• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

রবীন্দ্রনাথ যতো বড় কবি, ততো বড় চিত্রশিল্পী

প্রকাশ:  ১৩ আগস্ট ২০১৮, ২০:০৭
মইনুদ্দিন লিটন ভূঁইয়া
প্রিন্ট

বিচিত্র এই জগৎ। তারই মাঝে বিচিত্র জীবন। এখানে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ, তুচ্ছ ও মহৎ এ সবেরই আছে অপার মহিমা। আর সে মহিমা প্রকাশ করতে একজন কবি শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে তাকে মূর্ত করেন। একজন চিত্রশিল্পী রেখা ও রঙের মাধ্যমে তার রূপ প্রকাশ করেন। দুজনেরই একই ‘দৃশ্যকাব্য’, শুধু আলাদা উপস্থাপনায় আমাদের অন্তরের একই বোধের কপাটে কড়া নাড়ে। কারণ, কবিতা ও চিত্রকলা মানুষের মনের ভিতরে যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘অন্তর মম’, সেই একই উৎস থেকে জন্ম নেয়। তাই কবিতা ও চিত্রকলায় এতো মিল, পরস্পর সহোদর যেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তারা চূড়ান্ত একাত্মা হয়েছিল। তাই রবীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন যতো বড় কবি, ততো বড় চিত্রশিল্পী।
    সত্তর বছর বয়সে জীবন সায়াহ্নে এসে ছবি আঁকতে শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। ‘রবীন্দ্রনাথ : চিত্রলিপি’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, রবীরভুমে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের সেই সময়ের প্রধান চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু জানান, গুরুদেব প্রথম যৌবনে একবার ছবি আঁকবার চেষ্টা করেছিলেন। তবে পাকাপাকিভাবে ছবির হাতে ধরা দিলেন একেবারে সত্তরের কোঠায় এসে। এ সম্পর্কে ১৯৩০ সালে শ্রী প্রতিমা ঠাকুরকে লেখা চিঠিতে কবি লিখেছেন, আমার বয়স সত্তর হয়ে এল। আজ ত্রিশ বছর ধরে যে দুঃসাধ্য চেষ্টা করেছি; আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে যেন ভিত্ পাকা হবে। ছবি কোনোদিন আঁকিনি; আঁকব বলে স্বপ্নেও বিশ^াস করিনি। হঠাৎ বছর দুই তিনের মধ্যে হু হু করে এঁকে ফেললুম, আর এখানকার ওস্তাদরা বাহাবা দিলে; বিক্রিও হবে তাতে সন্দেহ নেই। এর মানে কি ? জীবনগ্রন্থের সব অধ্যায় যখন শেষ হয়ে এলো, তখন অভূতপূর্ব উপায়ে আমার জীবনদেবতা এর পরিশিষ্ট রচনার উপকরণ জুগিয়ে দিলেন।
    আমি মনে করি, জগতের সকল কিছুরই ভাষা আছে। আর সেটা জড় কিংবা জীবন্ত যেমনই হোক। আমি দেখেছি, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, স্থির বস্তু বা জীবন, তারা সবাই রেখা ও রঙে এক নীরব ভাষায় কথা বলে চলেছে। এই যে ব্রহ্মা- আর সেখানে মহাশূন্য, তাতে আছে যে অগণিত নক্ষত্র, আর তাদের যত সৌরজগতের বিপুল বিশ^রাজি, তারা সবাই রেখা ও রঙে গতিময় এক ভাষায় কথা বলে চলেছে। সে ভাষা নীরব, নিস্তব্ধ। নিস্তব্ধতাই যে এই ব্রহ্মা-ের শ্রেষ্ঠতম ভাষা তা কেবল কোনো চিত্রশিল্প বা ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়ালেই অনুধাবন করা যায়। তখন ঐ শিল্পই একমাত্র হয়ে তার পরম নিস্তব্ধ ভাষায় কথা বলে চলে। আর আমাদের মুখের সকল ভাষাই যে তখন বন্ধ হয়ে যায়। আমরা বিস্মিত হই, আমরা স্তম্ভিত হই আর কেবল আমাদের দৃষ্টিগ্রাহ্যতায় চিত্রকলার নীরব ভাষায় মুগ্ধ হই। এভাবে চিত্রকলার সাথে আমরাও একাত্ম হয়ে পড়ি। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন, বিপুল বিশে^ অন্তহীন নিস্তব্ধতার মাঝে আমাদের এই জগৎ ক্ষুদ্র একটি বুদ্বুদ মাত্র। জগতের প্রত্যেক বস্তুই রেখা ও রঙের নীরব ভাষায় এই কথাই বলছে যে, সে শুধুই যুক্তি-তর্কের বিষয়বস্তু নয়, কিংবা মানুষের ভোগের বা ব্যবহারের বস্তুমাত্র নয়-সে আপন বৈশিষ্ট্যে নিজেই অনন্যসাধারণ, তার অস্তিত্বের অপূর্ব রহস্য তার নিজের ভিতরেই বর্তমান; কোনো কিছুর উপরেই তা নির্ভরশীল নয়। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় আমরা রেখা ও রঙের প্রলেপে মহাকালের সেই নিস্তব্ধ নীরব ভাষাকেই পাই, যা অতলান্তসম গভীর। যা শোনা যায় না, কেবল দৃশ্যকাব্যের নিস্তব্ধতায় দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। কবি উপলদ্ধি করেছিলেন, সারা জীবন ধরে সাহিত্যের মাধ্যমে জীবন ও জগৎকে যেভাবে বর্ণমালায় গ্রথিত করে সাজিয়ে তুলেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাকে চক্ষুগ্রাহ্য না করা পর্যন্ত তা পরিপূর্ণ হচ্ছিল না। আর তাই তিনি তাঁর চিত্রশিল্পে তাঁর অনুভবকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তুলতে চাইলেন। সেটা শুরু হয়েছিল তাঁর সাহিত্যের পা-ুলিপি কাটাকুটি থেকে। ১৯৪২ সালে বিশ^ভারতী, কোয়াটারলি, অবনীন্দ্রনাথ সংখ্যায় উল্লেখ আছে, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, তাঁর চিত্রকলার সৃষ্টি আগ্নেয়গিরির উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তুলনীয়। আগ্নেয়গিরির উচ্ছ্বাসের মতোই তাঁর তুলি বা কলমের মুখে বেরিয়ে আসছিল অজ¯্রধারে, যা সমস্ত জীবন ধরে তাঁর ভিতরে জমে উঠেছিল। তাঁকে চেষ্টা করে রূপ সৃষ্টি করতে হয়নি। নিজের অন্তরের পুঞ্জীভূত বোঝাটাকে খালাস করে দেবার যে বিপুল আবেগ তাঁর মনে এসেছিল, সেই আবেগ নিজে নিজে তার প্রকাশের রূপ ও উপায় ঠিক করে নিয়েছিল।
    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্য ও চিত্রশিল্পের মধ্যে কোনো পার্থক্য বা ভেদরেখা টানা যাবে না। কাব্যসৃষ্টির মধ্য দিয়েই তিনি চিত্রশিল্পের ধারাকে আলিঙ্গন করেছিলেন। পা-ুলিপি কাটাকুটির মধ্যে তিনি তার ভাবনার অপার অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে মূর্ত করে তুলছিলেন। রবীন্দ্রসাহিত্য যেমন সীমার মাঝে অসীমকে খুঁজেছে, রবীন্দ্রচিত্রকলা রূপের মাঝে অরূপকে মূর্ত করতে চেয়েছে। রবীন্দ্রচিত্রকলা যেন ধ্যানস্থ মনীষীর ভাবালোক থেকে উত্তীর্ণ প্রজ্ঞাময় অস্তিত্বের মূর্ত রূপ। রবীন্দ্র চিত্রকলায় প্রাচ্য বা প্রতীচ্যের কোনো নিয়ম বা রীতি নেই। সবটাই তাঁর একান্ত নিজস্ব। এখানে তিনি একা এবং অদ্বিতীয়। ছবিতে তাঁর রেখার গতি মহাকালের গলিত সময়ের মতো। রঙ ব্যবহারে তিনি মহাকালের মতোই গভীরতায় পরিপূর্ণ। ফলে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা একধরনের বিমূর্ততায় পরাবাস্তব হয়ে উঠেছে। ছবি আঁকতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ চোখের দেখাকে নয়, বরং মনের দেখাকেই গুরুত্ব দিয়ে এঁকেছেন। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছবিতে বাইরের নয়, ভিতরের, উপরের নয় গভীরের, বাস্তবের চেয়ে অধিক অজানা পরাবাস্তবতাকে উন্মোচন করতে চেয়েছেন।
    

 

সর্বাধিক পঠিত