কালের আয়নায়: পর্ব ৬ ॥ পীর হাবিবুর রহমান
এসএসসি পরীক্ষার সময় সুনামগঞ্জ জেলায় জুবিলী স্কুল হয়ে উঠে প্রধান পরীক্ষা কেন্দ্র। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য একজন শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন গড়ে তোলায়, তার কাছে প্রশাসন নত হবার পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারেনি। বিদায়ের আগে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আশরাফ আহমদ জুবিলী স্কুলের পরীক্ষা কেন্দ্র কেটে দিয়ে যান। আমাদের পরীক্ষা কেন্দ্র হয়ে যায় সতীশ চন্দ্র উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। নিয়তির কি নিষ্ঠুর বিধান! জুবিলী স্কুল বলে আমরা যারা নিজেদের সুপিরিয়র ভাবতাম, একজন আমলার কলমের খোঁচায় বালিকা বিদ্যালয়ের তৎকালীন নবনির্মিত হলুদ ভবনেই পরীক্ষা দিতে বসলাম।
তখন এসএসসি পরীক্ষাই ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ পরীক্ষা। শিক্ষা জীবনে পুলসিরাতের রাস্তা। অভিভাবকরা যেমন উদ্বিগ্ন থাকেন, তেমনি আমরা থাকতাম টেনশনে। এখনকার মতো জিপিএ-৫ মার্কা ফলাফল বেরুত না। মেধা তালিকায় বিভিন্ন বোর্ডে কুড়ি জনের মধ্যে যারা থাকতেন তারাই দেশসেরা মেধাবি। এরপরে বিজ্ঞান বিভাগে হলে প্রথম বিভাগের সঙ্গে কত বিষয়ে স্টার ও লেটারস মার্কস পেলেন তার ওপর নির্ভর করতো তিনি কত মেধাবি। মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ হলে লেটারসহ প্রথম বিভাগ সোনায় সোহাগা। তারপর প্রথম বিভাগ অনেক প্রাপ্তি। দ্বিতীয় বিভাগ মর্যাদার অবস্থান। বিজ্ঞান বিভাগে ২য় বিভাগ পাওয়া মানে ভবিষ্যতে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবার আর সুযোগ নেই। মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগের পথ ধরো।
এসএসসি পরীক্ষার আগে একদিকে পড়ালেখায় নজরবন্দী হয়ে থাকা, অন্যদিকে পড়ার টেবিলে নিয়ম মাফিক ভিআইপি ট্রিটমেন্ট বা বাড়তি খেয়াল পরিবার থেকে পাওয়া যেত। যেমন দফায় দফায় হরেক রকমের নাস্তা, চা ছাড়াও হরলিক্স, দুধ এলাহী ব্যাপার।
পরীক্ষা চলাকালে মধ্যাহ্নের বিরতিতে গালর্স স্কুলের সামনে খাবার নিয়ে অভিভাবকরা বাপটু দার বাসায় হাজির। লুচি, পরোটা, সবজি, সুজি, মাংস হরেক রকমের খাবার। যেন বিশ্বজয় করছি। বাপটু দার মা এক মমতাময়ী নারী ছিলেন। আমাদেরকে সব সময় আদর আপ্যায়নে ঘাটতি রাখেননি। তার এবং আরতী দির হাতের দুধের সন্দেশের স্বাদ আমি পৃথিবীর কোথাও পাইনি। যেমন বন্ধু ইমদাদ রেজার মায়ের হাতের পায়েস অতুলনীয়। এখনো কোনো ঈদে সুনামগঞ্জ থাকলে ঈদের দিন ইমদাদের বাড়িতে হানা দেই পায়েস খেতে। লাজ, নম্র বন্ধু আমার ইমদাদের শক্তির উৎস,তার প্রিয়তমা পত্নী সুন্দরী রমনী কলি ভাবী। আমি তাকে যত পছন্দ করি না কেন, তিনি আমার সঙ্গে ঝগড়া ছাড়া থাকতেই পারেন না। তবে যখনই যাই, এই অতিথিপরায়ণ মহিলা হরেক রকম খাবারে আপ্যায়ন করতে ভুলেন না।
এসএসসি পরীক্ষার পর আমি চারদিকে দিনরাত আড্ডা দিয়ে বেড়াই। ইমদাদের মেজো ভাই দেওয়ান মোকাদ্দেম রেজা আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু হলেও আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। ইমদাদের চাইতে তখন তার সঙ্গেই আমার বেশি সখ্যতা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সেই সময়ের জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং ১৯৭০ এর জাতীয় পরিষদ সদস্য দেওয়ান ওবায়দুর রেজার সন্তান তারা।
দেওয়ান মোকাদ্দেম রেজা সব বয়সের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সৌখিন জ্যোতিষ ছিলেন তিনি। কিছু কিছু ঘটনা কাকতালীয় হয়ে যায়। সেই সময়ে যখন আমি ভাবতাম, রাজনীতি করবো আর পেশাদারিত্বের জায়গায় আইনজীবী হবো; তখন তিনি হাত দেখতে দেখতে বলেছিলেন, তুমি লেখালেখি করে খাবে।
হেসে উড়িয়ে দিলেও সেদিন ভাবিনি, সাংবাদিকতার পেশার তারে জীবন জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করবো আমি। লেখালেখিই হবে আমার প্রথম প্রেম। আমার ভালোবাসা, আমার ইবাদত। অকালে মোকাদ্দেম রেজার মৃত্যু গোটা শহরকে শোকার্তই করেনি। প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল।
আগেই বলেছি, এসএসসি পরীক্ষার পর দিনরাত বোহেমেনিয়ানের মতো অবাধ স্বাধীনতায় আড্ডায় ডুবেছিলাম আমি। পারিবারিক কঠোর অনুশাসনের খড়গ এত তীব্রভাবে নেমে এসেছিল যে, আমার জেদ, আমার অহম এতোটাই ঝাকুনি খেলো যে এক ভোররাতে সবাইকে ঘুমে রেখে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম।তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল বেহাল। রেল যোগোযোগ করুন দশায় পতিত। সিলেট এসে সুরমা মেইলে টিকেট টাকলেও আসন নেই। আসনের জন্য রেল স্টেশনে ট্রেন আসার আগেই চড়তে হতো। আসন না থাকার কারণে বেতের মোড়া কিনে নিয়ে বসার ব্যবস্থা করতে হতো। সারারাত জিমুতে জিমুতে তেজগাঁয়ে এসে নামলাম।
জুনেদ তখন ঢাকায় তার বড় আপার বাসায়। বড় আপার বাসা মিরপুরে। ফার্মগেট থেকে বিআরটিসি বাসে চড়ে তাদের বাসায় যখন গেলাম, তারা মহাখুশি। জুনেদের বড় আপা মুক্তা আপার বড় দারুণ গান গাইতেন। ক্যান্সার তার জীবন কেড়ে নিয়েছে। জুনেদ ও আমি একসঙ্গে চলি, খাই, থাকি, ঘুরে বেড়াই। এদিকে, বাড়িতে সবার অবস্থা বেহাল। পারলে ‘বাবা তুমি ফিরে এসো, তোমাকে কেউ বকবে না’ ইত্তেফাকে এমন বিজ্ঞাপন দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। দিন সাতেক পর আমি ও জুনেদ ইন্দিরা রোডে সাফকাতের বাসায় এসে রাত্রিযাপন ও তুমুল আড্ডায় মহান্দনে জীবনযাপন করতে থাকি। এখানেই আমার এক আত্নীয় দেখা হলে বাড়িতে খবর দিয়ে দেন। তখন আমার বাসার অভিভাবকরা আরো কঠোর হয়ে উঠেন।
পারত পক্ষে খবরই নেন না। এভাবেই দিন যেতে থাকে। এসএসসির ফলাফল যেদিন প্রকাশ হয়, সাতসকালে আমি ও সাফকাত তার বাসা থেকে হাঁটতে হাঁটতে ফার্মগেটের দিকে অগ্রসর হই। তখন পরীক্ষার ফলাফল সংবাদপত্র থেকে জানতে হতো। ভিতরে ভিতরে ঘামছি মহা উত্তেজনায়। জীবনে এই প্রথম ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্ন আমাকে ঘ্রাস করছিল। ফলাফল খারাপ হলে ফার্মগেট ওভারব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে আত্নহননের পথ বেছে নেয়া।
পত্রিকার পাতায় আমি তৃতীয় বিভাগ খুঁজতে থাকি। কিন্তু আমার রোল না পেয়ে হতাশ হতে থাকি। দ্বিতীয় বিভাগে খুঁজতে গিয়ে আমার রোল পেয়ে যাই। মহাআনন্দ আমার। সাফকাত বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল। আমি তো মানবিকের জন্যই জন্ম নিয়েছি। দু’জনেই দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাস করার কারণে শুকরিয়া আদায় করি। আরে লেখাপড়া করলে না হয় রেজাল্টোর বিষয়, লেখাপড়াই করিনি; রাতে রাতে পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিয়েছি। এরচেয়ে ভালো রেজাল্ট আর কি ঝুটতে পারে কপালে।
দীর্ঘদিন ঢাকায় ছিলাম। রমজান মাস পুরোটাই গেলা। ১৯৮১ সালের রমজানের শেষ দিন। বাড়ি থেকে টাকা আসার পর গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে বিআরটিসির বাসে যখন উঠলাম, আমার পাশে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বোন আসন নিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃষ্ণকলী বলায় যায় সেই তরুণীকে। বাস ছাড়ার আগ মুহুর্তে এক তরুণ এসে বললেন, ও আমার ছোটবোন। আপনি একটু খেয়াল করবেন। বাস ছুটে চললো সুনামগঞ্জের দিকে। তখন পথে পথে ফেরি। বর্ষার তুমুল বৃষ্টিপাত। গল্পে গল্পে পথ যাত্রা শুরু হলো আমাদের।
চলবে...