রবীন্দ্রনাথ ও চাঁদপুরের চিত্রনিভা
⬛ মুহাম্মদ ফরিদ হাসান ⬛
ডাকাতিয়া ও মেঘনার কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা জনপদ চাঁদপুরের পুরাণবাজারে তাঁর জন্ম, ১৯১৩ সালে। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন নিভাননী। অল্পবয়স থেকেই চিত্রকর্মের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর। তাই প্রতিবেশীরা প্রায়শ-ই তাঁকে দিয়ে বিয়ের পিড়ি, বরণ ঢালা আঁকিয়ে নিতেন। নকশাকার হিসেবে খুব অল্পসময়ে তিনি পরিচিতদের প্রশংসা কুড়ান। নিভাননীর বিয়ে হয়েছিল ১৯২৭ সালে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে। তাঁর স্বামী নিরঞ্জন চৌধুরী নোয়াখালীর লামচর গ্রামের জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরীর ছেলে ছিলেন। বরপক্ষ নিভাননীকে দেখার পূর্বেই তাঁর আঁকা বিয়ের পিঁড়ি দেখে তারা মুগ্ধ হন এবং সেই পিঁড়ির সুবাধেই বরপক্ষ নিভাকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বলা চলে, নিভাননীর আঁকাআঁকিই বরপক্ষকে আত্মীয়তা করতে উৎসাহিত করে।
নিভাননীর শ^শুরবাড়ির দীর্ঘ ঐতিহ্য ছিল। এমনকি তাঁর শাশুড়িও কবিতার চর্চা করতেন। এ বাড়ির সদস্যদের আন্তরিকতার কারণেই নিভাননী চৌধুরী তাঁর প্রতিভাকে যথাযথভাবে বিকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শিল্পের প্রতি অনুরাগ দেখে শ^শুরবাড়ি থেকে নিভাকে শান্তিনিকেতনে পড়তে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নিভাননী পূর্ব থেকেই রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার অনুরক্ত ছিলেন। তাই শান্তিনিকেতনে ভর্তি হওয়া ছিল তাঁর স্বপ্নপূরণের প্রাপ্তি। শান্তিনিকেতনে ভর্তি হওয়ার পূর্বে নিভাননী আনন্দ-বিহ্বল দিনযাপন করেছিলেন। সেসব দিন সম্পর্কে তিনি লিখেছেন-‘তখন কেবলই মনে হতে লাগল, আমার ধ্যানের ঋষি রবীন্দ্রনাথ এবং আমার ধ্যানের আশ্রম শান্তিনিকেতন কবে দেখতে পাব! এই চিন্তায় এতই নিমগ্ন হয়ে পড়লাম, আমি যে কোথায় আছি এবং কী করছি মাঝে মাঝে তাও ভুলে যেতাম। একদিন তো আশ্রমের কথা ভাবতে ভাবতে চালে-ডালে মিশিয়ে ফেলে, এক কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে ফেলেছিলাম।’ ১৯২৮ সালে নিভাননী শান্তিনিকেতনের মাটিতে পা রাখেন। তখন কলাভবনের দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু। নিভাননী তাঁর সহচার্যে চিত্রসাধনা শুরু করেন। এখানে অধ্যয়নকালে তিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় অতিক্রম করেন। নিভাননী শান্তিনিকেতনে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসেন। তিনি হয়তো ভাবতেই পারেননি, এখানে এসে তিনি কেবল কবিগুরুর দর্শনই নয়, তাঁর অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালোবাসাও পাবেন। রবীন্দ্রনাথ শুরু থেকে নিভাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। তিনি প্রতিদিন ঘরে ফেরার পথে তাঁর খোঁজ নিতেন। তাই রবীন্দ্রনাথের কাছে নিভাননীর অবাধ যাতায়াত ছিল।
নিভাননী শুরু থেকেই কবিগুরুর আস্থা অর্জন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত তাঁর ছবি আঁকার খোঁজখবর নিতেন। বলতেন, ‘কী কী ছবি আঁকলে? আমায় এনে দেখিও।’ তারপর নিভা যখন তাঁকে ছবি দেখাতে যেতেন, তখন তিনি বলতেন, ‘তোমার শক্তি আছে, তুমি পারবে, আমি আশীর্বাদ করলুম।’ রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত অর্থেই নিভার শিল্পমুগ্ধ ছিলেন। সেজন্যে তাঁর চিত্রকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ নিভাননী নাম রাখেন ‘চিত্রনিভা’। নিভাননী আজীবনই কবিগুরুর দেয়া নামটি সযত্নে বহন করে গেছেন। নামরাখা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ স্বভাবসুলভ রসিকতা করতে ভুলতেন না। চিত্রনিভা চৌধুরী জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝেই তাঁকে দেখলে বলতেন, ‘তোমার নামকরণ করলুম, এখন বেশ ঘটা করে আমাদের খাইয়ে দাও।’
নিজের ছবি দেখানোর পাশাপাশি চিত্রনিভা প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকা দেখতে যেতেন। অনেকসময় তিনি কবিগুরুর ছবি আঁকার সরঞ্জাম পরিষ্কার করে দিতেন। রবীন্দ্রনাথ চিত্রনিভাকে তাঁর আঁকা ছবি উপহার দিয়েছিলেন। তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন কয়েকটি রঙের বাটিও। এমনও হয়েছে নিভাননীর আঁকা ডিজাইনের মধ্যে কবি নতুন একটি কবিতা লিখেছেন। এ নিয়ে তাঁর স্মৃতিকথায় চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন চিত্রনিভা। লিখেছেন, ‘একবার তাঁকে (রবীন্দ্রনাথকে) আমার আঁকা কতগুলো ডিজাইন দেখাতে গিয়েছিলাম। তার একটি ডিজাইনের মাঝখানে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা ছিল, ওই ফাঁকা জায়গাটি দেখে কিছু লেখার জন্য কবির হাত সুড়সুড় করছিল, তিনি বারবার আমায় বলছিলেন, ‘তুমি এর মধ্যে একটা কবিতা লিখেই ফেলো না?’ আমি বললাম, ‘আমি তো কবিতা লিখতে পারি না।’ তখন তিনি হেসে বলে উঠলেন, ‘তবে কি আমাকেই লিখে দিতে হবে?’ উত্তরে আমি বললাম, ‘আপনি লিখে দিলে তো ভালোই হয়।’ তারপর তিনি বললেন, ‘তাহলে ডিজাইনটি টেবিলের ওপর রেখে যাও।’ পরদিন গিয়ে দেখি আমার ডিজাইনের ফাঁকা জায়গায় তিনি লিখে দিয়েছেন একটি নতুন কবিতা।’
শ্রীসদনে নূতন কেউ এলে কবির সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন চিত্রনিভা। সেজন্যে রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘চিত্রনিভা হচ্ছে নূতনের সঙ্গী’। চিত্রনিভার স্মৃতিকথায় আমরা অকৃত্রিম স্নেহপ্রবণ একজন রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পাই। নিকেতনের শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কমতি ছিলো না। চিত্রনিভার ভাষ্যে, ‘গুরুদেব আমাদের সবসময়ই বলতেন, তোমাদের যখন যা বুঝতে ইচ্ছে হয়, আমার কাছে এসে বুঝে নিও’। নারী শিক্ষার প্রতিও তিনি গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলতেন, এই আশ্রম আমি বিশেষ করে মেয়েদের জন্যই তৈরি করেছি, যাতে মেয়েরা মুক্তভাবে শিক্ষালাভ করতে পারে। শিক্ষার্থীদের খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো, স্বাস্থ্যের প্রতিও রবীন্দ্রনাথের সজাগ দৃষ্টি ছিলো। চিত্রনিভা চৌধুরীর স্মৃতিচারণে আমরা অসুস্থ এক শিক্ষার্থীর প্রতি কবিগুরুর পিতৃসুলভ আকুলতা দেখি। কবিগুরু সেই অসুস্থ শিক্ষার্থীটির জন্যে প্রায়ই ফুলের তোড়া আনতেন। তার মাথায় হাত বোলাতেন। শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে নিঃসঙ্কোচে যেতে পারতেন। নিভাননী ও তাঁর বন্ধু ফিরোজা বারী প্রায় দুপুরে রবীন্দ্রনাথের বিশ্রামের সময় নিঃশব্দে উপস্থিত হতেন। তাদের হাতে থাকতো কবিগুরুর ‘চয়নিকা’। চিত্রনিভা সেসব দিন সম্পর্কে জানাচ্ছেন : ‘...বন্ধু ফিরোজা বারীকে নিয়ে, চয়নিকা বইখানি হাতে করে, রোজ নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে গুরুদেবের বিশ্রামের সময় গিয়ে হাজির হতাম। ...পাছে তাঁর ধ্যানভঙ্গ হয় তাই আমরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকতাম দরজার আড়ালে। তারপর আমাদের প্রতি তাঁর দৃষ্টি পড়ামাত্র তিনি মৃদু হেসে, স্নেহভরে কাছে ডেকে নিতেন। তারপর চয়নিকা বইখানা খুলে একটার পর একটা কবিতা আবৃত্তি করে যেতেন।’
শান্তিনিকেতনে থাকতে চিত্রনিভা যেমন গ্রামে ঘুরে ঘুরে ছবি এঁকেছেন, তেমনি স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে তিনি অংশগ্রহণও করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এ আন্দোলনে জড়িত হওয়ার জন্যে উৎসাহিত করেন। লবণ আইন ভাঙার জন্যে চিত্রনিভা খালি পায়ে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছেন। গ্রামের নারীদের সচেতন করতে তিনি কাজ করেছিলেন। অনেক অনুষ্ঠানে নিকেতনের সবাই যেতে পারতো না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ চিত্রনিভার জন্যে কোনো বাধা-নিষেধ রাখেননি। প্রতিটি অনুষ্ঠানে, দেশি-বিদেশি অতিথিদের আপ্যায়নে তাঁর অবাধ যাতায়াত ও সরব উপস্থিতি ছিলো। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অনেক বরেণ্য মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকে তিনি যেমন কবিতা পাঠ শুনেছেন, তেমনি গল্পগুচ্ছ থেকেও পাঠ শোনার স্মরণীয় অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর।
রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে ছবি আঁকায় ধ্যানস্থ হয়েছিলেন। চিত্রনিভার ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ গ্রন্থে সেই ধ্যানের কিছু ছবি পাওয়া যায়। চিত্রনিভার স্মৃতিচারণ : ‘শেষ বয়সে বেশিরভাগ সময়ই তিনি ছবির মধ্যে ডুবে থাকতেন। সবসময় তাঁকে দেখেছি একটি কলম অথবা তুলি দিয়ে ছবি এঁকেই চলেছেন। কাগজের কোনো বাছবিচার ছিল না তাঁর। হাতের কাছে যা পেতেন, ছবি আঁকার নেশায় তারমধ্যে এঁকে ফেলতেন তিনি। কত সময় দেখেছি তাকে ফেলে দেয়া কাগজের ওপরেই ছবি আঁকছেন।’ অন্যদিকে চিত্রনিভা প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের স্কেচ করতেন। রবীন্দ্রনাথের বিশ্রামের ছবি, ধ্যানের ছবি-হরেক রকম ছবি চিত্রনিভা এঁকেছেন। তিনি এ অভিজ্ঞতার কথাও পাঠকদের জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন : ‘তখন বসন্তকাল। শুকনো পাতা ঝরে ঝরে পড়ছে। গিয়েছি কবিগুরুর প্রতিকৃতি নিতে। কবির অন্তরে বিদায়ের সুর বেজে উঠেছে। তিনি গান রচনা করে গাইছিলেন।... সেই তন্ময় রূপটি আমার পেনসিল স্কেচে ধরে রাখলাম। আর একদিন নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে তাঁর প্রতিকৃতি আঁকতে গিয়েছিলাম। তখন তিনি একখানা বই হাতে করে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসেছিলেন ইজিচেয়ারে। সেই মুহূর্তটিও আমি ধরে রাখলাম আমার পেনসিল স্কেচে।’
রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের অসংখ্য স্মৃতি চিত্রনিভার সাথে জড়িয়ে রয়েছে। তাঁর স্মৃতি ধরে অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখতে পাই। চিত্রনিভা ক্যামেরায় রবীন্দ্রনাথের ছবি তুলেছেন, কখনো দেখেছেন কবিগুরু স্বয়ং মঞ্চে অভিনয় করছেন। আবার দেখেছেন রসিক রবীন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধু এলমহার্স্টের বিয়ের বরযাত্রী হয়েছেন। চিত্রনিভা আজীবন রবীন্দ্রনাথের আরাধনাই করে গেছেন।
চিত্রনিভা ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম নারী শিল্প-অধ্যাপিকা ও বাংলাদেশের প্রথম নারী চিত্রশিল্পী। তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে স্মৃতিকথা লিখেছেন ১৯৬১ সালে। তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৯৯ সালে। অথচ এমন আধুনিক সময়েও তাঁর লেখা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই স্মৃতিকথন পাঠকের হাতে পৌঁছাতে অর্ধশতাব্দি লেগে গেল। যাই হোক, অনেক দেরিতে হলেও সেই বইটি এপার-ওপার দুই বাংলা থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য চারুকলা পর্ষদ থেকে ২০১৫ সালে ‘স্মৃতিকথা’ নামে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে ২০১৭ সালে বইটি বাংলাদেশের বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ নামে প্রকাশিত হয়। চিত্রনিভা কেবল তাঁর চিত্রকর্ম নয়, রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর হৃদিক সম্পর্কের কারণেও শিল্পের জগতে আলোচিত হয়ে থাকবেন।