• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

অরক্ষিত স্বাধীনতার ভাস্কর্য ও স্মৃতির মিনার

প্রকাশ:  ১২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৭:০৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন থেকে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশ নামে সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরেও আন্দোলনের চাকা থেমে ছিল না। মুক্তিযুদ্ধসহ গণতন্ত্র মুক্তির দাবিতে যেসব বীর সেনানী জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের স্মরণে তৈরি হয়েছে অনেক স্মৃতি ফলক কিংবা ভাস্কর্য। উৎসব আয়োজন ছাড়া সারা বছর এসব স্থাপনা থেকে যায় অযত্ন, অবহেলায়। এবারের সংখ্যাটি সাজানো হয়েছে তেমনি কিছু চিত্র দিয়ে।

আজও বাস্তবায়ন হয়নি শহীদ মিনার কমপ্লেক্স

বাংলা ভাষার প্রতিটি বর্ণে যাদের সাহসিকতার জয়গানের ইতিহাস আছে সেই মহান ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারের চেহারা কিছুটা পাল্টেছে আগের থেকে। বিডি ক্লিন নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে শহীদ মিনারে জুতাখুলে প্রবেশ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও দুইপাশে রশির বেড়া তৈরি করে দেয়া হয়েছে। ফলে বেসরকারি উদ্যোগে হলেও শহীদ মিনারের সম্মান রক্ষার একটি কার্যকরী উদ্যোগ লক্ষ্য করা গেছে। বিডি ক্লিনের উদ্যোগে শহীদ মিনারের বিস্তীর্ণ বেদিতে একাধিক সাইনবোর্ড দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবি এ সংগঠনটি। তবে গত বছর ১৩ ডিসেম্বর ‘গৌরবের মিনার : লুণ্ঠিত পবিত্রতা’ শিরোনামে যুগান্তরে এই প্রতিবেদকের করা প্রতিবেদনে নাম ফলকের বিষয়ে যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল এবং ইতিহাসবীদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের যে মতামত তুলে ধরা হয়েছিল তার কোনো বাস্তবতা চোখে পড়েনি। নাম ফলক শহীদ মিনারের পেছনের অংশে জরাজীর্ণ অবস্থায় থাকায় তা দর্শনার্থীদের চোখে পড়ছে না। তাছাড়া ভাষা আন্দোলনের ৬৬ বছর হতে চললেও শহীদ মিনার কমপ্লেক্স পরিকল্পনার বাস্তয়ান করা সম্ভব হয়নি। কোনো ইতিহাস পরিচিতি বা আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিয়াম না থাকায় দূর দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা শুধু মিনারের ভাস্কর্য দেখেই বিদায় নেন। অন্যদিকে ভাষা আন্দোলনের পর থেকে যে কোনো জাতীয় উদ্যোগ আয়োজনে মানুষ আজও ছুটে যান শহীদ মিনারে। প্রতিবাদের ভাষা তুলে ধরেন ভাষা সংগ্রামের স্মৃতিবহনকারী এ মিনারের পাদদেশ থেকে। স্বনামধন্য ব্যক্তিদের শেষ শ্রদ্ধার আয়োজন করা হয় এ পবিত্র মিনারের পাদদেশে। এছাড়াও সাধারণভাবে প্রতিদিন প্রচুর লোকসমাগম হলেও নিকটবর্তী কোনো পাবলিক টয়লেট না থাকায় বিপাকে পড়তে হয় দর্শনার্থীদের। পাবলিক টয়লেটের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট কর্মকর্তা সুপ্রিয়া দাস গত বছর আশ্বাস দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি আজও।

স্বাধীনতা সংগ্রাম

বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাসকে ধারণ করে নির্মিত অন্যতম বৃহৎ ভাস্কর্যের নাম স্বাধীনতা সংগ্রাম। শামীম শিকদার এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন। ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটির উদ্বোধন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফুলার রোডে সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল ও বুয়েট সংলগ্ন সড়ক দ্বীপে (উদয়ন স্কুলের সামনে) এই ভাস্কর্যটির অবস্থান। এখানে শুধু দেশ নয় দেশের বাইরের অসংখ্য জ্ঞাণীগুণী মানুষের ভাস্কর্য স্থান পেয়েছে। তবে এই ভাস্কর্যগুলোর মান নিয়ে ভাস্করবোদ্ধারা বড় ধরনের আপত্তি তুলেছেন। ভাস্কর্যে সবার উপরে স্থান দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু ভাষণরত বঙ্গবন্ধুকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে তার বাম হাতকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে তিনি অধিকাংশ সময়ে ডান হাত দিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন বলেই বিশ্লেষকরা মত দিয়েছেন। অন্যদিকে শহীদ নূর হোসেনের যে ভাস্কর্যটি সেখানে দাঁড় করানো হয়েছে তা অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে তৈরি করা হয়েছে বলেই অনেক দর্শনার্থী অভিযোগ করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক মো. এনামুল হক বলেন, ওখানে যে ভাস্কর্যগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে তা সংস্কার করা উচিত। কেননা ওই কাজগুলো একেবারেই মানহীন জঞ্জালের মতো করে তৈরি করা হয়েছে। যে কোনো মানুষ যার স্বাভাবিক বিচারক্ষমতা রয়েছে তিনিও এগুলো দেখে রুষ্ট হবেন। যদি বহু বছর আগের কোনো ভাস্কর্য যেমন গ্রিক সভ্যতার, রোম সভ্যতার ভাস্কর্য এর পাশে রাখা হয় তবে মানুষ ভাববে এগুলো প্রাচীন আর গ্রিক, রোমেরগুলো আধুনিক ভাস্কর্য। মানের দিক থেকে এতটাই বাজে হয়েছে যে, তুলনা করলে মনে হবে এগুলো কোনো প্রাগৈতিহাসিক যুগের! বেশ কয়েকবার এগুলো সংস্কারের জন্য আলোচনা হলেও তা কার্যকর হয়নি। দ্রুত এগুলো সংস্কার করা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম নামক ভাস্কর্যগুলোকে এক কথায় বলা যায় একটি জঙ্গল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এমন নিন্মমানের কাজ উপস্থাপন করা একেবারেই অনুচিত। যত দ্রুত সম্ভব একটি কমিটি করে দিয়ে ওই ভাস্কর্যগুলো সংস্কার করে পুনঃস্থাপন করা উচিত। কেননা প্রতিদিন অনেক মানুষ এই ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসেন। তাদের মধ্যে যারা একটু মনোযোগী তারা এ ধরনের বাজে কাজ দেখে হতাশ হবেন এবং আমাদের শিল্পমান নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন।

পোস্টারে তোরণের মরণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (ডিইউএএ) এর উদ্যোগে ও ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৪ সালের ১৬ মে শুরু করা হয় মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ নির্মাণের কাজ। স্যার এ এফ রহমান হলের কাছে এবং নীলক্ষেত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশদ্বার হিসেবে এই তোরণ নির্মাণ করা হয়। ৯৯ ফুট দৈর্ঘ্য, ১৩ ফুট প্রস্থ আর ৩৭ ফুট উচ্চতার এ তোরণটি নির্মিত হয়েছে ভাস্কর রবিউল ইসলামের নিপুণ তত্ত্বাবধানে। তোরণে ব্যবহার করা সাদা ও নীল রঙের লাইট যেন উৎসবের আমেজ বহন করত। এখন এই বাতিগুলোর অনেকগুলোই অকার্যকর। তোরণের নিচের অংশ চলে গেছে অবৈধ বিজ্ঞাপনদাতাদের দখলে। পোস্টার আর স্টিকারের অত্যাচারে সৌন্দর্য হারিয়ে তোরণটির অবস্থা এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা!

অজ্ঞাত এক ভাস্কর্যের গল্প

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন প্রতীকী স্থাপনা তথা ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। এর বেশিরভাগই সারা বছর অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকে। শুধু উৎসব বা ভাস্কর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত দিন-তারিখ এলেই ধুয়ে মুছে ফুলের তোড়া দিয়ে, নির্মমভাবেই স্মরণ করা হয় শহীদদের! বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলের মধ্যে লোহার লাল রঙের তেমনি একটি ভাস্কর্য রয়েছে। এই ভাস্কর্যটি কেন নির্মিত হয়েছে কিংবা কি এর নাম এ তথ্য জানেন না হলের কোনো শিক্ষার্থী! এমনকি জানেন না শিক্ষকরাও। হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আফতাব উদ্দিনও বলতে পারেননি ভাস্কর্যটির নাম কি। তবে তিনি জানিয়েছেন ভাস্কর্যটি ১৯৯৪ সালে নির্মিত হয়েছে এবং এটি নির্মাণ করেছেন হামিদুর রহমান। শহীদদের স্মরণে ভাস্কর্যটিতে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর ফুল দিয়ে স্মরণ করা হয় বলেও জানিয়েছেন তিনি। সরেজমিন দেখা যায় ভাস্কটির গায়ে মরিচা ধরে ছিদ্র হয়ে গেছে লাল রঙের প্রলেপেও পড়েছে কালচে আভা। শিগগিরই ভাস্কর্যটি সংস্কার করে এর নামকরণ করা হবে বলেও যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে জানান হল প্রাধ্যক্ষ।

স্মৃতি ৭১ অমলিন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুননাহার হলের প্রবেশ পথে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে সংঘটিত গণহত্যার একটি স্থান রয়েছে। কয়েকটি ইট দিয়ে উঁচু করে সেখানে একটি শ্বেতফলক লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলকের লেখাগুলো অস্পষ্ট হওয়ায় এবং চোখে পড়ার মতো কোনো নিদর্শন বা স্থাপত্য নির্মিত না হওয়ায় নতুন প্রজন্ম জানতে পারছে না এখানে জায়গাটির বেদনার ইতিহাস।

বসুনিয়া তোরণ

বাকশাল সমর্থিত জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রাউফুন বসুনিয়া ছিলেন স্বৈরাচারের আতঙ্ক। তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে স্বৈরাচারবিরোধী এক মিছিলে নেতৃত্বদানের সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে তিনি নিহত হন। তার স্মরণে ওই স্থানেই নির্মিত হয় বসুনিয়া তোরণ। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বসুনিয়া তোরণে অবস্থিত রাউফুন বসুনিয়ার ভাস্কর্যের গায়ে কালি লেগে থাকলেও তা পরিষ্কার করেনি কেউ। উপরন্তু ভাস্কর্যের নাকটা ভেঙে দিয়েছে কেউ একজন!

জয় বাংলা, জয় তারুণ্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ও শামসুন নাহার হলের মাঝে ‘জয় বাংলা, জয় তারুণ্য’ লেখা ভাস্কর্যটি সবার কাছে অত্যন্ত পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী ও ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদ মিজানুর রহমান মিজান স্মরণে ভাস্কর আলাউদ্দিন বুলবুল ১৯৯২ সালে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন। ১৯৯১ সালের ২৭ অক্টোবর সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ অক্টোবর তিনি মারা যান। তার স্মরণে নির্মিত এ ভাস্কর্যটি তরুণদের উজ্জীবিত করে ও প্রেরণা জোগায়। দীর্ঘদিন থেকে ভাস্কর্যটির বেহাল দশা থাকার পর চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি সেটি সংস্কার করা হয়। সাদা রঙের এ ভাস্কর্যটি সংস্কার করার এক বছর পার না হতেই এটির গায়ে শ্যাওলা ধরে নীলাভ বর্ণ ধারণ করেছে। রক্ষণাবেক্ষণ না করলে অল্প সময়ের মধ্যেই ভাস্কর্যটি তার নান্দনিকতা হারাবে।

বিবিধ ভাস্কর্য

শহীদ মিনার আবাসিক এলাকায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি নিদর্শন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঈশা খাঁ রোড আবাসিক এলাকার প্রবেশ পথে শহীদ শিক্ষকদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি ফলক, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের প্রবেশ পথের বাম পাশে শহীদ কর্মচারীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি নিদর্শন, দক্ষিণ ফুলার রোড আবাসিক এলাকার প্রবেশপথে শহীদদের স্মরণে এবং উত্তর ফুলার রোড আবাসিক এলাকার প্রবেশ পথে শহীদ শিক্ষকদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি ফলক থাকলেও এগুলো সম্পর্কে জানেন না অনেকেই। নাম ফলকগুলো অস্পষ্ট এবং ছোট হওয়ায় স্মৃতি নিদর্শন থাকলেও জানার সুযোগ থাকছে না। অন্যদিকে ছোট করে লেখা নামফলকগুলোর দিকে খেয়াল না রাখায় ধুলোবালি জমে তাও ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যে যে ধরনের ত্রুটি রয়েছে এ বিষয়ে আমি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব এবং ক্যাম্পাসের মধ্যে অবস্থিত অন্যান্য স্থাপনার পবিত্রতা বজায় রাখতে সবগুলোর তালিকা করে শিগগিরই সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নোটিশ দেব।

সূত্রঃ যুগান্তর

সর্বাধিক পঠিত