• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

চট্টগ্রামের ৪ উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা

প্রকাশ:  ১৪ জুন ২০১৮, ১৮:১১
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

চট্টগ্রামে লাগাতার ৩ দিনের ভারী বর্ষণে জেলার পটিয়া, হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়িতে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কারণে এসব উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়ন পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে পানিবন্দি ও গৃহহারা হয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ।

পটিয়া উপজেলা : অতিরিক্ত বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার উত্তরা ছনহরা এলাকায় শ্রীমাই খালের বেড়িবাঁধ পানির প্রবল স্রোতে দুটি অংশ ভেঙে গেছে। তাছাড়া উপজেলার কেলিশহর, হাইদগাঁও, কচুয়াই, শোভনদন্ডী, খরনা, ভাটিখাইন, দক্ষিণ ভূর্ষি, ধলঘাট, জঙ্গলখাইন, কুসুমপুরা, কোলাগাঁও, জিরি, আশিয়া, কাশিয়াইশসহ ১৭ ইউনিয়নের নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে শতাধিক পুকুরের মাছের পোনা ভেসে গেছে। এতে মৎস্য চাষীদের লক্ষ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার ১৭ ইউনিয়ন ও পৌর সদরের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ইতিমধ্যে শ্রীমাই খালের বেড়িবাঁধ ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। 

হাটহাজারী উপজেলা : টানা ভারী বর্ষণে উপজেলার হাটহাজারী পৌরসভা, প্রায় সবকটি ইউনিয়নের আঞ্চলিক সড়ক, অসংখ্য ঘরবাড়ি, মাছ চাষের পুকুর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ডুবে কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানির স্রোতে ভেসে নিখোঁজ এক যুবক।

নাজিরহাট-মাইজভান্ডার সড়কের সমশুর দোকান সংলগ্ন এলাকায় তৈয়ব নামক (২৮) এক যুবক পানির প্রবল স্রোতে ভেসে যায় বলে জানান এলাকাবাসী। তিনি পূর্ব ফরহাদাবাদ কদল তালুকদার বাড়ির বাসিন্দা। এখনো তার খোঁজ মেলেনি। সে পেশায় রাজমিস্ত্রি। তার নিখোঁজের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় কাউন্সিলর ও নাজিরহাট পৌর প্যানেল মেয়র মোহাম্মদ আলীও।

হালদা নদী সংলগ্ন একাধিক স্পটে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় বন্যার পানি আরো বাড়ছে। এমনকি হাটহাজারী-রাঙ্গামাটি মহাসড়ক, হাটহজারী-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক ও হাটহাজারী অক্সিজেন মহাসড়কের ৬টিস্থানে মহাসড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার কারণে মঙ্গলবার দিনভর এই তিন মহাসড়কে যানচলাচলে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটেছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আক্তার উননেছা শিউলী জানান, উপজেলা প্রশাসন প্লাবিত এলাকায় দুর্যোগ সৃষ্টি হলে তা মোকাবেলায় সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে বন্যা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও জেলা প্রশাসনের নিকট ত্রাণের আবেদন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বন্যা কবলিত এলাকার জনগণকে অপেক্ষাকৃত উচু স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। 

রাউজান উপজেলা : রাউজানে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যায় পানিবন্ধী রয়েছে উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের প্রায় লক্ষাদিক মানুষ। ইউনিয়ন গুলো হচ্ছে হলদিয়া, ডাবুয়া, চিকদাইর, গহিরা, নোয়াজিষপুর, পুর্ব গুজরা ও রাউজান ইউনিয়ন। রাউজান পৌরএলাকাসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে মাটির গুদাম ও কাঁচা বসতঘর বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়ক কোমড় পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মঙ্গলবার দিনভর যান চলাচল বন্ধ ছিল। যান চলাচল বন্ধ থাকায় জলমগ্ন এলাকা অতিক্রম করে গন্তব্যস্থলে যাওয়ার জন্য রিকশা, ভ্যান গাড়ি, পাওয়ার টিলার সংযুক্ত ট্রলি ও চাঁদের গাড়ির উপর ভরসা করছেন যাতায়তকারীরা।

এদিকে বন্যা দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এমপি। তিনি ডাবুয়া ইউনিয়ন, হলদিয়া ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় দুর্গতদের উপজেলা পরিষদ কর্তৃক ঘোষনা করা অস্থায়ী আশ্রয়নে উঠার আহবান জানান।

তিনি বলেন যতদিন বাড়ি ঘরে পানি থাকবে, ততদিন আশ্রয়নে খাওয়া থাকা ব্যবস্থা নিয়েছি।

রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম হোসেন রেজা জানান, অব্যাহত প্রবল ভারী বর্ষণ এবং পাহাড়ী ঢলে মারাত্মক বিপর্যস্ত রাউজানের ৬টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ড। মানবিক কারণে ২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ১টি কন্ট্রোল রুম চালু রেখেছে। সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সর্বক্ষনিক কর্মস্থলে অবস্থান করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ফটিকছড়ি উপজেলা : জেলার ফটিকছড়ি জুড়ে ভয়াবহ বন্যা সৃষ্টি হয়েছে। তিন দিনের অভিরাম বৃষ্টি ও হালদা-সর্তা-ধুরুং খালের বাঁধ ভেঙ্গে পরিস্থিতি ক্রমে অবনতির দিকে এগুচ্ছে। উপজেলার প্রায় ১২টি ইউনিয়ন ও দুইটি পৌরসভার প্রায় অর্ধশত গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে অর্ধশত গরু ও ছাগল। নষ্ট হয়েছে আমন ধানের বীজতলা ও পুকুরের মাছ।

এদিকে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন স্কুল-কলেজে বন্যা দূর্ঘত মানুষের জন্য আশ্রয়ন কেন্দ্র খুলেছে এবং সার্বক্ষনিক একটি নিয়ন্ত্রন কক্ষ খুলেছে বলে জানিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড নারায়ণহাট গেজ ষ্টেশন কর্মকর্তা খুরশিদ আলম জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওয়াটার লেভেল ১৬.৮৬। হালদা নদীর ৫.৯০ সে.মি. পানি বিপদসীমার উপর দিয়া প্রবাহিত হচ্ছে। সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত ২৬৫.০ মিলি মিটার রেকর্ড হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, উপজেলার ধর্মপুর, কমিটি বাজার, বখতপুর, সমিতিরহাট, নিচিন্তাপুর, আজাদী বাজার, পশ্চিম ধর্মপুর, লেলাং, গোপাল ঘাটা, কাঞ্চন নগর, মানিকপুর, তেলপারই, মানিক গোলা, পশ্চিম বখতপুর, ওখাড়া, রোসাংগীরি, পশ্চিম নানুপুর, মাইজভান্ডার, আজিমনগর, সুয়াবিল, সুন্দরপুর, পূর্ব হারুয়ালছড়ি, পাইন্দং, ভেড়াজালী, শেতকুয়া, দৌলতপুর, কুম্বার পাড়, ধুরুং, রাঙ্গামাটিয়া এলাকা সহ প্রায় ৫০টি গ্রাম বন্যার পানিতে ডুবে আছে। এখানকার প্রায় ৩ লাখ মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে নৌকা যোগে যোগাযোগ করতে হচ্ছে এবং বিশুদ্ধ পানি ও খাবার অভাব দেখা দিয়েছে। ধানের বীজতলা নষ্ট হয়েছে। হাস মুরগী ও গবাধি পশু নিয়ে বন্যাদূর্ঘত এলাকার মানুষের দূর্ভোগের সীমানেই।

 

গতকাল বুধবার উপজেলার লেলাং ইউনিয়নের শাহনগর গ্রামে মাটির ঘরের দেয়াল ধ্বসে ওয়াজ খাতুন (৮০) নামের এক বৃদ্ধার মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিহত ওয়াজ খাতুন ওই এলাকার হামিদ আলী মস্ত্রীর বাড়ির মৃত মোহাম্মদ সোলাইমান (প্রকাশ কালুর) স্ত্রী।

স্থানীয়রা জানান, বন্যার পানিতে তাদের মাটির ঘরের দেওয়াল তার গায়ের উপর ধসে পড়ে হাত, কোমর ও মাথায় গুরুতর আঘাত পায় ওয়াজ খাতুন। পরে আহত অবস্থায় তাকে পাশের ঘরে নিরাপদ স্থানে রাখলেও রাস্তাঘাটে প্রচুর বন্যার পানি থাকায় তার যাথাযথ চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয়নি বলেই তার মৃত্যু হয়।