চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে জনমণে প্রশ্ন! ঈদ বন্ধে দুদিনে ৩ খুন 0Shares
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মাহবুবুর রহমান চলতি মাসের ১২ জুন সিএমপি কমিশনারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন নগরীর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়েও ভালো।
পরদিন দামপাড়া পুলিশ লাইন্স এ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, চলমান মাদকবিরোধী অভিযান আরো জোরদার করা, জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রেখে চট্টগ্রাম নগরীকে বাসযোগ্য পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে গড়ে তোলার ভিশন নিয়েই তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।
মিডিয়ার কল্যাণে তার এবক্তব্য যখন চট্টগ্রাম নগরবাসীর দৃষ্টিগোচর হয় ঠিক তার কদিন পরেই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একের পর এক খুনের ঘটনায় বিচলিত নগরবাসী। শুধুমাত্র ঈদের পরের দুদিনে নগরীতে খুন হয় তিনটি। ফলে সাধারণ জনগণের মাঝে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যান্ত্রিক নগরীতে প্রশান্তিতে চট্টগ্রাম বাসী যখন ছুটিতে ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা, তখন চট্টগ্রামের তিন পরিবারে স্বজনদের মাঝে চলছে শোকের মাতম। তুচ্ছ তিনটি পৃথক ঘটনায় ঈদ পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় খুন হয়েছেন তিন যুবক।
সমাজের বিশিষ্টজনরা মনে করছেন, হঠাৎ করেই বন্দরনগর চট্টগ্রামে খুনখারাবি বেড়ে গেছে। আধিপত্য বিস্তার ও তুচ্ছ ঘটনায়ও হচ্ছে একের পর এক খুন। হত্যাকান্ডের ঘটনায় মামলা হলেও জড়িতদের অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। মূল হোতারা ধরা না পড়ায় হতাশ হত্যাকাণ্ডের শিকার ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। তাছাড়া অপরাধের সাথে জড়িতরা বার বার আইনের ফাঁক ফোঁকড়ে বেড়িয়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ধর্ষণসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলে মন্তব্য করেছে বিশিষ্ট জনরা।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সচেতন মহল মনে করছেন উঠতি বয়সি কিশোরদের কোমলমতি মন ও তাদের চঞ্চলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত কথিত রাজনৈতিক বড় ভাই। ক্ষমতাশীল বড় ভাইদের নের্তৃত্বে খুনসহ জঘন্যসব অপরাধে জড়াচ্ছে এসব কিশোররা।
আর সকল অপকর্মের মাস্টার মাইন্ড বড় ভাইয়েরা ক্ষমতাসীন দলের নাম ব্যবহার করে কখনো ফুটপাত দখল থেকে শুরু করে দোকানপাট ও বাড়ি দখলে আবার কখনো কখনো এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের নামে চাঁদাবাজির পেশায় নামিয়ে আনছে উঠতি বয়সি কিশোরদের। বর্তমানে তারা এতই বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে যে কথায় কথায় বন্দুক ও ছুরি চালাতেও একটুও পিছপা হচ্ছে না। ফলে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অপরাধ জগতের সর্ব্বোচ্চ পর্যায় খুনের ঘটনায় লিপ্ত হচ্ছে কিশোররা। নগর জুড়ে বাড়ছে খুন।
সর্বশেষ বড় ভাই কর্তৃক পরিচালিত একটি কিশোর গ্যাংয়ের রোষানলে প্রাণ হারিয়েছে অনিক নামের এক যুবক। হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে বাবা নাসিরউদ্দিনের চোখের সামনেই। গেল রোববার ঈদের পরদিন রাতে নগরীর চট্টশ্বরী মোড়ে বাবার সঙ্গে দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় অনিককে কুপিয়ে হত্যা করেছে একটি কিশোর গ্যাং। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ ব্যাটারী গলির যুবলীগ ক্যাডার তুষার দলবল নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
তারা জানায়, নিহত অনিকের ছোট ভাই রনিকের সাথে মোটর সাইকেলের হর্ন বাজানো নিয়ে হাঙ্গামা বাঁধে ঐ এলাকার বড় ভাই নিয়ন্ত্রিত মোটরবাইক গ্যাং সদস্যদের। এর জের ধরে ২০/২৫টি মোটরসাইকেল নিয়ে মোটরবাইক গ্যাংয়ের সদস্যরা রাতে পল্টন রোড এলাকায় রনিকের বড় ভাই অনিকের উপর হামলা চালায়। নিহত অনিকের বাবা মো. নাছির বাদী হয়ে চকবাজার থানায় ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। পুলিশ এ ঘটনায় কাউকে এখনো গ্রেফতার না করায় ক্ষুব্ধ অনিকের বাবা মা। ক্ষোভ প্রকাশ করেছে নিহতের স্বজনরা। তাদের দাবি হত্যাকারিদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দেওয়া হোক।
একই দিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে হালিশহর আর্টিলারি সড়কে বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা দেখে ফেরার পথে খুন হন মো. সুমন নামে এক কিশোর। সুমন ও তার বন্ধুরা মিলে হেঁটে আজিজ মিয়া মসজিদের পেছনে যাওযার সময় বেশ কয়েকজন ছিনতাইকারী তাদের গতিরোধ করে। এসময় সুমনের কাছ থেকে তারা মোবাইল কেড়ে নেয়। সুমনকে উরুতে এবং নুরুল আলমকে পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়। রাত তিনটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সুমনকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় সুমনের ভাই বাদী হয়ে হালিশহর থানায় একটি হত্যা মামলা করলে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১০ কিশোরকে আটক করেছে পুলিশ। তাদের স্বীকারোক্তিতে সুমন খুনের সময় ব্যবহৃত ছোরা এবং ছিনতাই করা মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
পরের দিন সোমবার (১৮ জুন) রাতে বাকলিয়া থানার ময়দার মিল এলাকায় আব্দুল গণি বাই লেন এলাকায় বন্ধুর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছে জসিম উদ্দিন (১৮) নামে স্থানীয় এক তরুণ। পুলিশ বলছে, জসিমের বন্ধু মোবারক হোসেন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বাকলিয়া থানার ওসি প্রণব চৌধুরী জানান, একটি শার্ট বিক্রির এক হাজার টাকা দেয়া নেয়াকে কেন্দ্র করে মোবারক জসিমকে খুন করে। মোবারককে গ্রেফতার করতে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে বলে জানিয়েছেন ওসি।
প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আলাদা আলাদা মামলা হয়েছে। হালিশহর ও বাকলিয়ার ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতার করলেও মুল হোতাদের টিকিটিও ছুতে পারেনি বলে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে নিহতের স্বজনরা। অন্যদিকে নগরের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সচেতন মহলে উঠেছে প্রশ্ন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মাহবুবুর রহমান বলেন, সবকটি ঘটনায় গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে পুলিশ। সম্প্রতি দুটি হত্যাকান্ডের ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করার কথা জানিয়ে পুলিশ কমিশনার বলছেন, অপরাধিদের গ্রেফতার করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার পুলিশ বাহিনী। জড়িতদের সবাইকে ধরা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবনতি নিয়ে প্রশ্ন উঠার কোন কথা নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, চলতি সপ্তাহের কয়েকটি খুনের ঘটনার মধ্যে শুধুমাত্র হালিশহরের সুমন হত্যাকাণ্ডটি পুলিশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ভাবিয়েছে। আমরা এর মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতারও করেছি। বাকলিয়ার ঘটনাটি সম্পূর্ণ তাদের আভ্যন্তরিন বিষয় এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রুখার কোন সুযোগই ছিলো না। অনিক হত্যার আগে তাদের বিরোধটি আমরা নিস্পত্তি করেছিলাম এরপরও রাতে খুনের ঘটনাটি ঘটেছে বলে জানান পুলিশ কমিশনার।