আজ থেকে ৩ সড়কে বন্ধ হচ্ছে রিকশা
কুড়িল-রামপুরা-সায়েদাবাদ, গাবতলী-আসাদগেট-আজিমপুর ও সায়েন্সল্যাব-শাহবাগ এ তিন সড়কে আজ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে বন্ধ হচ্ছে রিকশা। যান্ত্রিক যানবাহনের সঙ্গে অযান্ত্রিক বাহন চললে দুর্ঘটনার শঙ্কা থেকে রিকশা বন্ধ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রাজধানীর দুই নগর পিতা। রিকশা বন্ধে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে নগরবাসীর মধ্যে। তবে রিকশা বন্ধ করার আগে বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
একইসঙ্গে ঢাকা শহরে আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকা প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তা না হলে নগরবাসীর স্বস্তির চেয়ে দুর্ভোগে বেশি পড়বে বলে মনে করেন তারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে রিকশার পাশাপাশি ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করাও জরুরি। তা না হলে যানজটের আকার আরো বাড়বে। একইসঙ্গে পরিবহনের গতি কমবে।
তিনি আরো বলেন, রিকশা তুলে দেওয়াই সমাধান না। আমরা বিভিন্ন সময় প্যাকেজ পরিকল্পনার কথা বলে এসেছি। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা যখন যেটা ভালো লাগে, সেটা নিয়ে হয়ত কাজ করবে বা করতে চায়। পুরো কাজটা করতে চায় না। বিআরটিএর হিসাবে বর্তমানে ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি আছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৬১৭টি। এই ব্যক্তিগত যানবাহনকে যানজটের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ’ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মারুফ হাসান। একটি গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকায় প্রতিদিন সাড়ে ৩ কোটি ট্রিপ হয়। এর ৪০ শতাংশ হয় রিকশার মাধ্যমে।
তিনি আরো বলেন, রিকশা বন্ধ করলে সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণ বেড়ে যাবে। গাড়ি রেখে সড়কে চলাচলের পথও হবে সঙ্কুচিত। একটা প্রাইভেট কার রিকশার চেয়ে আড়াই গুণ বেশি জায়গা নেয়। একটি বড় বাসের জায়গা নেয় ১ দশমিক ৮টি প্রাইভেট কার। এসব প্রাইভেট কার পার্কিংয়ে রাস্তার অনেকটা জায়গা দখল করা হচ্ছে। অন্যদিকে রিকশা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সবসময় চলার ওপরে থাকে।
এ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, সারা বিশ্বে পরিবেশবান্ধব অযান্ত্রিক যানবাহন উৎসাহিত করা হয়। আমাদের এখানে হচ্ছে উল্টোটা। রিকশার চেয়ে বেশি যানজট তৈরি করে প্রাইভেট কার।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বাস্তবতায় সড়ক গতিশীল ও যানজটমুক্ত করতে গণপরিবহন সহজলভ্য করে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, ঢাকায় যানজট কমাতে চাইলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করে নয়, নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একই সঙ্গে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
যানজটের জন্য রিকশাকে দায়ী করার ব্যাপারে ঢাকা মহানগর রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল কুদ্দুস প্রশ্ন রাখেন, তাহলে যেসব সড়কে রিকশা চলে না, সেখানে জ্যাম লাগে কেন?
বাড্ডা লিঙ্ক রোডের বাসিন্দা আশরাফুল আলম বলেন, আমি এই রাস্তা দিয়ে কাছাকাছি ক্লিনিকে যাই। যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরায় প্রায়ই যেতে হয় বিভিন্ন কাজে। এই সড়কে চলাচলকারী বেশির ভাগ বাস কাছাকাছি দূরত্বের যাত্রী নেয় না, দরজা বন্ধ করে রাখে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাসে উঠাও মুশকিল।
তবে ভিন্নমত দিয়েছেন মধ্যবাড্ডার বাসিন্দা মজনু। তিনি বলেন, রিকশাগুলো চলাচলে অসুবিধা অনেক। বিশেষ করে মেইন সড়কগুলোতে রিকশা চলাচলে শৃঙ্খলা থাকে না। ওরা (রিকশাচালক) ইচ্ছামতো দাঁড়িয়ে যায়, ডানে বামে টার্ন নেন, ইচ্ছামতো দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানামা করান। দেখবেন, একটা রিকশা সামনে থাকলে পেছনে থাকা সব গাড়ির গতি হয়ে যায় রিকশার সমান। জ্যামের ঢাকায় রিকশাগুলো এভাবে চলতে পারে না। মেইন সড়ক থেকে রিকশা উঠিয়ে দিয়ে জ্যাম কমানো সম্ভব। তাহলে জনজীবনে যানজট নিয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসবে।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনে ডিটিসিএর (ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কন্ট্রোল অথোরিটি) এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে রাজধানীর এই তিন সড়কে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বৈঠক শেষে ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ঢাকা শহরের সড়কে যানবাহনের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ডিটিসিএর বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সড়কগুলোতে রিকশা চলাচল বন্ধ হওয়ার পর নাগরিকদের যেন চলাচলে সমস্যা না হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবহন মালিক সমিতি এবং বিআরটিসির পর্যাপ্ত বাসসেবার ব্যবস্থা করা হবে। আগামী ৭ জুলাই পরীক্ষামূলক ওই সড়কগুলোতে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে পরবর্তী সময়ে ১৪ জুলাই আবারও বৈঠকে বসবে সমন্বয় কমিটি।
এদিকে গতকাল শনিবার ডিএনসিসি নগর ভবনে তিন সড়কে রিকশা-ভ্যান নিষিদ্ধ কার্যকর করতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, রিকশা নিষিদ্ধ নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। প্রধান সড়কগুলোতে যান্ত্রিক যানবাহনের পাশাপাশি রিকশা এবং অন্যান্য অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। তবে প্রধান সড়ক বাদ দিয়ে অন্যান্য সড়কে রিকশা এবং অন্যান্য অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করতে পারে।
গাবতলী থেকে আজিমপুর ও কুড়িল বিশ্বরোড থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত এই দুটি সড়কে পর্যাপ্ত বাস নামানোর জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি) এবং বাস মালিক সমিতির প্রতি আহ্বান জানান তিনি।