কালের আয়নায়: পর্ব ৯ ॥ পীর হাবিবুর রহমান
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিনই বাড়িতে বিচার। বিজ্ঞান বিভাগের ডেমনস্ট্রেটর মরহুম আবদু মিয়া ছিলেন সামাজিকভাবে শহরের প্রায় সকল পরিবারের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। ছোটখাটো মানুষটি প্রাইভেট যখন পড়াতেন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরাই তার কাছে বেশি পাঠ নিয়েছেন। আমাদের পরিবারের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন চিরকুমার। ছাত্রী আর অভিভাবক মহলে ছিলেন জনপ্রিয়। তরুণরা তাকে সমীহ করে চলতেন অভিভাবকরা বিগড়ে যাবেন এই ভয়ে।
সেই সময় রক্ষণশীল সমাজে ক্লাসমেট ছাত্রীদের সঙ্গেও কথাবার্তা মাঝেমধ্যে রয়ে সয়ে হয়েছে। ছাত্র রাজনীতির সুবাদেই সহপাঠী ছাত্রীদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে যাবার সুযোগ হলেও কথাবার্তা হতো অভিভাবকদের সামনেই। তাও কখনো কোনো তরুণ হালকা পাতলা ঘনিষ্ঠতার সুবাদে কোনো ছাত্রীর বাসায় গিয়ে বারান্দায় উঠলেই দেখতে পেতেন ড্রয়িংরুমে আবদু মিয়া স্যার সেই মেয়েটির সঙ্গে বসে গল্প করছেন। তখন এমনিতেই স্বেচ্ছায় পত্রপাঠে বিদায় নিয়ে আসতে হতো।
এই বেদনাবোধ অনেক তরুণদের মধ্যেই ছিল। তবে আমাদের অগ্রজ ইমানুজ্জামান চৌধুরী মহি এ বিষয়টি বুকের ভিতর পুষে রাখা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যখন একবার বলেছিলেন, তখন মনে হয়েছে-এটি আমাদের সমবয়সীদের মধ্যেই ছিল না, উপরেও অনেকের তপ্ত নিঃশ্বাস ঝড়েছে।
যাক, কলেজের প্রথম দিনই আবদু মিয়া স্যারের বিচার ছিল-আমি উগ্র এবং ওভার স্মার্ট হিসাবে ভর্তির জন্য মৌখিক পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছি। আমরা যখন কলেজে প্রবেশ করি তার আগে থেকেই অধক্ষ্য হয়ে এসেছিলেন মুহিবুল ইসলাম চৌধুরী। একগুয়ে, জেদী, একরোখা একজন প্রিন্সিপাল হিসাবে কলেজের দু’টি বছর তিনি শান্তি দেননি। আমরা কলেজে ঢুকার পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পরে। তার আগে ভাঙনে পতিত হয় জাসদ ছাত্রলীগ। ঢাকসু ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্নার তখন ছাত্র রাজনীতিতে ঈর্ষনীয় ইমেজ। তার প্রভাবে সুনামগঞ্জ জাসদ ছাত্রলীগের প্রায় সকল নেতাকর্মী চলে যান বাসদ ছাত্রলীগে। জাসদ ছাত্রলীগের বড় নেতারা পরে থাকেন জাসদের সাথে। আমাদের বন্ধুদের একটি গ্রুপ জাসদ ছাত্রলীগে সক্রিয় হলেও যাদের ছাত্র রাজনীতির তামিল নেয়ার কথা ছিল না, তারা যোগ দেয় বাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে।
কলেজে যখন পা দিয়েছি তখন ছাত্র সংসদের কর্তৃত্ব আমাদের ছাত্রলীগের হাতে। ভিপি মানিক লাল দে, জিএস আইয়ুব বখত জগলুল, এজিএস রেজাউর রহমান, সাহিত্য সম্পাদক এস এম আব্দুল হাই পীর, ছাত্রলীগের রাজনীতিতে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়ে উঠে আসা সুবীর তালুকদার বাপটু তো ছিলেনই; কলেজের বাইরে জেলা ছাত্রলীগের নেতা হিসাবে নান্টু রায়, হায়দার চৌধুরী লিটন, দেওয়ান শের জাহান রাজা, হাবিবুর রহমানসহ অনেকেই ছিলেন। বাসদ ছাত্রলীগের নেতা হিসাবে বিনোদ রঞ্জন তালুক, সৈয়দ শামসুল ইসলাম, অকাল প্রয়াত হিতাংশু তালুকদার পিন্টু, আ ত ম মিসবাহসহ অনেকেই ছিলেন।
কলেজে পা দেয়ার আগেই সংগঠনে কর্মী সংগ্রহ থেকে শুরু করে সকল কর্মকাণ্ডে অগ্রজদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরি। বন্ধু শাহ আবু তারেকদের লাল ঘরেই ছিল আমাদের জমজমাট আড্ডা, যেমন ছিল আমার বাংলো ঘরে। জুবিলী স্কুল থেকে আমরা যারা এসএসসি পাস করেছিলাম সেই বন্ধুদের প্রায় সকলেই সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। হোসেন চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে চলে গেল। সাফকাত তল্পিতল্পা গুটিয়ে তার ঢাকার বাসায় চলে যায়। ভর্তি হয় তেঁজগাও কলেজে। তুহিন ও সালাম তালুকদার ভর্তি হয় সিলেট এমসি কলেজে। সালাম থাকতো এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্রবাসে আর তুহিন থাকতো কঠোর নিয়মে বাঁধা, অগাদ স্নেহ আদরে তার বড় খালার বাসায়। কিন্তু জলের মাছ ডাঙায় পরলে যে অবস্থা হয়, তার সেই অবস্থা। মন চায় অবাদ স্বাধীনতা।
৬ মাসের মাথায় টিসি নিয়ে সুনামগঞ্জ কলেজে তারা দু’জনেই চলে আসে। তবে এমসি কলেজে ভর্তি হয়ে সাপ্তাহিক ছুটির আগের সন্ধ্যায় তুহিন সুনামগঞ্জ চলে আসতো। ছুটির দিন সকালে আমরা যখন বেরুতাম, তখন হাঁটতে হাঁটতে বা বাইসাইকেলে কলেজে চলে যেতাম। নারকেল গাছ ও কৃষ্ণচূড়া শোভিত পাকা বেঞ্চ বা ঘাসের ওপর বসে আড্ডা দিতাম। এই সময় লুকিয়ে লুকিয়ে ক্যাপিস্টান সিগারেট টানা তুহিনের কাছে আমার ধূমপানের তালিম। আল্লাহ তুহিনকে এমন এক চেহারা দিয়েছিলেন দেখলে মনে হয়, ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না। বিড়ালের মতো দুধ খেয়ে মুখ মুছে বসে থাকতে পারে সে। চলনে-বলনে যেকোনো ঘটনায় আমি হতাম আসামি, সে হতো ফেরেশতা।
মা বলতেন, তার ছেলে তুহিনের সঙ্গে আছে। এত ভালো ছেলে, তাহলে তার আর চিন্তার কিছু নেই। এক শুক্রবারে সকালে আমরা কলেজে গিয়ে একটি অনাকাঙ্খিত, ঘাড়ে শয়তান চাপলে যা হয়; তাই করেছিলাম। ছাত্রী মিলনায়তন কক্ষের পাশের ওয়ালে তখন প্রেমেপড়া দুই বন্ধু-বান্ধবীর প্লাস চিহ্ন দিয়ে দুইজনের নাম লিখলাম। ছেলেবেলার সেই ছেলেমানুষী এখন মনে পড়লে হাসিই পায়। বিকালে তারেকের লাল ঘরে যখন আড্ডা দিচ্ছি তখন তারেক ছিল বাইরে। বলে রাখা দরকার বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী খালেদ চৌধুরী আমাদের সঙ্গে এসে ভর্তি হয়েছিল সুনামগঞ্জ কলেজে। ফুফুর বাড়িতে সে থাকতো। ৭৫ উত্তর জেলা ছাত্রলীগের দুঃসময়ের নেতা মারুফ চৌধুরী ও আনু চৌধুরী তার ফুফাতো ভাই।
তারেক ছিল বাসার বাইরে, খালেদকে নিয়ে হুট করে এসেই বললো- আমাদের সাথের বান্ধবীরা কলেজ লেডিস কমনরুমে টেবিল টেনিস খেলছে। এখন গেলে তাদের সঙ্গে খেলতে পারি। আমরা একে তো নাচুইনা বুড়ি, পাইছি আবার ঢোলের বারি। সবার সাইকেল নিয়ে হৈ হৈ রই রই করে ছুটির বিকালে কলেজে ছুটে যাই। ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারের অগ্রজ দুই নেত্রী এক নেতাকে পেয়ে যাই লেডিস কমন রুমের সামনে। কোনো বান্ধবীর অস্তিত্ব নেই। সকালে এখানে আমরা লেখালেখি করেছি তারেক মাঝখানে চক্কর দিতে এসে বুঝে যায়, উনারা তাকে সন্দেহ করেছেন। আমার ও তুহিনদের বুঝতে বাকি থাকে না তারেক আমাদের ফাঁসিয়ে দিল। টেবিল টেনিস দূরে থাক, কোনো বান্ধবীর অস্তিত্ব নেই।
ছাত্র ইউনিয়নের এক সময়ের তুখোড় নেত্রী আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, খবরদার তোমরা এইসব আজেবাজে লেখা লিখবা না। আমরা একসঙ্গে বলে উঠলাম, এসব কি ফালতু কথা বলছেন? আমরা লিখতে যাবো কেন, কি লেখা হয়েছে? ছাত্র ইউনিয়নের অগ্রজ ভাইটি তখন জোরে জোরে পড়ছেন দেয়াল লিখন। কলেজ থেকে ফিরেই আমরা ছাত্রলীগের অগ্রজ নেত্রী পরবর্তীতে ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ছাত্রী মিলনায়তন সম্পাদিক স্মৃতি দীর বাসায় যাই। স্মৃতি দীকে বুঝাতে সক্ষম হই, কে বা কারা দেয়াল লিখন করেছে; এখন ছাত্র ইউনিয়ন এ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে রাজনীতি করতে চাইছে।
কলেজে ছাত্রলীগের যেসব সহকর্মী বোন ছিলেন সবার কাছেই বিষয়টি অবহিত করা হয়। কারণ পরদিন কলেজে এ নিয়ে যে হুলুস্তুল হবে, তা আর বলার অপেক্ষা থাকে না। তুহিন ও সালাম দু’দিনের মধ্যে ভর্তি হবে। এমসি কলেজ থেকে টিসি নিয়ে এসেছে। কলেজ অধ্যক্ষ মহিবুল ইসলাম চৌধুরী তখন বাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রেখে কাজ করেন। তাদের পক্ষে তার গভীর সহানুভূতি। বলে রাখা ভালো, তার এক ভাই পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি (এম এ হক)’র আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিএনপি জামায়াত শাসনামলে ক্রসফায়ারে নিহত হন। নাম তার মোফাখারুল ইসলাম চৌধুরী।
ছাত্র ইউনিয়ন থেকে অধ্যক্ষের কাছে নালিশ করলে কলেজ প্রশাসন এ নিয়ে লু হাওয়া বইয়ে দেয়। কলেজটি বেসরকারি থাকতে অধ্যক্ষ ছিলেন ইতিহাসের আহমদ আলী। এছাড়াও ছোটবেলা থেকে পারিবারিক সম্পর্কে বাঁধা প্রাণবন্ত, ছাত্রবান্ধব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমোদী রসায়নে অধ্যাপক আব্দুর রশীদ, বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক বিভুভূষণ চৌধুরী, ইতিহাসে আব্দুল বারী আমাদের ভীষণ স্নেহ করতেন। অধ্যাপক আব্দুর রশীদের দুই কন্যা সেই সময়ের শহরের সবার স্নেহকুড়ানো মেধাবি ছাত্রী হিসাবে চিকিৎসকই হননি, একমাত্র পুত্র ক্রিকেটার টিপু ব্যাংকার হয়েছে।
বন্ধুদের দাঁড় করিয়ে এই স্যারদের কাছ থেকে টাকা এনে যখন তখন সবাইকে চানাচুর খাওয়াতে পারতাম। বিজ্ঞানের বিপ্রেস দত্ত স্যার ছিলেন অধ্যক্ষের ডান হাত। মরহুম আবদু মিয়া স্যারও প্রিন্সিপালের আস্থাভাজন। অন্যদিকে আমাদের পরিবারগুলোর সাথে সম্পৃক্ত। তার কাজ ছিল পরিবারকে অবহিত করার নামে আমাদের শাসানো, পারিবারিকভাবে কৈফিয়তের মুখে কলেজ ক্যাম্পাসে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ফেলানো। কিন্তু এ নিয়ে কলেজ অধ্যক্ষ বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। তার রক্তচুক্ষু আমাদের দেখতে হয়েছে কলেজের শেষ দিন পর্যন্ত। সেটি ছিল রাজনৈতিক কারণ।
এরিমধ্যে তুহিন ও সালাম বেকায়দায়। তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া তখনো সম্পন্ন হয়নি। বিপ্রেস দত্ত স্যারের পরামর্শে তাদের বলা হয়েছে আমাদের থেকে একটু দূরে থাকতে। পুকুরের ওপাড়ে ছিল সুধীর দার কলেজ ক্যান্টিন। ক্লাস শেষে হয় মিছিল, নয় ক্যান্টিনে গিয়ে চা সিগারেট। সেখানে তুহিনের সঙ্গে কথা হয়, শিক্ষকদের সামনে তুহিন ও সালাম আমাদের চিনে না চিনে না ভাব করে হাঁটে। আমরাও উপভোগ করি। এর মধ্যে বিজ্ঞানাগারের বারান্দায় চায়ের কেটলি বসিয়েছিলেন ধীরা দা। সংগীত পরিবারের সন্তান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আশিষ চৌধুরী ডাকলেন সেখানে চা খেতে। আমি অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আমাদের এক বন্ধু ছাত্রী মিলনায়তন কক্ষের সামনে। সেটি অধ্যক্ষের কার্যালয়ের কাছে। অধ্যক্ষ আমাদের দেখে বেরিয়ে আসলেন। আমাকে আর কাছে পান নি। কিন্তু আমার ওই বন্ধুকে বলে বসলেন, এখানে আসলে লিঙ্গ পরিবর্তন করে আসো। লজ্জ্বায় আমার বন্ধু দৌঁড়ে পালায়। এ নিয়ে হাসাহাসির শেষ নেই...
চলবে...