খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ ও ‘জরুরি অবস্থা’ চান হাইকোর্ট
৫২টি খাদ্যপণ্য অবিলম্বে বাজার থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ সংবলিত হাইকোর্টের গতকালের আদেশের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আজ প্রকাশিত হয়েছে। হাইকোর্ট তার বিস্তারিত পর্যবেক্ষণে ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে অবিলম্বে সরকার বিশেষ করে দেশের ক্ষমতাসীন দল এবং প্রধানমন্ত্রীকে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ করতে এবং প্রয়োজনে এই নির্দিষ্ট মহামারির বিরুদ্ধে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তাদের ছয় পৃষ্ঠার একটি বিস্তারিত আদেশে এ প্রসঙ্গে অবশ্য উল্লেখ করেন যে, ‘কোন বিষয় কখন অগ্রাধিকার পাবে, সেটা অবশ্য সরকারের নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তের বিষয়, আদালত সেটা ‘ডিক্টেট’ করতে পারেন না। কিন্তু আদালতের অভিমত এই যে, খাদ্যে ভেজালই সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এক নম্বর অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিত।
আদালত এই পর্যায়ে ‘‘সাম্প্রতিক মাদকবিরোধী যুদ্ধের মতোই ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার’’ পক্ষে মত দেন। আদালতের কথায়, ‘‘এই যুদ্ধের লক্ষ্য হবে, খাদ্য, খাওয়ার পানি ও ওষুধ ইত্যাদিতে ভেজাল দেওয়া কিছুর উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি বন্ধ করা। একই সঙ্গে দেশের প্রতিটি বড় শহরে ওয়াসা পাইপলাইন দিয়ে বিশুদ্ধ সুপেয় পানি সরবরাহে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যাতে রিকশাচালকদের মতো সীমিত আয়ের মানুষেরা যাতে রাস্তার পাশের ওয়াসা ট্যাপ থেকে পানি পান করতে পারেন।’’
আদালত বলেন, ‘আমরা গভীর হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, খাদ্য ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম, এ রকম একাধিক সরকারি সংস্থার (বিএসটিআই, খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর) অস্তিত্ব রয়েছে। অথচ তারা নির্লিপ্ত। মানুষ প্রতিদিনই একটা বাধ্যতামূলক পরিস্থিতির শিকার হয়ে নিম্নমানের বা ভেজাল খাদ্য, পানি, ওষুধ ইত্যাদি কিনছেন। এসবের প্রতিকারে আদালত বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে থেকে নিয়মিত অভিযোগ পাচ্ছে। তারা বলছেন, সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো ভেজাল রোধে অকার্যকর থাকছে।’
আদালত তার আদেশে আরও বলেন, ‘ আমাদের অভিমত এই যে, ‘প্রতিবছর শুধু রমজান এলে ভেজাল নিরোধক তৎপরতা চোখে পড়ে, বছরের বাদবাকি সময় তারা শীতনিদ্রায় (হাইবারনেশন) যায়। এসব সংস্থাকে সারা বছর ধরেই যথাযথ উদ্দীপনার সঙ্গে ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হবে। উপরন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের নিজেদের শুধু বেতনভুক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে ভাবলেই চলবে না, তাদের দেশপ্রেম এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসার মনোভাব নিয়ে ভেজাল খাদ্য বিরোধী অভিযানে অংশ নিতে হবে। অন্যথায় ভেজাল খাদ্যের মহামারি ঠেকানো যাবে না।’
আদালত স্মরণ করিয়ে দেন যে, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট এবং আদালতসমূহের দায়িত্ব হলো বিবাদমান পক্ষগুলোর মধ্যকার বিরোধ নিরসন করা। অন্যদিকে খাদ্যে ভেজালের মতো মহামারি রোধের দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকা উল্লিখিত সংস্থাগুলোর। কিন্তু তাদের কর্তব্য অবহেলার কারণে এ সংক্রান্ত পাবলিক ইন্টারেস্ট মামলা শুনতে সুপ্রিম কোর্টের অনেক মূল্যবান সময় ব্যয় হচ্ছে।আদালত মনে করে, ভেজাল খাদ্য বন্ধে কোনো ধরনের আপস বা সহনশীলতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য, রুল জারি করা আদেশ সাধারণত সংক্ষিপ্ত হয়, কিন্তু এটা সহজে অনুমেয় যে, জনগুরুত্ব ও সংবেদনশীলতা বিবেচনায় হাইকোর্ট একটি নাতিদীর্ঘ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।
রিটকারীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দীন খান মঙ্গলবার (১৪ মে) প্রথম আলো-কে বলেন, আদেশের কপি পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যে বিএসটিআই চিহ্নিত ৫২টি পণ্য বাজার থেকে তুলে নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। আজই স্পেশাল মেসেঞ্জার দিয়ে আদেশের অনুলিপি সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে শিহাব বলেন, তার জানামতে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিষ্ঠান আপিল বিভাগে যায়নি।উল্লেখ্য যে, ৫২টি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের মূল্যায়ন পদ্ধতির যথার্থতা প্রশ্নে ভিন্নমত ব্যক্ত করেছে।আগামী ২৩ মে এই মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ স্থির রয়েছে।