সাহিত্যের ধ্রুপদী শিল্পস্রষ্টা
ঊনবিংশ শতাব্দী আধুনিক সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। বাংলা সাহিত্যের যুগসন্ধিক্ষণে মধুসূদনের আবির্ভাব এবং সাহিত্যের দুর্গমপথে রেনেসাঁর পথ ধরেই বাংলার যুগমানস মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নবজাগরণ সৃষ্টি করেছেন। মধুসূদন দত্ত ছিলেন এক স্বতন্ত্র চেতনার কবি, এক বিস্ময়। বাঙালির সমাজ–সংস্কৃতিতে এক আধুনিক জীবনবোধ ও নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। যা আজও খরস্রোতা নদীর মতোই বহমান। আজীবন ছন্নছাড়া ও বোহেমীয়ান ধারার মানুষ মধুসূদন দত্তের প্রতিভার স্বাক্ষর ফুটে ওঠে তাঁর শৈশবের শিক্ষা জীবন থেকেই। কলকাতার কলেজ জীবনে তাঁর কাব্যচর্চার সূচনা ঘটে। হিন্দু কলেজে অধ্যয়নকালীন সময়ে ইংরেজ শিক্ষক ক্যাপেটন ডি এল রিচার্ডসনের অনুপ্রেরণায় ইংরেজি ভাষায় কাব্য চর্চা শুরু করেন তরুণ মধুসূদন। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসন শোষণে নিপীড়িত, নির্যাতিত, নিষেপষিত, অবহেলিত বাঙালি জাতিসত্তা যখন বিলীন হয়ে পড়েছিল, তখন পরাধীন ভারতের মাটিতে জন্ম নেয়া কবি স্বভাবতই নৈরাশ্যবোধে পর্যুদস্ত হয়েছেন। স্বাধীনতার অনিবার্য আকাঙ্ক্ষা এবং তাঁর প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি, অদম্য সৃষ্টিশীলতা তাকে টেনে নিয়ে গেছে জীবনের সব বিচিত্র বন্দরে। শাসক ইংরেজ জাতিকে পরাস্ত করতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মাইকেল সাহিত্যে স্থান দখলের মানসে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চায় ঝুঁকে পড়েছিলেন। যা তাঁর অপমানের প্রতিশোধ সপৃহা ও ঘৃণা থেকে উৎসারিত আবেগের বহিঃপ্রকাশ। তিনি নিজস্ব প্রতিভার শক্তিমত্তায়, মননশীলতায় ইউরোপীয় সাহিত্য চর্চায় তাঁর চেতনার রুদ্ধদ্বার উন্মোচনে সমর্থ হয়েছিলেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল তাঁর। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের সাহিত্য কর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন প্রবলভাবে । অদম্য সপৃহায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন সাহিত্য চর্চায় । হোমার, ভার্জিল, দান্তে, ট্যাসো ও মিল্টনের কাব্যরসে তিনি নিজেকে গড়েছেন শৈল্পিক কুশলতার নির্মাণকারী হিসেবে ।
জীবনের শুরুতে মাতৃভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করলেও পরবর্তীতে বাংলাকেই আকুল আবেগে কবি আপন করে নিয়েছেন এবং এ ভাষাকেই নতুন এক গতিপথে চালনা করেছেন। নিজের ভুল অনুধাবন করে কবি অনুশোচনায় নিঃসঙ্কোচ চিত্তে উচ্চারণ করেছেন-“আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়/ তাই ভাবি মনে?/ জীবন প্রবাহ বহি কাল–সিন্ধু পানে যায়/ ফিরাব কেমনে? /দিন দিন আয়ুহীন হীনবল দিন দিন,/ তবু এ আশার নেশা ছুটিল না? একি দায়”।স্বীকৃতির অভাবে নিজের অপমান জাত্যাভিমান ও ব্যর্থতায় নিজের ভুল উপলব্ধি করে ফিরেছেন মাতৃক্রোড়ে, স্বদেশি ভাষার কাছে, নিজস্ব অস্তিত্বের কাছে। কবির নিজের স্বীকারোক্তি এবং আর্তি প্রকাশ পেয়েছে “বঙ্গভাষা” কবিতার প্রতিটি ছত্রে :“হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন; /তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি, /পর–ধন–লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ/পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি ।/কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি! /অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায়, মনঃ, /মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি; /কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল–কানন!”
সারস্বত প্রতিভাধর মেধাবী মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ধারার প্রবর্তনে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর চিন্তার প্রতিফলন এবং সৃজন–প্রয়াস বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে দান করেছে অভূতপূর্ব মর্যাদা ও সৌন্দর্য । তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেছেন ও বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। মধুসূদনের সৃজিত নাটক, প্রহসন, মহাকাব্য, গীতিকাব্য, সনেট, ছন্দ, অলঙ্কার বিশিষ্ট পদ রচনারীতি প্রতিটি বাঙালি সাহিত্যানুরাগী সমস্ত হৃদয় মন দিয়ে অনুভব করে। জীবনের নানা উত্থান–পতন, ঝড়–ঝঞ্ঝার মধ্যে সনেটের চেয়ে অন্য কোন মহত্ত্বর শিল্প কৌশলে যাওয়া তখন মধুসূদনের পক্ষে প্রায় দুরূহ ব্যাপার ছিল। সমাপ্তি কবিতায় তিনি উদ্ধৃত করেছেন – বিসর্জিব আজি, মাগো বিস্মৃতির জলে (হৃদয়–মন্ডপ, হায়, অন্ধকার করি)ও প্রতিমা। /নিবাইল দেখ হোমানলে, /মনঃকুম্ভে অশ্রুধারা মনোদুঃখে ঝরি! /– ডুবিল সে তরী, /কাব্য নদে, খেলাইনু যাহে পদে বলে/অল্পদিন! মধুসূদনের সনেটে কবির আবেগ–উপলব্ধি ,কবিতার নির্মাণকৌশল, জগৎ–জীবন সম্বন্ধে তাঁর অনুভব, প্রকৃতির মনোরম শোভা, মাটির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিস্তৃত চেতনা, তাঁর সৃষ্টির বিষয় সবকিছু সাবলীল ভাবে বিধৃত হয়েছে। চতুর্দশপদী কবিতা লিখতে গিয়ে মধুসূদন ইতালির কবি পেত্রার্ক এবং ইংরেজ কবি মিল্টনের কলাকৃতি অনুসরণ করেছেন । তাঁর লেখা চতুর্দশপদী কবিতার হাত ধরেই বংলায় সনেটের যাত্রা শুরু। বাংলা ভাষায় এটিও এক বিস্ময়কর নতুন সৃষ্টি। শৈশব–কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত পাখিডাকা ছায়াময় সৌম্য সুনিবিড় সাগরদাঁড়ি গ্রামের কপোতাক্ষ নদের প্রতি মাইকেলের যে বিশেষ আকর্ষণ তা “কপোতাক্ষ নদ” কবিতায় তিনি যেভাবে প্রকাশ করেছেন , তাতে কবির ভালোবাসা প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে । কপোতাক্ষ নদের কলকল ধ্বনি সুদূর প্রবাস জীবনে সর্বদা কবি শুনতে পেতেন, অনুভব করতেন । মায়ের স্তনের দুধ যেমন শিশুর তৃষ্ণা মেটায়, ঠিক তেমনি কপোতাক্ষ নদ, জন্মভূমির স্তনের মতো কবির তৃষ্ণা মেটাত। এ জন্য কবি বার বার স্মরণ করেছেন কপোতাক্ষ নদকে : “সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে/সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।/ সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে/শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে/ জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।/বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে/ কিন্তু এ তৃষ্ণা মেটে কার জলে/ দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।/ আর কি হে হবে দেখা যত দিন যাবে/ প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে/বারি রূপ কর তুমি এ মিনতি গাবে/বঙ্গজ জনের কানে সখে–সখারিতে।/নাম তার এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে/লইছে যে নাম তব বঙ্গের সঙ্গীতে”। কবির চিন্তাভাবনা, আনন্দ–বেদনা সব একাকার হয়ে গেছে সনেটগুলোতে। দেশীয় চিন্তাধারায় কবি লিখেছেন, শিবমন্দির, শ্মশান প্রভৃতি সনেট। লিখেছেন সায়ংকালের তারা, ছায়াপথ, সূর্য; যদিও এগুলো প্রকৃতিভিত্তিক। পদ্মাবতীতে তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেন। এরপর তিলোত্তমাসম্ভব, মেঘনাদ বধ কাব্য মহাকাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, কৃষ্ণকুমারী নাটক, বীরাঙ্গনা কাব্য, চতুর্দশপদী কবিতা বঙ্গভূমি প্রভৃতি লিখেন । ১৮৫৮ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এই স্বল্প সময়ের মধ্যে রচিত হলো কবির সাহিত্যজীবন। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি একে একে রচনা করলেন মহাকাব্য তিলোত্তমাসম্ভব, মেঘনাদবধ, বীরাঙ্গনা এবং শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী, একেই কি বলে সভ্যতা, কৃষ্ণকুমারী, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো ইত্যাদি নাটক ও প্রহসনসহ বিভিন্ন কাব্য ও কবিতা। বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার রূপ, রস, ছন্দ তার নির্যাস ছড়িয়েছেন মাইকেল মধুসূদন। মানুষের যাপিতজীবন ও নানাবিধ বিষয়ের ওপর কবি মধুসূদনের যে উপলব্ধিজাত চেতনা, বোধ তা তিনি সুন্দর করে আধুনিক নির্মাণ কুশলতায়, স্বতন্ত্র রচনার আভিজাত্যে কবিতায় এবং সাহিত্যে সৃজন করেছেন। আর তাই তিনি যেমন কবিতায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্রষ্টা ও দিকপাল, তেমনি আধুনিক
বাংলা কাব্যের রূপকার। কবি মধুসূদন কালপুরুষ কবিতায় আধুনিকতার যে ধারা প্রকাশ করেছেন তা মূলত মানবিকতা । তাঁর অমর সৃষ্টি মহাকাব্য “মেঘনাদবধ” কাব্যে মানবতাবাদের চেতনা প্রকাশ করেছেন অবলীলায় । শিল্পবোধের আলোকে ভয়ংকর রাবণকে মানুষের কাছে তিনি মানবিক দৃষ্টিতে দাঁড় করিয়েছেন। পুত্র হারানো যে কতোটা কষ্টের ও শোকের এবং একজন পিতার বিলাপ কতো বেশি এই কাব্যে তা মানবিকভাবে উঠে এসেছে। তিনি মহাকাব্য রচনার উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন ইউরোপীয় সাহিত্য ভাণ্ডার চষে। তাঁর সে অনুপ্রেরণার আদর্শ ছিলেন স্বয়ং হোমার। মেঘনাদবধ লেখার ধারণা পেয়েছিলেন হোমারের হেকটরবধ থেকে। “মেঘনাদবধ ” কাব্যই বাংলা সাহিত্যের পৌরাণিক আখ্যানধর্মী কাব্য। বহু বছর পরিশ্রমের ফলে হোমেরিক স্টাইলের প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি তার মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্য প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এক সময় নিজেকে বলেছিলেন:“আমি এক সকালে উঠে নিজেকে সফল হিসেবে পাইনি, এই কাব্যের সফলতা বহু বছরের কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।” “বীরাঙ্গনা” কাব্যে কুসংস্কার অন্ধত্ব গোড়ামী ও ধর্মীয় বেড়াজাল ছিন্ন করে কবি পৌরাণিক অনেক নারীর কণ্ঠ থেকে আধুনিকতা ও প্রগতি ছোঁয়ায় মানবতার কথা উচ্চারণ করিয়েছেন । বীরাঙ্গনা কাব্যের মাধ্যমে সমাজে নিষেপষিত, অবহেলিত ও নির্যাতিত নারীদের মুক্তির জন্য সাহসিকতার জয়গান গেয়েছেন। বীরাঙ্গনা কাব্যে কবি মধুসূদন আধুনিকতার রঙে এক বিরহের চিত্রই এঁকেছেন। এখানে কৃষ্ণ বিরহের চিত্রই এঁকেছেন। এখানে কৃষ্ণ বিরহে রাধিকার হৃদয়ে পাহাড়সম বেদনা, কষ্ট ও যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন।
বহু প্রতিভার অধিকারী কালজয়ী মহাকবি মাইকেল মধুসূদন কাব্যসাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছেন ও বিকাশ ঘটিয়েছেন তেমনি আবার নাট্যসাহিত্যকেও সমানভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি পাশ্চাত্য সাহিত্যঅনুসরণে চতুর্দশপদী কবিতার পাশাপাশি নাট্যকাব্যও রচনা করেছিলেন। ‘শর্মিষ্ঠা‘ নাটক কবির প্রথম বাংলা রচনা। এটি ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ‘শর্মিষ্ঠা‘ নাটকটি তিনি ইংরেজিতেও অনুবাদ করেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন ইউরোপীয় রেনেসাঁস কবিদের মতো বাংলা সাহিত্যে নতুন নাট্যধারা, চরিত্রসৃষ্টি ও তার অনুষঙ্গ ভাষা তৈরির মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সচেতনভাবেই সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, যার প্রকাশ তাঁর প্রথম সৃষ্টি শর্মিষ্ঠাতে। তারুণ্যের ভাবাবেগে তিনি অশানুরূপস্বপ্ন দেখেছেন , মরীচিকার পেছনে ছুটেছেন । কিন্তু তাঁরসেই স্বপ্ন নৈরাশ্য আর ক্লান্তিতে ভরে গেছে । তিনি সেদিন আপন জন্মভূমিকে আবারনতুন করে চিনলেন ও জানলেন। তিনি আবার ফিরলেন প্রিয় জন্মভূমির মৃণ্ময় ঐতিহ্যের দিকে। তাঁর তাকে শুধু শিল্পের ভিতরে নয়, জীবনের ভেতরেও নতুন ভাবে জাগ্রত করেছিল ।
মধুসূদন ছিলেন বাংলা সাহিত্যের যুগপ্রবর্তক কবি। মাইকেল মধুসূদন সৃজনের তীব্র বর্ণচ্ছটায় বাংলাসাহিত্যের অঙ্গনকেআধুনিকতার পরশে বিকশিত করেছেন তাঁর অমর সৃষ্টিগাথা কবিতা, গদ্য, নাটক, মহাকাব্য এবং প্রহসনে সমকালের জীবনচিত্রের অনুষঙ্গে । তাঁর মেধার নৈপুণ্যে সূর্য কিরণের আলোক রশ্মি অলোকিত করেছে সমগ্র সাহিত্য ভুবন এবং তাঁর সৃষ্টিশীলতায় সূচিত হয়েছে সাহিত্যের নব দিগন্ত । নিঃসন্দেহে মাইকেল একজন খাঁটি বাঙালি ও প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তাঁর স্বদেশ প্রেম, ভাষা প্রেম ও জাতিসত্তার প্রতি আনুগত্যের কারণে আজো তিনি বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্রময় ভূবনে নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ও ধ্রুপদী শিল্পস্রষ্টাহিসেবে পূজিত এবং স্মরণীয় ।
(সংগৃহীত)