বাঘ বিধবা হন তারা!
এক ফেইসবুক বন্ধুর কাছ থেকে নতুন একটা তথ্য জানলাম । সে জন্য তার প্রতি রইলো কৃতজ্ঞতা। যা আগে আমি কখনও শুনিনি। গণ-মাধ্যমের একজন সামান্য কর্মী হিসেবে নানা খবরের পাশাপাশি সুন্দরবন সংক্রান্ত কত খবরাখবর শুনেছি জেনেছি তার হিসেব নেই। কিন্তু এই বিচিত্র খবর জানলাম কোলকাতার বাসিন্দা বন্ধু উমাশংকর মন্ডলের কাছ থেকে। হয়তো অনেকেই জেনে থাকবেন । আমার দুর্ভাগ্য আমি ব্যাপারটি আগে শুনিনি।
আমার একসময়ের সহকর্মী সাতক্ষীরার সাংবাদিক এড্ দীলিপ দেব ও বাগেরহাটের এহসানুল করিম দু/তিনবার সুন্দরবন থেকে মধু এনে খাইয়েছেন। অথচ সুন্দরবনের মধু আহরন সহ নানা কারণে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবন যাতায়ত করে তাদের জীবনের আরো অধ্যায় যে থাকতে পারে তা আমরা জানি না বা সে খবর আমরা কেউ রাখি না।
সুন্দরবনের আশপাশ এলাকার মেহনতি পুরুষরা নিয়মিত সুন্দরবন গিয়ে থাকেন জীবিকার তাগিদে । এদের অনেকেরই থাকে না সরকারি অনুমতিপত্র । কেউ কেউ নিজের অনুমতি পত্র নিয়ে যায় কেউ অন্যের অনুমতি পত্র দেখিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে।
সাধারণত: এদের মধ্যে বেশির ভাগই একটু কম বয়েসি, অর্থাৎ বিশ থেকে চল্লিশ/পয়তাল্লিশ বছর বয়সের মানুষরা। এদের মধ্যে বিবাহিত অবিবাহিত দু’পক্ষই রয়েছে। কারণ সুন্দরবনে মধু আহরণসহ যে সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে জীবিকা নির্বাহের সেগুলোর জন্য অপেক্ষাকৃত সাহসী ও সবল পুরুষরাই গিয়ে থাকে বেশির ভাগ। তবে সুন্দরবনের আশপাশে মাছ ধরা বা কাঁকড়া ধরায় সব বয়সের নারী পুরুষরাই যুক্ত। আর যারা গহীন জঙ্গলে প্রবেশ করে মাঝে মধ্যেই এদের অনেকেই বাঘের পেটে চলে যায় তার খবরও আমরা পাই না । তার কারণ যাদের সরকারি অনুমতিপত্র থাকে তাদের খবর পাওয়া যায় আর যাদের কোন কাগজপত্র থাকে না তাদের নাম সরকারি তালিকায় আসে না। এরা আবার সরকারি সাহায্য সহযোগিতা থেকেও বঞ্চিত হয়।
কিন্তু সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো যদি কোন বিবাহিত পুরুষ বাঘের পেটে চলে যায় তখন বাড়িতে তার স্ত্রী সন্তানের কি অবস্থা হয় সেটা। যে পুরুষটি বাঘের পেটে যায় তখন তার স্ত্রীর নাম হয় 'বাঘবিধবা' এবং সে নাকি হয় অপয়া হয় অলক্ষী এবং সমাজে তার ঠাঁই হয় না। কি মর্মান্তিক! কি বিচিত্র নিয়ম। বিশেষ করে শশুড় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। যেহেতু অপেক্ষাকৃত কম বয়েসি বিবাহিত লোকরা এসব দু:সাহসী কাজে গিয়ে থাকে সেহেতু তাদের ছেলেপুলেরাও খুব বয়সী থাকে না। ফলে ছোট ছোট সন্তান নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াতে হয় এই বাঘবিধবাদের।
বাঘের পেটে চলে যাওয়া অনুমতিপত্রহীন পুরুষদের স্ত্রী অর্থাৎ বাঘবিধবারা পায় না কোন সরকারি সাহায্য সহযোগিতাও। সমাজচ্যুত হয়ে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিয়ে বাঘবিধবারা নানা ধরণের পেশায় যুক্ত হয়ে তারা তাদের সন্তানদের ভরনপোষনের দায়িত্ব নেয়।
ঐসব এলাকার মানুষরা এখনো মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থার মধ্যে ডুবে আছে। একসময় যখন স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীকেও সহমরণে যেতে হতো সেই নিয়মটা এখনো বহাল অন্যরূপে। যে দুর্বিষহ জীবনে বাঘবিধবারা পতিত হয় তারচেয়ে মৃত্যু অনেক শ্রেয়। তাদের নেই কোন শক্তি প্রতিবাদের , থাকে না কোন উপায় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেয় সমাজের তৈরি আইন।
অথবা বাধবিধবারা বুঝেইনা জীবনের মানে কি, জানেই না জীবনের চাওয়া পাওয়াই বা কি, বুঝে না সংস্কার কি, বুঝে না কুসংস্কার কি? শুধু বুঝে বা বুঝিয়ে দেয়া হয় কিছু করার নেই নিয়তির লিখন তারা অপয়া, অলক্ষী ও স্বামী খেকো নারী। এটা মেনে নিয়েই বাকী জীবন কাটাতে হবে।
কি অদ্ভুত প্রথা স্বামীকে খেলো বাঘে আর অপবাদ নিতে হয় জীবিত স্ত্রীকে। এই একবিংশ শতাব্দিতে দাডিয়েও আমরা এধরণের খবর জানতে হয় এবং জানাতে হয়।