• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলার ৮ম দিনের স্মৃতিচারণ

৮ ডিসেম্বরই চাঁদপুর শত্রুমুক্ত হয়েছিলো : মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের রুস্তম

প্রকাশ:  ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৩:৫৮
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

‘এসো মিলি মুক্তির মোহনায়’-এ স্লোগানকে নিয়ে এ বছর ২৮তম মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার ৮ম দিনে স্মৃতিচারণ পরিষদের ব্যবস্থাপনায় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় মুক্তিযোদ্ধাদের এ স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠিত হয়। বিজয় মেলার স্টিয়ারিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা মহসিন পাঠানের সভাপতিত্বে ও মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব মাস্টারের পরিচালনায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন চাঁদপুরের প্রথম স্বাধীনতা পতাকা উত্তোলণকারী মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের রুস্তম।
তিনি তাঁর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ঢাকা থেকে আমরা চাঁদপুরে আসার জন্যে সদরঘাট এসে কোনো লঞ্চ পাইনি। নদীতে ছিল শুধু লাশ আর লাশ। আমরা হাঁটা শুরু করি। হেঁটে হেঁটে মুন্সিগঞ্জে চলে আসি। সেখানে এসে একটি লঞ্চ দেখতে পেলাম। চাঁদপুরে আসার কথা বলে আমাদেরকে লঞ্চে উঠানো হয়। মতলবের বেলতলী আসার পর লঞ্চটি আর চাঁদপুরের দিকে এগোতে চায়নি। পরে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে গ্রামের বাড়ি চলে আসি। পা গুলো ফুলে গেছে। যুদ্ধের জন্যে ট্রেনিং আমাদের প্রয়োজন ছিল। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল ভারতের দিকে রওনা হই। কাঠালিয়া গিয়া পৌঁছাই। ২/৩টি চাল বোঝাই ট্রাক পেয়ে যাই। চালককে বহু অনুরোধ করে ওই ট্রাকে চরে আমরা আগরতলায় চলে যাই। রাত ১০টায় সোনামুড়া গিয়ে পৌঁছাই। সেখানে গোমতি নদীর বেড়িবাঁধের উপর দাঁড়িয়ে থাকি আমি ও ভাগিনা। সোনামুড়া ফকির বাড়িতে হালকায়ে জিকির হচ্ছে। আমরা দুজন সেখানে যাই। জিকিরের পর আমাদেরকে খিচুড়ি খেতে দেয়া হলো। সবাই চলে যায়। আমরা দু’জন ওই বাড়িতে একটি ঘর ম্যানেজ করে খরকুটা পেতে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন সকালে সোনামুড়া বাজারে গিয়ে চা বিস্কুট খাই। আর খুঁজতে লাগলাম আমাদের এলাকার কোনো নেতা আছে কিনা। তখন জানতে পারি কুমিল্লার আফজাল খান ও বরুড়ার হাকিম সাহেব আছেন। তারা আগরতলা কলেজ হোস্টেলে যায়। সেখানে মনি ভাই ও রাজ্জাক ভাই আসলেন। বিকেলে মনি ভাইয়ের সাথে কথা হলো। মনি ভাই আমাদেরকে গাড়িযোগে নিয়ে নামিয়ে দেয়। আমরা ১৫ জন ট্রেনিংয়ের জন্য প্রস্তুত। মনিভাই আবারও গাড়িযোগে আমাদেরকে ভারতীয় এয়ারপোর্টে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমরা প্লেনে করে দেরাদোনের সাহরাইনপুর নিয়ে যায়। সেখানে বাবর, মমিন খান মাখনসহ আরও অনেকে ছিল। তখন আমাদেরকে সেখানে ট্রেনিং দেয়া হয়। ট্রেনিং শেষে নিয়ে আসা হয় আগরতলায়। সাত দিন সেখানে বসে থাকি। ২৬ জুলাই অস্ত্র নিয়ে দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। চৌদ্দ গ্রাম এসে পায়ে হেঁটে রওনা দিয়ে আমরা সরাসরি হাইমচরে চলে আসি। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে বেশ কিছু যুদ্ধ করেছি। নভেম্বরের প্রথমদিকে ফরিদগঞ্জে থাকা পাকিস্তানিদের অবরুদ্ধ করে ফেলি। রাজাকার ও পাকিস্তানি আর্মিরা রওনা দেয় চান্দ্রা বাজার অ্যাটাক করার জন্য। শেষ পর্যন্ত গাজীপুর গিয়ে পশ্চিমে রওনা দেয় তারা। আমরা পশ্চিম দিকের সড়কের পাশে অবস্থান করি। দেখা যায় চরে পাকিস্তানি জাহাজ আটকা পড়ে। নৌকা বেয়ে রাত ৯টায় গিয়ে দেখি ওই জাহাজে কয়েকজন আর্মি মারা গেছে। কেউ আহত হয়ে পড়ে আছে। ওই জাহাজটিকে আমাদের আয়ত্বে নিয়ে আসি। সেখান থেকে অস্ত্র নামিয়ে রাতের মধ্যেই হাইমচরে পাঠিয়ে দেই। বিএলএফ কমান্ডার হানিফ পাটওয়ারী পরদিন সকালে হাইমচর গিয়ে গুলি ও গোলাবারুদ নিয়ে আবার ফরিদগঞ্জে  চলে যান। ডিসেম্বরের ৭ তারিখ আমরা ফরক্কাবাদ স্কুল মাঠে আমাদের ক্যাম্পে অবস্থান করি। খবর পাই পাকিস্তানিরা চাঁদপুর ছেড়ে পালাচ্ছে। আমরা চাঁদপুরের দিকে রওনা দেই। ইচলী ঘাটে অবস্থান করে ব্যাংকার করি। রাত ৩টায় কয়েকটা নৌকা নিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কাছে সন্দেহ হলে আমরা তাদেরকে আটক করি। ভোর ৬টায় আমরা ৬০জন মুক্তিযোদ্ধা ৩টি গ্রুপে ভাগ হয়ে যাই। সকাল ৭টায় কালীবাড়ি মোড়ে অবস্থান করি। তখন সেখানে কারফিউ জারী করে সবাইকে চলে যেতে বলি। তখন চাঁদপুরের এসডিও ছিল মোহাম্মদ আলী। মুক্তিযোদ্ধারা বাহিনী নিয়ে চাঁদপুরে প্রবেশ করে। আমি এসডিও মোহাম্মদ আলীর সাথে গিয়ে তার অফিসে যাই। সেখানে গিয়ে পাকিস্তানিদের ছবি দেখে ২টি ছবিতে গুলি করি। আমি সকাল ১১টায় থানার সামনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে চাঁদপুরকে শত্রু মুক্ত হয়েছে বলে ঘোষণা দেই। তখন এসডিও মোহাম্মদ আলীর কাছে টেলিফোন আসে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষ থেকে। আমরা দেরাদামে প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ নেই। পাকিস্তানিদের গানবোর্ড চাঁদপুরের নদী পথে যাচ্ছে। মোহনপুরের কাছে একটি গানবোর্ড আমরা ডুবিয়ে দেই। ৯ তারিখ সকাল বেলা ঢাকা যাওয়ার জন্যে পাকিস্তানিরা ইচলী ঘাটে বাংকার করে অবস্থান নেয়। এ খবর জানতে পেরে আমরা তাদেরকে সারেন্ডার করার জন্য এগিয়ে যাই। তারা সারেন্ডার করে। তাদের নিয়ে আসি টেকনিক্যাল স্কুলের ইন্ডিয়ান ক্যাম্পে। তারা সংখ্যায় ছিল ৩শ’ ১৩ জন। এর মধ্যে রাজাকার ছিলো ১৯ জন। তাদেরকে আমি ভারতীয় সেনাদের কাছ থেকে নিয়ে আসি। পরবর্তীতে বড় স্টেশন মোলহেডে এই স্বাধীনতার শত্রুদেরকে হত্যা করি।
এই স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাহিত্য একাডেমির মহাপরিচালক রোটাঃ কাজী শাহাদাত, সাঁতারু সানাউল্লাহ খান। উপস্থিত ছিলেন বিএলএফ কমান্ডার হানিফ পাটওয়ারী, মুক্তিযোদ্ধা অজিত সাহাসহ আরও অনেকে।

 

সর্বাধিক পঠিত