• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

একটি খোয়াবের কথা

প্রকাশ:  ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৪:৩২
কবির হোসেন মিজি
প্রিন্ট

লোকটা কেমন নিষ্ঠুরের মতো দশ বছর বয়সী শিশুটিকে গাছের সাথে টানিয়ে এক এক করে শরীর থেকে চামড়া আলাদা করছে। প্রথমে ডান হাত কাটতেই শিশুটির আত্মচিৎকারে আকাশ-মাটি সব একাকার হয়ে যাচ্ছে। তারপর বাম হাত, ডান পা এবং বাম পাটি কাটা হলো তবুও শিশুটির দেহ থেকে প্রাণ আলাদা হয়নি। তখনো সে মা-মা... বলে চিৎকার করছে। লোকটি এক এক করে শিশুটির শরীর থেকে বিভিন্ন অঙ্গ-পতঙ্গ আলাদা করার পর যখন তার গলায় ছুরি ঠেকালো তখন আর শিশুটির কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। সে শুধু নিষ্ঠুর লোকটির দিকে মায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো যেনো নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। অস্পষ্ট সুরে পাষাণ লোকটির উদ্দেশ্যে শুধু একবার বললো-অমাকে একটু পানি দেবেন?
লোকটি ছোট্ট একটি পাত্র নিয়ে রাস্তার পাশে থাকা একটি ডোবা থেকে তাকে কয়েক ফোঁটা পানি দিয়ে গলায় ছুরি চালাতে লাগলো। শিশুটির দেহ থেকে মু-ুটা টপ করে মাটিতে পড়তেই, না বাবা, না বলে চিৎকার করে উঠে রহমত উল্লাহ। শোয়া থেকে বিছানায় উঠে বসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী যেনো খুঁজতে লাগলো। হাত বাড়িয়ে বাতির সুইচ অন করে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত প্রায় দুটোর কাছাকাছি। রহমত উল্লাহ মনে মনে দোয়া দরূদ শরীফ পড়তে লাগলো। এ কেমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলো সে। বুকের ভেতরটা কেমন ধরপর করছে। মু-ু কাটা ছেলেটি কে? আর লোকটিইবা কেনো এমন জানোয়ারের মতো শিশুটিকে হত্যা করলো? নানান কিছু ভাবতে থাকে রহমত উল্লাহ। ঘুমের ঘরে একা একাই আবল-তাবল বকতে লাগলো। সকাল হতেই রাতের এমন অদ্ভুত স্বপ্নটি নিয়ে সে আবারো ভাবতে লাগলো। কাজে-কর্মে ঠিকমতো মন বসছে না। চিন্তিত হয়ে মনে মনে ভাবছে একি আশ্চর্য ধরনের স্বপ্ন দেখলাম আমি?
রহমত উল্লাহ বিগত সাতবছর হলো বিয়ে করেছে। তার ঘরে ও পাঁচবছর বয়সী একটা মেয়ে আছে। খুব পাকনা পাকনা কথা বলে। মেয়ের কথা শুনে খুশিতে বুকভরে যায়। প্রথম যখন তার স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার কথা শুনলো রহমত উল্লাহ, তখন তার আনন্দ যেনো মনে ধরছিলো না। বাবা হওয়ার আনন্দে স্ত্রীর প্রতি অনেক যতœবান হতে লাগলো। তারপর কয়েক মাস পেরুতেই ছেলে নাকি মেয়ে সন্তান হবে তা নিয়ে কৌতূহল জাগলো তার মনে। রহমত উল্লাহ বিয়ের আগে থেকেই তার সংসারজীবনে প্রথম ছেলে সন্তানের আশা করছিলেন। কিন্তু বিধাতার লিখন কেউ মুছতে পারে না। কন্যা সন্তান হওয়ার পর তার সে আশা ভঙ্গ হয়ে যায়। কন্যা সন্তান হওয়ায় প্রথমে তার ভীষণ মন খারাপ হলে ও যখন নিষ্পাপ শিশুটিকে তার সামনে আনা হলো তখন তার চাহনিতে যেনো পৃথিবীর সব কিছু ভুলে যায় রহমত উল্লাহ। সেই থেকে সে ছেলে সন্তানের কথা ভুলে কন্যা সন্তানকেই ভালোবাসতে লাগলো। সন্তানের প্রতি অসীম ভালোবাসায় তার নাম রাখলো স্নেহা।
কাল রাতের এমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে বার বার তার ¯েœহার কথা মনে পড়ছে। বহুদিন হয় দেখেনি তার সেই নিষ্পাপ ফুলের মন ভোলানো হাসি। কতদিন হয় তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার মুখে চুমু খাওয়া হয়নি। তাকে দেখতে আজ খুব ইচ্ছে করছে। ¯েœহার কথা মনে পড়তেই সবকিছু রেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
দীর্ঘ ছয়মাস পরে বাবাকে কাছে পেয়ে রহমত উল্লাহর কোলজুড়ে বসে ¯েœহা। বাবার কপালে, ঠোঁটে, মুখে চুমু খেতে খেতে আধো আধো স্পষ্ট কণ্ঠে বলে-আব্বু তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? তুমি কি আমার কথা ভুলে গেছো? তুমি আমারে অনেকগুলো মজা কিনে দিবে। মেয়ের কথা শুনে রহমত উল্লাহ স্ত্রী নাইমা বেগমকে ডাকলোÑএই তোমার মেয়ে দেখছি ভালোই কথা বলতে শিখেছে। ওর জন্যে কিছু খাবার এনেছি ব্যাগে রাখা আছে জলদি দাও। নাঈমা বেগম ব্যাগ থেকে খাবার আনতে গেলো। খাবারের কথা শুনে ¯েœহা বাবার কপালে চুমু খেতে খেতে আবারো অস্পষ্ট স্বরে বলতে লাগলো আব্বু তুমি অনেক ভালো, আম্মু পঁচা। তুমি আমাকে রেখে আবার চলে যাবে? তুমি চলে গেলে আমি কাঁদবো, তুমি যাবে না। মেয়ের কথায় পরাণ ভরে যায় রহমত উল্লাহর। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনাবরত আদর করতে লাগলো। তারপর সারাদিন মেয়েকে নিয়ে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানো শেষে বাড়ির পথ ধরে হাঁটতে লাগলো।
দেখতে দেখতে তিনদিন কেটে গেছে। আর এ তিন রাতেও সেই ভয়ঙ্কর স্বপ্নের কথা ভুলেনি রহমত। ঘুমের ঘরে যখন সে স্বপ্নের কথা মনে হয় তখন যেনো সেকি হারানোর ভয়ে ছটপট করতে থাকে। বিছানা থেকে উঠে বসে প্রাণপ্রিয় মেয়ে ¯েœহার মুখের দিখে তাকিয়ে থাকে। আজ রাতেও স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই বিছানা থেকে উঠে বসে মেয়ের মুখের দিকে অধীরে তাকিয়ে আছে। হাত দিয়ে মুখের ওপর আদরের পরশ বুলিয়ে চুমু খেতেই স্ত্রী নাঈমা বেগম সজাগ হয়ে বলে, তুমি কি পাগল নাকি ঘুমের মধ্যে বাচ্চাদের চুমু খেতে নেই। তাহলে সে সন্তান অনেক রাগী হয়। রাত অনেক হয়েছে তুমি ঘুমাওনি? না ঘুম আসছে না। কেনো কি হয়েছে তোমার? কাল চলে যাবো তো তাই তোমাদের ছেড়ে যেতে কেনো জানি মন চাইছে না। তোমার কথা শুনে মনে হয় তুমি আমার কাছে কিছু একটা লুকাচ্ছো, খুলে বলোতো কী হয়েছে তোমার? না কিছুই হয়নি। ঘুমিয়ে পড়ো।
ব্যস্ত শহরের অলিতে-গলিতে হাজারো মানুষের কোলাহল। মানুষের ভিড় ঠেলে রাস্তার ফুটপাতের পথ ধরে হাঁটছে রহমত উল্লাহ। শহরের কোলাহলের দিকে কোনো ধ্যান নেই তার। শহরে পা রাখলেও তার মনটা পড়ে আছে সেই আপন ঠিকানায়। যেখানে তার বুকের ধন রয়েছে। শহরের এ পরিবেশে পা রাখার পর থেকেই ¯েœহার কথা তার ভীষণ মনে পড়ছে। মনে পড়ছে সেদিনের সেই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা।
কর্মব্যস্ততা শেষে রাতে ঘুমোতে যাবার আগে স্ত্রী নাঈমার সাথে কথা বলার জন্যে মোবাইলের বাটন চাপলো। কি খবর তোমার, কেমন আছো? ভালো তুমি এবং আমার ¯েœহা মামণিটা কেমন আছে? ভালো। তুমি যাবার পর থেকেই বারবার শুধু তোমার কথা বলছে আর কান্না করছে। নাঈমা বাড়ি থেকে আসার পর আমার কাছে ও ভালো লাগছে না। ¯েœহার কথা বারবার মনে পড়ছে। আমার মন চায় তোমাদের কাছে চলে আসতে। মোবাইলে বাবার কথা শুনে মায়ের হাত থেকে মোবাইলটি টেনে নেয় ¯েœহা। অস্পষ্টে বাবাকে বলে আব্বু তুমি কোথায় আমি যে তোমাকে দেখি না, আমি তোমার জন্যে কান্দি। তুমি মজা নিয়ে আমার কাছে আসবা না আব্বু? মেয়ের কথায় চোখে জল আসে রহমত উল্লাহর। ইচ্ছে করে এক্ষুণি তার প্রাণপাখিটারে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে। এভাবেই এখন প্রতিদিন মোবাইলে কথা বলা হয় মা-মেয়ের সাথে। কাটে দিন, কাটে রাত শুধু দু চোখ ভরে কাছ থেকে দেখা হয়না তার কলিজার টুকরো ¯েœহা আর স্ত্রীকে। দেখতে দেখতে আরো একটি বছর পার হলো।
রাত প্রায় তিনটা। পৃথিবীর সবাই যখন গভীর ঘুমের ঘরে বিভোর তখনো রহমতের চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই। আজ রাতেও এক অদ্ভুত স্বপ্ন এসে তার চোখের পাতা ছুঁয়ে গেছে। এ স্বপ্নটা আরো বেশি দুঃস্বপ্ন। কে যেনো তার পরাণের পরাণ ¯েœহা মামণিকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন ছটপট করছে। স্বপ্ন দেখার পর ঘুমানোর বহু চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারেনি। স্ত্রী নাঈমার নম্বরে কল করতে চাইলেও মোবাইল বন্ধ থাকায় তা পারেনি। পরদিন স্ত্রীর নম্বরে কল করলো-নাঈমা আমার দিনগুলো তেমন ভালো যাচ্ছে না। ¯েœহা কেমন আছে? ওর কাছে দাও আমি ¯েœহার সাথে কথা বলবো। স্বামীর কথায় চাপা কন্নায় ভেঙ্গে পড়ে নাঈমা বেগম। কথার পাস কাটিয়ে বললো ¯েœহা ঘুমাচ্ছে, তুমি পরে কল দিয়ে ওর সাথে কথা বলো। স্ত্রীর কথা শুনে লাইন কাটলো রহমত। প্রায় একঘণ্টা পর আবারো কল করলো। এবারো মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইলে নাইমা বেগম বুকের ভেতরের কষ্টটাকে পাথর চাপা দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, তোমার মেয়ে এখন বাইরের বাচ্চাদের সাথে খেলায় ব্যস্ত। স্ত্রীর কথাগুলো ভালো ঠেকছে না রহমত উল্লাহর কাছে। নাঈমা বেগমকে কিছু না জানিয়েই পরদিন গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কত আনন্দ আজ রহমতের মনে, বহুদিন পর আবার তার প্রাণপাখিটারে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে। তার অস্পষ্ট সুন্দর সুন্দর কথাগুলো নিরব হয়ে শুনবে। বাড়ির আঙ্গিনায় পা রাখতেই দূর হতে মনে মহানন্দ নিয়ে মেয়েকে ডাকতে লাগলো, ¯েœহা, মা তুমি কোথায়? ঘর থেকে বেরিয়ে এসো মা, দেখো বাবা তোমার তোমার জন্যে কতসব মজা নিয়ে এসেছি। আমার মামণি কোথায়? দেখো বাবা তোমার জন্যে অনেক খেলনা এনেছি। স্বামীর গলার কণ্ঠ শুনেই আতকে উঠে নাঈমা বেগম। নামাজের বিছানায় বসে তাসবিহ গুণছে আর তার দু চোখ বেয়ে ঝরছে শ্রাবণধারা।
মেয়ের কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে রহমত উল্লাহ নাঈমা বেগমকে জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার আমার ¯েœহা মামণিকে দেখ্ছি না যে? ও কোথায়? ¯েœহার কথা শুনতেই স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বুকফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো নাঈমা বেগম। রহমত হতভম্ব হয়ে বললো কি হয়েছে ¯েœহার? ও কোথায়? নাঈমা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বললো, তোমার মেয়ে ঘুমাচ্ছে। তার এ ঘুম আর কোনোদিন ভাঙবে না গো। আমার মা আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেছে। আমরা এখন কী নিয়ে বাঁচবো? কে তোমাকে বলবে খেলনা আর মজা এনে দেয়ার কথা? তোমার মেয়ে পানিতে ডুবে মারা গেছে! কথাটা শুনতেই চিৎকারে কবরস্থানের দিকে দৌড়াতে লাগলো রহমত উল্লাহ...।

সর্বাধিক পঠিত