• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

হাইমচরের শিশু শিক্ষার্থী মারজানা হত্যার এক বছর ॥ তদন্তভার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর

আটক হয়নি ধর্ষণ ও হত্যায় অভিযুক্ত পালতক তিন যুবক ॥ আজও কান্না থামেনি পাগলপ্রায় অসহায় বাবা-মায়ের

প্রকাশ:  ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:৩১
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

হাইমচর উপজেলার ৪নং নীলকমল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত ও দুর্গম চর এলাকা ঈশানবালা। মেঘনার পশ্চিম পাড়ের নদী বেষ্টিত এই গ্রামের খলিল মাতাব্বর কান্দির এক হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে মারজানা আক্তার (৯)। ২০১৭ সনের ২২ ডিসেম্বর ধর্ষণ শেষে খুন হয় সে। এই ঘটনার দীর্ঘ এক বছর পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্ত তিন বখাটে যুবককে আটক করতে পারেনি পুলিশ। তবে ১০ মাস পরে মামলার তদন্তভার হাইমচর থানা পুলিশের কাছ থেকে চাঁদপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শামীম হোসেন এই প্রতিবেদককে জানান, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এ ছাড়া অভিযুক্ত আসামীদের আটক করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে মারজানার পিতা মোকশেদ হাওলাদার এবং মা সেলিনা বেগম এখন অনেকটাই পাগলপ্রায়।
    খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় ৩২নং চর কোড়ালিয়া সপ্রাবির তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী মারজানা আক্তার। সবেমাত্র ৯ বছরে পা রাখা শিশু মারজানার উপর দৃষ্টি পড়ে স্থানীয় কিছু বখাটে যুবকের। বিষয়টি অসহায় বাবা-মা জানলেও সাহস করে প্রতিবাদ করেননি। ফলস্বরূপ ২০১৭ সনের ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ধর্ষণ শেষে হত্যার শিকার হয় মারজানা। স্থানীয় দুষ্ট মানুষের ভুল পরামর্শে মেয়েকে ভূতে মেরেছে বলে ময়না তদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের অনুমতি চায় তার পরিবার। অক্ষরজ্ঞানহীন বাবা-মায়ের কথায় প্রশাসনও লাশ ময়না তদন্ত ছাড়া দাফনের অনুমতি দেয়। ঘটনার একদিন পরে লাশের গোসল দেয়া নারী মারজানার পিতাকে জানান, লাশের গোপনাঙ্গসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে তিনি আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন। আর মারজানার মা সেলিনা বেগমও জানান, মেয়েকে খুঁজতে গিয়ে প্রতিবেশী এক যুবককে দৌড়ে পালাতে দেখেছেন তিনি। এভাবেই বেরিয়ে আসে একের পর এক নানান তথ্য। এমন কথা প্রকাশ হতেই পুরো ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। মেয়ে হারানোর শোকে পাগলপ্রায় পিতাও ছুটে যান বিলের পাশের সেই বাঁশ ঝাড়ের কাছে, যেখানে মারজানার লাশ পড়ে ছিলো। খোঁজ নিয়ে দেখেন, ওই স্থানের পাশেই স্থানীয় সেলিম সর্দারের পরিত্যক্ত একটি ঘরের মাটিতে রক্ত লেগে আছে। আর বাঁশঝাড়ে ঝুলে আছে বাবার কাছে যাওয়ার সময় মারজানার হাতে থাকা সেই বাজারের ব্যাগটি।
২০১৮ সনের ১৯ জানুয়ারি শিশু মারজানাকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়েছে এমন দাবিতে মোঃ মোকশেদ হাওলাদার বাদী হয়ে হাইমচর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা দায়ের করেন। মামলায় সন্দেহভাজন স্থানীয় সেই তিন যুবককে আসামী করা হয়। যার মামলা নং জিআর ০৪/১৮। ধারা ৩০২/৩৭৬/২০১/৩৪ ও ১০৯। আসামীরা হলো : ঈশানবালা গ্রামের সুরুজ কান্দী এলাকার দীন ইসলামের ছেলে জালাল মিয়া (২০), কাদির বেপারীর ছেলে সিদ্দিক (২১) এবং মোঃ সফি উল্যাহর ছেলে সেলিম (২১)। এ বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলে, ওই মামলার সূত্র ধরেই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে ২৫ জানুয়ারি আদালত কর্তৃক মারজানার লাশ উত্তোলন করে ময়না তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়।
পৌনে দুই মাস পর ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে হাবিবা মীরা ও হাইমচর থানার উপ-পরিদর্শক মোঃ মুকবুলসহ পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতে কবর থেকে মারজানার লাশ উত্তোলন করে ময়না তদন্ত করা হয়। লাশ চাঁদপুর মর্গে এনে সেখানে সরকারি জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক দিয়ে ৩ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল টিম গঠনের মাধ্যমে ময়না তদন্ত করা হয়। এরপর ওই রাতে পুনরায় তাকে কবরে দাফন করা হয়।
মারজানার মা সেলিনা বেগম জানান, ঘটনার দিন সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে সদাইয়ের জন্যে তিনি ব্যাগ হাতে মেয়েকে বাজারে বাবার দোকানে পাঠান। এরপর রাত ৮টা বাজলেও মেয়ে বাড়িতে ফিরেনি। এরই মধ্যে তার স্বামীও ঘরে চলে আসে। বিষয়টি জানার পরে বাবা-মা দুজনে মিলে মেয়েকে খুঁজতে বের হন। পথিমধ্যে বাজার থেকে বাড়ির রাস্তার মাঝখানে একটি বাঁশঝাড়ে বিলের পাড়ে মেয়ের লাশ দেখতে পান।
মারজানার পিতা মোঃ মোকশেদ জানান, যখন মারজানার লাশ পাওয়া যায় তখন তার গায়ের কামিজটি উল্টানো ছিলো এবং নাকে-মুখে এবং চোখে জখমের চিহ্ন ছিলো। খবর পেয়ে হাইমচর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। পুলিশ ওই স্থান থেকে ক’টি টর্চ লাইটও উদ্ধার করে। স্থানীয় কয়েকজন বলেন, মারজানাকে ভূতে মেরেছে। বিষয়টি বুঝতে না পেরে পুলিশের অনুমতি নিয়ে আমরা লাশ ময়না তদন্ত না করে দাফন করেছিলাম। পরে লাশ গোসল করানো মহিলা যখন বললো মারজানার গোপন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিলো, তখন নিশ্চিত হলাম আমার মেয়েকে খারাপ কাজ করে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, যাদের আসামী করা হয়েছে তারা প্রায় স্কুলে যাওয়ার সময় মারজানাসহ অন্যান্য স্কুল ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করতো। আদালতে মামলা করার পর থেকে আসামীদের পরিবারের পক্ষ থেকে নানানভাবে আমাকে ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে এবং আপোষ করারও প্রস্তাব দিচ্ছে।
তিনি আরো জানান, এই ঘটনার কয়েক মাস পরে গত মে মাসে হাইমচর থানা পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহভাজন হিসেবে আওলাদ (২১) নামে একজনকে আটক করে। পরবর্তীতে আদালত তাকে তিন দিনের রিমান্ড দেয়। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে ১৫ জুলাই আওলাদ জামিনে বেরিয়ে আসে। এ বিষয়ে আমি পুলিশ সুপার স্যারের সাথেও দেখা করেছি। আমাদের দেশ এতো উন্নত হয়েছে, অথচ পুলিশ তিনজন আসামীকে ৭ মাসেও আটক করতে পারেনি। আর কতদিন অপেক্ষা করলে আমি আমার মেয়ের হত্যার বিচার পাবো?
এদিকে চলতি বছরের ১৮ জুলাই চাঁদপুরের সাবেক পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার পিপিএম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং মারজানার পরিবার ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলেন। পুলিশ সুপার জানিয়েছিলেন, অপরাধী যে হোক না কেনো দোষী প্রমাণিত হলে তাদের শাস্তি পেতে হবেই।

 

সর্বাধিক পঠিত