগের তদন্ত কর্মকর্তার কাছ থেকে ডকেট নেন নতুন তদন্তকারী। কিন্তু পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম জানেনই না আগে কে ছিলেন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা। ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের অফিসে এবং রমনা থানায় গিয়েও ডকেটের হদিস পাওয়া গেল না। তবে রমনা থানায় ১৯৯১ সালের আদালতের একটি আদেশ পেলেন তিনি, যেখানে মামলাটি ডিবিতে পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই সূত্র ধরে ডিবিতে গিয়ে অনেক খুঁজে সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তার সন্ধান পান রফিকুল। উপপরিদর্শক সাইফুল ইসলাম, যিনি ২৫তম তদন্তকারী ছিলেন। অর্থাত্ তাঁর আগে আরো ২৫জন মামলাটি তদন্ত করে ব্যর্থ হয়েছে।

ডকেটে তেমন কিছু না পেয়ে শুরু হয় প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষীদের খোঁজ। একজন সাক্ষী ছিলেন চিকিৎসক রুমী, যিনি নিজের গাড়িতে সগিরা মোর্শেদকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেন। তাঁকে খুঁজে বের করলেন আইও। পাইওনিয়ার ডেন্টাল নামের ক্লিনিকের মালিক ডা. রুমি জানালেন,  মৃত্যুর আগে সগিরা তাঁকে কিছু বলে যাননি। তিনি বলেন, সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় তখন প্রায়ই ছিনতাই হতো। ডাক্তার রুমির কাছে কোনো তথ্য না পেয়ে মামলার অন্যতম সাক্ষী রিকশাচালক আবদুস সালাম মোল্লাকে খুঁজতে শুরু করেন আইও রফিকুল, যার রিকশায় করে মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার পথে খুন হন সগিরা। জানা যায়, সালামের বাড়ি জামালপুরের মাদারগঞ্জে। সেখানে দুই দফায় চিঠি পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি। শেষে বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেয় পিবিআই। তাঁর স্বজনরা জানান, আব্দুস সালাম মোল্লার কোনো খোঁজই তারা জানেন না। 

সিদ্ধেশ্বরী, রমনা ও খিলগাঁও এলাকার গ্যারেজগুলোতে বয়োজ্যেষ্ঠ রিকশাচালকদের খোঁজ শুরু হয়। প্রতিদিন চলে খোঁজ। একদিন সিদ্ধেশ্বরী এলাকার এক বুড়ো রিকশাচালক বলেন, ‘আমি এক রিকশাচালক সালামকে চিনি, যে খিলগাঁওয়ের একটি চায়ের দোকানে প্রায়ই আড্ডা দিতে আসে।’ তার ফোন নম্বর বা ঠিকানা জানাতে না পারলেও দোকানদারের একটি মোবাইল নম্বর দেন তিনি। তারই সূত্র ধরে পাওয়া যায় তাঁকে। 

রিকশাচালক আগের মতোই ঘটনার বর্ণনা জানালেন পিবিআইকে। রাজারবাগ মোড় থেকে সালামের রিকশায় ওঠেন সগিরা। কালীমন্দিরের দিকে যাওয়ার সময় একটি মোটরসাইকেলে দুজন লোক তাদের অনুসরণ শুরু করে। কিছুদূর যেতেই ব্যারিকেড দেয়। একটু খাটো সুঠামদেহী এক যুবক ব্যাগ টান দেয়। সগিরার হাতের বালা ধরেও টান দেয়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকে আরেকজন লম্বা সুদর্শন যুবক, যার হালকা গোঁফ ছিল। একপর্যায়ে ছিনতাইকারী দুটি গুলি করে। একটি গুলি সগিরার ডান হাতে লাগে। অন্যটি বুকের বাঁ দিকে লেগে রিকশার হুডও ছিদ্র করে। এরপর ফাঁকা গুলি করে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের সামনে দিয়ে শান্তিনগরের দিকে চলে যায় মোটরসাইকেল আরোহীরা।

সাক্ষীদের কাছ থেকে নতুন কোনো তথ্য না পেয়ে ঘটনার সময়কার সংবাদপত্র বিশ্লেষণ শুরু করেন আইও। ১৯৮৯ সালের কয়েকটি সংবাদপত্র কাটিং থেকে তিনি তথ্য পান, ‘হাসপাতালে নেওয়ার আধা ঘণ্টা পর সগিরা মারা যান।’ ‘চিনে ফেলার কারণেই গুলি করে ছিনতাইকারীরা’। সংবাদেও তথ্য ছিল, সিদ্ধেশ্বরীতে ছিনতাই হলেও সগিরার আগে কেউ নিহত হয়নি।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, আদালতে যে জব্দ তালিকা দেওয়া হয়েছে সেখানে সগিরার ব্যাগ ও বালা আছে। মানে ছিনতাইকারীরা কিছুই নেয়নি। তদন্তকারীদের সামনে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, গুলিতে সগিরা মোর্শেদ নিথর হয়ে পড়েন। ব্যাগ ও বালা নিয়ে টানাটানি করলেও কথিত ছিনতাইকারীরা কেন দুটির একটিও নেয়নি। তাহলে কি ছিনতাই করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না?

একটি রিটের কারণে সগিরা খুনের বিচার ২৮ বছর আদালতে আটকে আছে, এই তথ্যও খতিয়ে দেখেন পিবিআই কর্মকর্তারা। দেখা যায়, মারুফ রেজা নামের এক ব্যক্তির মা ওই আবেদন করেন। অথচ সগিরার পরিবারের সঙ্গে মারুফ রেজার কোনো সম্পর্ক বা বিরোধ নেই। তাহলে মারুফ রেজা কেন এই রিটের পেছনে? খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, আদালতে সাক্ষীদের জবানিতেও মারুফ রেজার নাম এসেছিল। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই সগিরা খুনের মামলার তদন্ত তদারকি করছিলেন পিবিআই প্রধান পুলিশ উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, ‘কেন ওই রিট করা হলো? এই মামলায় মারুফ রেজার মায়ের কী স্বার্থ সেটিও আমরা আমলে নিই। এর থেকেও ক্লু মেলে।’

এরই মধ্যে আদালতের বেঁধে দেওয়া ৬০ দিন শেষ হয়ে যাওয়ায় আবেদন করে ১২০ দিনের সময় বাড়িয়ে নিয়েছে পিবিআই। সে সময়ও শেষ হওয়ার পথে। সবার মাথায় দুশ্চিন্তা। ১১২তম দিনে হঠাত্ই এক আলোর ঝলকানি নিয়ে হাজির হলেন রিকশাচালক আব্দুস সালাম। জানালেন, একটি কথা তাঁর মনে পড়েছে। সগিরা মোর্শেদ একজনকে চিনে ফেলেছিলেন। তিনি ঘাতকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা, সুদর্শন, হালকা গোঁফের অধিকারী সেই যুবক। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে নাম উল্লেখ করে সগিরা তাঁকে বলেছিলেন, ‘এই...তোমাকে আমি চিনি। তুমি এখানে কেন?’ ঘটনার পরে রমনা থানা পুলিশ আব্দুস সালামকে বলেছিল, ‘চিনে ফেলার কথা বলার দরকার নেই।’

মামলার বাদী সগিরার স্বামী আব্দুস সালাম চৌধুরী পিবিআইকে পারিবারিক বিরোধের কিছু তথ্য দেন। সালামের ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী ও সগিরার জা সায়েদাতুল মাহমুদার সঙ্গে ময়লা ফেলা, ছাদ দখল, মায়ের ভালোবাসা বেশি পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ঝগড়া হয়েছে। খুনের আড়াই মাস আগে ভাইকে দিয়ে সগিরাকে শায়েস্তা করার হুমকিও দেন সায়েদা। এসব অভিযোগ আমলে নিলেও গুরুত্ব দেননি তদন্তকারীরা। তবে পরিচিত কারো হাতে খুনের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরই এই সন্দেহ চলে আসে সামনে। কারণ একজন গৃহবধূর পেশাদার ছিনতাইকারীকে চেনার কথা নয়। শুরু হয় নতুন পথে তদন্ত। জানা যায়, টাঙ্গাইলের মারুফ রেজা সায়েদার ভাই আনাস মাহমুদ রেজওয়ানের ঘনিষ্ঠ। আনাস এখন প্লান ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তা আর মারুফ আবাসন ব্যবসায়ী। শুরুতে মারুফ রেজার হদিস মিলছিল না। বেইলি রোডের ৬৭ নম্বর সিদ্ধেশ্বরীর বাড়ির ফ্ল্যাটের তালিকায় তাঁর একটি ফোন নম্বর পান তদন্তকারীরা। সেখান থেকেই সূত্র মেলে। মামলা সচল হওয়ার খবর পেয়ে অবস্থান বদলের পাশাপাশি দাড়িও রাখেন আনাস। তদন্তের ১১৪তম দিনে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। আনাসই হলেন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনার সেই লম্বা যুবক। এরপর একে একে ধরা পড়েন মারুফ রেজা, ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও সায়েদাতুল মাহমুদা। তাঁদের বয়স এখন ৫০ থেকে ৭০। চারজনই আদালতে হত্যার পরিকল্পনাসহ সবই বর্ণনা করেছেন।

ডা. হাসান আলী চৌধুরীর চেম্বারে বসে মারুফকে ২৫ হাজার টাকার চুক্তিতে হত্যার নির্দেশনা দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী মারুফ যাত্রাবাড়ীর সন্ত্রাসী হরর মুন্নার কাছ থেকে ধারে অস্ত্র নেয়। আনাসও ঘটনাস্থলে তার সঙ্গে থাকেন। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, আসামিরা বয়স্ক হওয়ায় চিকিত্সক রেখে কৌশলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় আনাস আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি জানতাম একদিন আমার এ অপরাধ ধরা পড়বে।’