কবিতা ও চিত্রকলা
সৌম্য সালেক
(এক)
দৃশ্য, পাঠ এবং অভিজ্ঞতা থেকে অনুভূতি সৃষ্টি হয় আর অনুভূতির নন্দিত প্রকাশই শিল্প, সেটা কাব্য কিংবা চিত্র যে মাধ্যমেই হোক না কেন। জীবনকে স্পর্শ করেই শিল্পের উদ্ভব। শিল্পের ইতিহাসের সাথে তাই মানুষের আবর্তকালের সংগ্রাম ও সম্প্রীতির কথকতা উঠে আসে। প্রাগৈতিহাসিক কালের যে স্বল্প ঘটনা ও দৃশ্য আমাদের সামনে প্রকাশিত সেখানে দেখা যায়, একটি অতিকায় বাইসনকে হত্যার সামর্থ অর্জনের জন্য সে গুহাগাত্রে আগেই একটা শরাহত বাইসনকে এঁকে ফেলেছে। আমরা স্পেনের আলতামিরা গুহাগাত্রের চিত্র দেখে সেই জীবন ও শিল্পস্ফূর্তিকে অনুধাবন করতে পারি। সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবন প্রক্রিয়া, পরিপার্শ্ব ও চিন্তাপ্রবাহ বদলে গেছে, সেই সাথে মানুষের দৃষ্টির তীক্ষ্মতাও হয়তবা লোপ পেয়েছে। এ বিষয়ে সৈয়দ আলী আহসান-এর মন্তব্যেও খেদ ধ্বনিত : ‘অপরিজ্ঞাত মানুষ এগুলো এঁকেছিলো কালের সুচিহ্নিত পদপাতের পূর্বে। তাই মনে হয় সভ্যতার উপকরণের অযাচিত বৈচিত্র্যে মানুষ তার দৃষ্টির তীক্ষ্মতা হারিয়েছে। অতীতকালের মানুষের দৃষ্টিগত প্রতিক্রিয়ার নিকটেই সে পৌঁছুতে পারে না।’
কবিতা ও চিত্রকলা কিংবা কবি ও শিল্পীর পারস্পরিক সম্পর্ক ও সাযুজ্যের ইতিহাস অত্যন্ত সুপ্রাচীন। কবিতার মাধ্যম শব্দ এবং চিত্রের উপকরণ রং। দুটো মাধ্যমেই অতীব নৈর্ব্যক্তিকতায় অনুভূতি ও চেতনার নিবিড় অভিনিবেশ ঘটে। কবির দৃষ্টিবদ্ধ চিত্রকল্প প্রকাশ পায় কবিতায় আর শিল্পীর দেখা চিত্ররূপ ফুটে ওঠে ক্যানভাসে। দুই মাধ্যমেরই চিত্রভাষ্য রয়েছে এবং রয়েছে দৃশ্যপট ও শিল্পশৈলীর প্রতিপাদন । কবির অনুভূতির রূপার্ন্ত ঘটে শব্দে এবং শিল্পীর অনুভূতির প্রকাশ ঘটে ছবিতে। পিকাসো বলেছিলেন, ‘কবিতা শিল্পকলারই পরিপূরক। যে কথা রঙে বলা যায় না, সেটা ভাষার অক্ষরে বলা সম্ভব।’
বৃহৎ জগৎ-মঞ্চে নিজের অস্তিত্বের তুচ্ছতাকে অনুভব করে যখন জীবনের আর কোন মানে খুঁজে পাচ্ছেন না, তখন ছেনি হাতুড়ির বদলে মাইকেলেঞ্জেলো হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন এবং লিখেছেন গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা। রফি হক-এর ‘কবিতা ও ছবিতা : কবি ও শিল্পী’ শীর্ষক রচনা থেকে এখানে দু’ছত্র মাইকেলেঞ্জেলোর কাব্যানুবাদ তুলে ধরছি : ‘আর এই শোচনীয় সময়ে কেবল তোমার মুখই/আমাকে জোগায় আলো-ছায়াÑঠিক সুর্যের মতো।’
কবিতার মধ্যে শব্দের আড়ালে কবি তার বক্তব্য এবং কল্পরূপকে মূর্ত করতে চান কিন্তু ভাষা কবির উপাদান নয় বরং সংকেতমাত্র। এর একটি বড় দৃষ্টান্ত মান্দারিন, জাপানিসহ কিছু প্রচিলিত ভাষা, যেগুলো সাংকেতিকতার স্পষ্ট নমুনা। অপরদিকে চিত্রের মধ্যে প্রচ্ছন্নতা ও আড়াল থাকলেও এর বর্ণরূপ এবং ভাবরূপ একরৈখিক। এখানে আলাউদ্দিন আল আজাদ-এর ‘সাহিত্য ও অন্যান্য শিল্পকলা’ প্রবন্ধ থেকে কিঞ্চিত তুলে ধরছি : ‘ভাষাশিল্প হরফের চাক্ষুষরূপে মুদ্রিত থাকলেও সে নির্মাত্রিক কারণ হরফটা তার উপাদান নয়, উপাদানের সাংকেতিকরণ মাত্র।। উপাদান মানুষ, প্রকৃতি, কল্পনা বা এসবের বিমিশ্রাণ। যে আপন স্বভাবেই বস্তু ও ভাবনার ধ্বনিপ্রতীক, কবির মানস-বাহন হয়ে সে নতুন নতুন চিত্রকল্প ও প্রতীকের জগৎ সৃষ্টিতে তৎপর।’ ভাষা আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কারুপণ্য আবার ইচ্ছাশক্তির সরল প্রকাশ মাধ্যমও। রঙ্রে মাধ্যমে প্রকাশ পায় মানুষের বাহ্যিক ও অন্তরীণ অবস্থার দৃশ্যপট, চিত্রের বস্তুজগৎ সেই অবস্থারই কল্পলোক।
চিত্রের সাথে শব্দ ও কাব্যের সমন্বিত শিল্প প্রয়াসও শিল্পকলায় বহুভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। এমনটি ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। শব্দ ও পংক্তির সাথে চিত্র সম্পর্কিত হয়ে জীবনের বিবিধ ব্যঞ্জনাকে মূর্ত করেছে। সেসব শিল্পীদের ধারণা ছিলো, শব্দের একটি যাদুকরী সম্মোহন আছে এবং এটিকে উদ্ভাসিত করার প্রত্যয়ে শিল্পীরা তাদের ক্যানভাসে একইসাথে চিত্র, বর্ণ, শব্দ, বাক্য ও রেখা এঁকেছেন। বর্ণ তথা হরফের শৈল্পিক প্রয়োগ থেকে লিপিবিদ্যার (ঈধষষরমৎধঢ়যু) উদ্ভব ঘটেছে।। হস্তশৈলীর এই নৈপুণ্যে একই সমবায়ে অত্যন্ত নান্দনিক ব্যঞ্জনায়, ভাব ও দৃশ্যরূপ দুটোই মানুষের প্রদর্শন করে। আরবি হরফ থেকে লিপিবিদ্যার উদ্ভব হলেও এই চর্চা ফার্সিসহ বিভিন্ন ভাষার মধ্যেও বিদ্যমান রয়েছে।
(দুই)
চিত্র ও কাব্য দুটো আলাদা শিল্প-মাধ্যম, দুটোর আবেশ ও ইমেজ ভিন্ন। একটি মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে রূপান্তরের ফলে পরিচিতি বিস্তৃত হলেও শিল্পমান যে ক্ষুণœ হবে না তা নয়, কেননা প্রতিটি মহৎ শিল্পই প্রথম ও প্রকৃত মাধ্যমেই মহিমাপূর্ণ। ভাষাগত বর্ণনা একধরণের গতি নিয়ে আসে। সেটা অন্য মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্ততা হারাবে। এখানে শিল্প-সমালোচক আবুল মনসুর-এর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, ‘চিত্রকলা বস্তুর একটি সরাসরি রূপ ব্যক্ত করে যা নির্দিষ্ট ও আবদ্ধ, সেখানে কল্পনা বিস্তারের অবকাশ কম।’ তিনি একটি কবিতাংশের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘‘মোহাম্মদ রফিক যখন বলেন : ‘এইভাবে ভিজে ভিজে কীর্তিনাশা কত দূর যাবে?
এই দেশে কি শেষ আছে বৃষ্টি ও মেঘের?
সারাপিঠে এখনো চুলের ঢেউ ভিজে ছপছপ
শীতার্ত বর্ষার ফলা বিঁধে ফেলে সমস্ত শরীর।’ তখন যে মর্মভেদী সর্বগ্রাসী আবহ সৃষ্টি হয় সেটিকে টলটলে নদী ও নৌকার দৃশ্যমানতার মধ্যে ধরতে চাইলে তা অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর হবে।” আবার অপরদিকে এটিও বলা যায় ‘সানফ্লাওয়ার’- চিত্রকর্মের মধ্যে ভ্যান গঘ রঙ্রে যে ব্যঞ্জনা দেখিয়েছে তা একটি পুষ্পবাগের চেয়ে বেশি কিছু, কাব্যভাষায় একে ধারণ করা সম্ভব নয়। চিত্রের মধ্যে বস্তুর রূপ প্রত্যক্ষ থাকলেও কিংবা এর বিভা নির্দিষ্ট ফ্রেমাবদ্ধ থাকলেও একটি দিকে কাব্যের থেকে চিত্রের প্রসার ও আন্তর্জাতিকতা বেশি। সেটি হচ্ছে পৃথিবীর সকল শিল্পী কেবল রং নিয়েই কাজ করেন কিন্তু পৃথিবীর সকল কবি পঙ্ক্তি রচনা করলেও সবার ভাষা এক নয়। ফলে কবিতা বিভিন্ন দেশে অনুবাদের মাধ্যমে পৌঁছে এতে যে কবিতার বাক্প্রবাহ, ছন্দ, ভাব ও ব্যঞ্জনা ক্ষুণœ হয় এ বিষয়ে সবাই অবগত। মূল চিত্রকর্মটি সব দেশে না পৌঁছালেও কিন্তু এর হুবহু ইমেজ পৃথিবীর যে কোনও শিল্পরসিক অবলোকন করতে পারেন। এটি চিত্রকলার আন্তর্জাতিকতার বড় কারণ।
কাব্যের সাথে চিত্রের ঘনিষ্ঠতা অন্য যে কোনও শিল্পমাধ্যমের চেয়ে নিকটবর্তী। এজন্য দেখা যায় গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকর্ম নিয়ে যেমন কবিরা কবিতা লিখেছেন, আবার মহৎ কবিতা থেকেও শিল্পীরা চিত্র এঁকেছেন। চিত্রকর্মের উদ্দিপনা থেকে অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে; তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু চিত্রকর্ম হচ্ছে : প্রিমাভেরাÑ বতিচেল্লি, ওফেলিয়াÑ জন উইলিয়াম ওয়াটারহাউজ, গুয়ের্নিকাÑপাবলো পিকাসো, মোনালিসাÑ দ্যা ভিঞ্জি এবং ওয়াটার লিলিজÑ ক্লদ মনে। কবিতা অবলম্বনেও বহু ছবি অঙ্কিত হয়েছে। বতিচেল্লি, দান্তের ডিভাইন কমেডির দৃশ্য অংকন করেছেন। দেলাক্রোয়া’র বহু বিখ্যাত ছবিÑদান্তে, গ্যাটে, বাইরন ও শেক্সপিয়ারসহ বিভিন্ন কবির কবিতা দ্বারা অনুপ্রাণিত। তবে পাবলো পিকাসোর মতো এত ব্যাপকভাবে অন্য কোনও শিল্পী কবিতার সঙ্গী ছিলেন না। মাক্স জ্যাকব ও অ্যাপোলিনেয়র ছাড়াও পিকাসো চিত্রিত করেছেনÑপল এল্যুয়ার, পিয়ের রেভার্ডি, বালজাক ও নেরুদার কবিতা। এখানে উল্লেখ্য যে, কোনো মৌলিক কবিতা কিংবা চিত্রকর্মে সাধারণত সরাসরি রেফারেন্স ব্যবহার হয় না। এর একটি সার্থক দৃষ্টান্ত পিকাসোরÑগুয়ের্নিকা। পিকাসো যখন ছবিটি আঁকেন তখন পত্রিকার পাতায় পাতায় গুয়ের্নিকা শহরের ধ্বংসাবশেষ ও মৃতদের ছবি ছাপা হচ্ছে। কিন্তু পিকাসো তাঁর ছবিতে একবারও প্রকৃত ঘটনার আভাস আনেননি বরং ব্যবহার করছেন পৌরাণিক প্রতীক। এভাবে শিল্পীর প্রত্যক্ষণের স্বাধীনতাকে তিনি সমুন্নত রেখেছেন। কবিতায় ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রায় অনুরূপ।
আমরা কাজী নজরুল ইসলামের- ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কিংবা জীবনানন্দ দাসের ‘ইতিহাসযান’ কবিতায় কোন বিশেষ ঘটনাপ্রবাহ বা সূত্রের প্রয়োগ দেখাবো না কিন্তু দুটো কবিতার মধ্যেই বিচিত্র অনুষঙ্গের প্রয়োগ ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণপ্রবাহে মানুষের জাগরণ ও অন্তর্দীপ্তিকে অত্যন্ত চেতনা-ঋদ্ধ ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে। একটি উন্নত পানপাত্রে অঙ্কিত প্রেমিক যুগলের নিবিড় মুহূর্তের দৃশ্য দেখে উদ্দিপ্ত রোমেন্টিক কবি জন কিট্স লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত : ঙফব ঙহ ধ এৎবপরধহ টৎহ কবিতাটি । শিল্পই কেবল অক্ষুণœভাবে তার সৌন্দর্য ও সম-অবস্থানকে ধরে রাখতে পারে, এমন ভাব প্রকাশপূর্বক তিনি কবিতাটির শেষে উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর অত্যন্ত নন্দিত পংক্তিমালা :
ইবধঁঃু রং ঃৎঁঃয, ঃৎঁঃয নবধঁঃু
ঃযধঃ রং ধষষ ুব শহড়ি ড়হ বধৎঃয
ধহফ ধষষ ুব হববফ ঃড় শহড়.ি
চিত্রকর্ম থেকে অনুপ্রাণিত কবিতার এমন অনেক উদাহারণ রয়েছে। নিজস্ব সক্ষমতা বলে মহৎ কবি এবং শিল্পীগণ রূপান্তরের মাধ্যমেও নতুন রূপের নতুন ভাষ্যের কবিতা ও চিত্র তৈরি করতে পারেন।
কবি ও চিত্রশিল্পী উইলিয়াম ব্লেক কবিতা ও চিত্রের মধ্যে ঐক্যের অভিনব সংযোগ ঘটিয়ে এদুটো শিল্প মাধ্যমের অভিন্নতাকে উপস্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। পৃথিবীর বহু কবি, চিত্রের ক্ষেত্রেও বেশ সাফল্য দেখিয়েছেন। আমরা বলতে পারি কবি কাহলিল জিব্রানের কথা; কী অপূর্ব ভাব-ব্যঞ্জণায় তিনি কবিতার সাথে চিত্রের সাযুজ্যতা দেখিয়েছেন; যা বিশ্বনন্দিত। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপ-মহাদেশে আধুনিক চিত্র চর্চাকারীগণের মধ্যে বিশেষ তাৎপর্যমন্ডিত। শিল্পী পল ক্লী, চিত্র ও কবিতা, দুটোর মধ্যেই ভাবের তীব্রবাহনে প্রাণবন্ত, এখানে তাঁর কয়েকছত্র উপস্থাপন করছি :
‘যেহেতু আমি চলে গেলাম, অন্ধকার নামলো
আলোকে আবরিত করে নামল মেঘের কুয়াশা।
যেহেতু আমি চলে গেলাম
অন্ধকারে কিছুই ছায়া ফেলতে পারলো না
রূপার মতো চকচকে ফলবান
বৃক্ষের শাখায়Ñএখানে অকস্মাৎ কাঁটা।’
কবিতা ও চিত্র-চর্চার অন্যতম পীঠস্থান প্যারিস। প্যারিসের পটভূমিকায় রচিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’, গ্রন্থে আমরা উল্লেখ পাই চিত্রকর্ম ও কবিতার ঘনিষ্ঠতা, সমন্বয় ও সাযুজ্যতার বেশ কিছু দৃষ্টান্ত। সেখানকার দৃশ্যপট ও কৃষ্টি কীভাবে চিত্র ও কাব্যকে প্রভাবিত করছে তা প্রকাশে গ্রন্থকার বেশ সযতœ ছিলেন। পৃথিবীর অধিকাংশ শিল্প-দর্শন ও মতবাদ আগে চিত্রকলায় এসেছে এবং পরবর্তীতে কবিতা হয়ে অন্যান্য শিল্পমাধ্যমে ছড়িয়েছে। সুরিয়ালিজম, সুফিজম-সহ কিছু মতবাদ কবিতা থেকেও চিত্রকলা এবং কথাশিল্পে প্রবেশ করেছ।
শিল্পদর্শনের প্রকাশ ও উচ্চ-শিল্পের (যরময-ধৎঃ) অধিযাত্রায় চিত্রকলা এবং কবিতার অবস্থান উচ্চমার্গে। কবিতাগ্রন্থের প্রচ্ছদ, সজ্জা ও অলঙ্করণে দীর্ঘকাল থেকে চিত্রকর্মের ব্যবহার প্রায় অনিবার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে ‘সচিত্র কাব্য সংকলন’ তথা চিত্রের পাশাপাশি কবিতাপত্রস্থ গ্রন্থের বেশ প্রচলন রয়েছে। এখানে তেমন একটি সংকলনের কথা বলতে চাই। ‘আর্ট অ্যান্ড লাভ, অ্যান ইলাসট্রেটেড অ্যানথলজি’-শীর্ষক গ্রন্থটি কবি কেট ফ্যারেল এর ভূমিকাসহ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত হয়। জনপ্রিয় এই সংকলনটিতে গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে কবিতা ও চিত্রকে পাশাপাশি উপস্থাপন করা হয় এবং এতে বিখ্যাত কবি ও চিত্রিদের পাশাপাশি কিছু অচেনা কবি ও শিল্পীর কর্মও ঠাঁই পায়। বিখ্যাত অনুবাদক কবির চৌধুরী গ্রন্থটির কিছু অংশ ‘সচিত্র প্রেমের কবিতা’ শীর্ষনামে বাংলায় রূপান্তর করেছিলেন।
কবির সৃজিত কল্পলোকে গমনাগমনের প্রয়োজনে কাব্যপ্রেমীকে কিছু বোধ-বুদ্ধির আশ্রয় নিতে হয়, সেখানে আপনাতে শিল্পসুধা পরিবেশিত হয় না। চিত্রে, একজন পিয়াসু সাধারণ দেখাতেই একটা ইমেজ খুঁজে পান, তবে সুদূর শিল্পনন্দনে অবগাহনের প্রয়োজনে একজন শিল্পপ্রেমীকেও যথেষ্ঠ সতর্ক ও সজ্ঞান হতে হয়। নানা অভূত, অচিন্ত্য অনুভূতি ও অভিঘাতে আমাদের মন আলোড়িত কিংবা উত্তেজিত হয় যার প্রকৃত দৃশ্যরূপ বস্তুবিশ্বে দুর্লভ; শিল্পের দুর্বোধ্যতা ও বিমূর্ততার প্রশ্নটি সেখানে সন্ধান করলে শিল্প সংক্রান্ত কিছু উত্তর সহজে মিলে যায়। যুদ্ধ ও যন্ত্রের পৃথিবীতে জীবন যেখানে নিয়ত আক্রান্ত ধ্বস্ত-বিহ্বল সেখানে শিল্পের সারল্য করুণভাবে নিমজ্জিত। সেখানে ঠোঁটের স্থলে নখ, পিঠের স্থলে স্তন যে পুঁজি ও পদ্ধতির জান্তবতাকে প্রকাশ করে, সেই বোধ কবি ও শিল্পীর জন্য বড় মর্মপীড়ার, আমাদের উপলব্ধি তাকে মূর্ত করুক। কবিতা ও চিত্র কেবল যা আছে তারই রূপায়ন নয় বরং যা বোধিত এবং মানবিক ও সুন্দর হবে বলে কল্পিত, সেই ভাব ও চেতনার দৃশ্যকল্প। সুন্দরের স্পর্শ পেয়ে আরও সুন্দর হতে যারা প্রাণপণ, কবি ও শিল্পীগণ সেই পিয়াসুদলের প্রতিনিধি ।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।