যেভাবে মারা গেলো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইমরান পাভেল!
পরিবারের দাবি ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা মিডফোর্ড হাসপাতালে নেওয়ার সময় প্রাণ হারায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন পাভেল। প্রাথমিক অবস্থায় তার মৃত্যুটি একটি স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে ধরে নিলেও ঘটনার ৭ দিন পর বেরিয়ে আসে মৃত্যুর অন্তরালের ঘটনাগুলো। আসলেই কি পাভেলের স্বাভাবিক মৃত্যু ছিলো? এমন প্রশ্নের উত্তরে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর বহু তথ্য। পাভেলের বাবার দাবি, চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় মারা যায় তার আদরের সন্তান। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী নবগঠিত ফরিদগঞ্জ লাইফ জেনারেল হাসপাতালের ডাঃ খালেদ ইমতিয়াজ দোলনের দেওয়া ভুল ইনজেকশন শরীরে পুশ করায় হৃদকম্পনে পাভেলের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৩ সেপ্টেম্বর পড়ালেখাজনিত কারণে সুস্থ শরীরে হাসিমুখে ঢাকা যায় পাভেল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটস্থ একটি মেসে দীর্ঘদিন ধরে থাকছিলো সে। ঢাকা গিয়েই জ্বরে আক্রান্ত হয় পাভেল। জ্বর যখন কোনোভাবেই কমছিলো না তখন ৭ সেপ্টেম্বর পাভেলের বাবা ফরিদগঞ্জ ম্যাগাজিন হাউজের স্বত্বাধিকারী তাজুল ইসলামকে ফোন দেয় পাভেলের বন্ধু রাশেদ হোসেন। জানায় যে, কোনোভাবেই কমছে না পাভেলের জ্বর। তাকে বাড়ি নেওয়া জরুরি। সেদিনই পাভেলের বন্ধুরা পাভেলকে দুপুর দেড়টায় ময়ূর লঞ্চে করে বাড়ি পাঠায়। পাভেলের বাবা চাঁদপুর লঞ্চঘাট থেকে বাড়ি নিয়ে আসে তাকে।
পরদিন ৮ সেপ্টেম্বর ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয় পাভেলকে। হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক মোজাম্মেল হোসেন প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে নিশ্চিত হন করোনা নয় বরং ভাইরাস জ্বরে ভুগছে পাভেল। তবে জ্বর যে টাইফয়েডে রূপ নেয়নি তাও চেকাপ রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত করেন তিনি। সে অনুযায়ী ডাঃ মোজাম্মেল হোসেন ট্যাবলেট সেফ-৩ ২০০ মিলিগ্রাম, সাপোজিটরি ও কিছু গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ দেন। নিশ্চিত করেন ভয়ের কারণ নেই। নিয়মিত ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।
এ ঘটনার পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর পাভেলের জ্বরের সাথে যুক্ত হলো শ্বাসকষ্ট। প্রায় ১০৪ ডিগ্রি জ্বর আর শ্বাস কষ্ট নিয়ে ৯ তারিখ রোববার আবারো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে (চতুরা হাসপাতাল) ডাঃ মোজাম্মেল হোসেনের কাছে নেওয়া হলে তিনি নেবুলাইজার দেন পাভেলকে। নেবুলাইজারে শ্বাস কষ্ট কমলেও তখনও জ্বর ছিলো ১০৪ ডিগ্রির মত। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী বাড়িতে একটি পৃথক নেবুলাইজার কিনলেন পাভেলের বাবা তাজুল ইসলাম। নেবুলাইজার ব্যবহারে শ্বাসকষ্ট পুরোপুরি কমলেও জ্বর কিছুতেই কমছিলো না। ১১ তারিখ সারাদিন বাসাতেই ছিলো পাভেল। চলছিলো ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ।
পরদিন ১২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার জ্বরের পাশাপাশি জন্মগত হৃদরোগী পাভেলের হৃদকম্পন বেড়ে যায়। পরামর্শের জন্য ফোন করেন মোজাম্মেল ডাক্তারকে। মোবাইল বন্ধ ছিলো তার। দীর্ঘক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও মোজাম্মেল ডাক্তারকে ফোনে না পেয়ে হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হন ডাঃ মোজাম্মেল হাসপাতালে নেই, বর্তমানে চট্টগ্রাম আছেন। পাভেলের বাবা তখন সিদ্ধান্ত নেন পরদিন শনিবার ফরিদগঞ্জ লাইফ জেনারেল হাসপাতালে আসা চিকিৎসক খালেদ ইমতিয়াজ দোলনকে দেখাবেন। তিনি রাতেই কল করে ছেলের অসুস্থতার কথা জানান দোলন ডাক্তারকে। খালেদ ইমতিয়াজ দোলন পরদিন ১২ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় লাইফ জেনারেল হাসপাতালে তার চেম্বারে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন।
সারারাত জ্বর আর বর্ধিত হৃদকম্পনের সাথে যুদ্ধ করে যায় ইমরান হোসেন পাভেল। তার মা, বাবা, ছোট ভাই, বোন কারও চোখেই ঘুম নেই। সকলের প্রত্যাশা রাত পোহাবে কখন? ১২ সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল ১০টায় পাভেলকে নিয়ে যায় ফরিদগঞ্জ লাইফ জেনারেল হাসপাতালে ডাঃ খালেদ ইমতিয়াজ দোলনের চেম্বারে। পূর্ব রাতে কল করে আসা পাভেলের শারীরিক সংকটাপন্ন অবস্থার কথা জেনেও ডাক্তার দোলনের সাক্ষাৎ পাননি তারা। রোগীদের সিরিয়ালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থেকে বিকেল সাড়ে ৩টায় দেখা পান দোলন ডাক্তারের! ততক্ষণে পাভেলের অবস্থা আরও নাজুক। ডাক্তারের নিজের দেওয়া সাক্ষাত সময়ের সাড়ে ৫ ঘণ্টা পর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে পাভেলের শরীরের কম্পন চলে আসে। অতঃপর দোলন ডাক্তার জরুরি দুটি সাপোজিটরি একসাথে শরীরে পুশ করেন। তাৎক্ষণিক তাকে হসপিটাল থেকে একটি ইউআরপি বস্নাড টেস্ট ও এঙ্রে করানোর পরামর্শ দেন।
হসপিটালের এঙ্-রে রুমে চেকআপ ম্যান না থাকায় অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে আরও ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় তাকে। শেষ বিকেলে ডাঃ খালেদ ইমতিয়াজ দোলন পাভেলের প্রেসক্রিপশনে দুটি ইনজেকশান ও এক পাতা নাপা রেপিড ট্যাবলেট লিখে দেন। ইনজেকশান দুটি হলো অ্যাসিফিন ২ গ্রাম, যা প্রতি ১২ ঘণ্টা পর পর ১ বার করে শরীরে পুশ করতে বলেন এবং জেন্টামাইসিন ৮০ গ্রাম, যা প্রতি ৮ ঘণ্টা পর পর ১ বার করে শরীরে পুশ করতে বলেন। দোলন ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশনের উপরে 'রোগী হাসপাতালে ভর্তি হবে' লেখা থাকলেও ভর্তি করানো হয়নি হাসপাতালে।
হাসপাতাল থেকে পাভেলের বাবা তার বাসার নিকটস্থ এবি ফার্মেসীতে ঔষধের জন্য যান এবং এবি ফার্মেসীর স্বত্বাধিকারী কল্লোলকে ইনজেকশন পুশ করতে বলেন। কল্লোল জানান, ইনজেকশনগুলো রগে দিতে হবে, তাই ক্যানুলা লাগাতে হবে। আপনি বিষয়টি ডাক্তারকে জানান। পাভেলের বাবা তাজুল ইসলাম দোলন ডাক্তারকে ফোন করেন। বললেন, আপনার প্রেসক্রিপশনের উপরে লিখা ছিলো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হবে। এখন ভর্তি যেহেতু করায়নি, ছেলের হাতে ইনজেকশনের ক্যানুলাও নেই, তাহলে আমি লাইফ জেনারাল হাসপাতালে নিয়ে আসি ভর্তির জন্য। প্রতি উত্তরে ডাঃ দোলন বলেছিলেন, বিষয়টি ততটা গুরুতর নয়। আপনি কারো হেল্প নিয়ে হাতে ক্যানুলা লাগিয়ে ইনজেকশন দিয়ে দিন। রোগী বাসায়ই থাকুক।
পাভেলের বাবা সন্ধ্যায় ছেলেকে আল-মদিনা হাসপাতালে নিয়ে হাতে ক্যানুলা লাগিয়ে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী হাসপাতালের নার্স দিয়ে ইনজেকশান দুটি পুশ করান। তখনও তার শরীরে জ্বর ১০৪ ডিগ্রির উপরে। বাবার সাথে পাভেল বাড়ি আসে। ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু রাত যত বাড়ছে তত সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে অবনতি হচ্ছে পাভেলের শারীরিক অবস্থার। পরদিন ১৩ সেপ্টেম্বর রোববার দোলন ডাক্তার ঢাকায় অবস্থান করায় তাকে আর দেখানো সম্ভব হয়নি। পাভেলের হৃদকম্পন বেড়ে গেলে পরামর্শের জন্য তার কাছে বহুবার যোগাযোগ করা হয়, কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। সারাদিন পাভেলের মা-বোন পাভেলের সেবা করেছেন। প্রত্যাশা ছিলো ইনজেকশনে বুকের ব্যথা কমবে। কিন্তু দৈনিক ৫ বার দুটি ইনজেকশান পুশ করায় পাভেলকে যে আরো অসুস্থ করে তুলছিলো তা জানা ছিলো না পাভেলের বাবা-মায়ের। রোববার রাত বাড়ার সাথে সাথে পাভেলের চিৎকার তত বাড়ছিলো। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বারবারই বলছিলো, আমার বুকে ব্যথা বাড়ছে। হৃদকম্পন বাড়ছে, দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি এখন কী করবো? তখনও একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছিলেন দোলন ডাক্তারের মোবাইলে। কিন্তু তার নম্বর বন্ধ। কল যাচ্ছিলো না। একদিকে ছেলের কান্না বাবার কানে এসে কাঁটার মত বিঁধছিলো। অপর দিকে দোলন ডাক্তারের নম্বরে কল দিতেই দুঃখিত বলে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলা হচ্ছিলো।
রোববার রাত ২টায় পাভেলের বাবা তাজুল ইসলাম তখন পাগল প্রায়। সিদ্ধান্ত নিলেন সন্তানকে ঢাকা নিয়ে যাবেন। বাসা থেকে বের হয়ে সম্ভাব্য কয়েকজনকে ফোন করলেন অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর আছে কি-না জানতে। কেউ সদর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর দিতে পারেননি। একদিকে দোলন ডাক্তারের মোবাইলে সংযোগের চেষ্টা অন্যদিকে অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর সংগ্রহের চেষ্টা। ততক্ষণে ফজরের আজান হয়। আশেপাশে কোনো গাড়ি না পাওয়ায় পাভেলের বাবা পায়ে হেঁটে রওনা হলেন সদর হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজে। পথিমধ্যে তার এক নিকটাত্মীয় পরামর্শ দিলেন অ্যাম্বুলেন্স না পেলে সকাল ৬টায় প্রথম ট্রিপের লঞ্চে কেবিনে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি তা-ই করলেন। একটি সিএনজি অটোরিকশা সংগ্রহ করে ছেলেকে নিয়ে রওনা হলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। পাভেলের শরীরে তখনও জ্বর ১০৪ ডিগ্রির মত।
সকাল ৬টার লঞ্চ এমভি রফরফ-এর ১১১ নং কেবিনে পাভেলকে শুইয়ে দেন তাজুল ইসলাম। পুরো পথে পাভেল জ্বরের ঘোরে কাতরাচ্ছে আর তাজুল ইসলাম তার শয্যা পাশে বসে দোলন ডাক্তারকে কল করে যাচ্ছিলেন। নদীতে ভাসতে ভাসতে লঞ্চ যখন মুন্সিগঞ্জে পৌঁছলো তখনই পাভেলের বুকে তীব্র ব্যথা উঠলো। ছেলের চিৎকারে বাবা নিজেকে স্থির রাখতে পারছিলেন না। এবার প্রেসক্রিপশনের নম্বর অনুযায়ী কল করলেন লাইফ জেনারেল হাসপাতালের জরুরি নম্বরে। বললেন, ডাঃ দোলনের বিকল্প কোনো নম্বর আছে কি-না। তার ছেলে ভীষণ অসুস্থ, তাকে নিয়ে ঢাকা যাচ্ছেন। হাসপাতাল থেকে জানানো হলো, আপনি ঢাকা যান। ঢাকা গিয়ে পৌঁছলে আমরা দোলন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে জানাবো আপনার কী করতে হবে।
মুন্সিগঞ্জের পর লঞ্চ যখন ঢাকার কাছাকাছি। তখন পাভেল বুকের ব্যথায় অনবরত কাতরাচ্ছে। বাবার কাছে শেষবারের মত জুস খেতে চাইলো সে। বাবা লঞ্চের নিচে গেলেন জুস আনতে। গিয়ে দেখা হলো পাভেলের স্কুল শিক্ষক হাসান গাজীর সাথে। তাকে জানালেন ছেলের অসুস্থতার কথা। জুস নিয়ে দু'জন কেবিনে প্রবেশ করলেন। বুকের তীব্র যন্ত্রণার ভেতরও পাভেল তার শিক্ষককে শ্রদ্ধা জানাতে ভুলেনি। মাথা একপাশ করে স্পষ্ট সালাম দিলেন হাসান স্যারকে। কে জানতো এই সালামটিই তার জীবনের শেষ সালাম হবে? স্যার সালাম নিলেন। বাবা সন্তানকে পরম স্নেহে জুস খাওয়ালেন। তৃষ্ণার্ত সন্তান বাবার হাতে জুস খেয়ে কিছুটা শান্ত হলো। তখনও বুকের ব্যথা কমেনি, তাপমাত্রা কমে শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। সদরঘাটে অপেক্ষারত পাভেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা। ঘাটে গেলেই তাকে নিয়ে যাবে মিটফোর্ড হাসপাতালে। পাভেলের বাবা তখনও অনবরত ডাঃ খালেদ ইমতিয়াজ দোলনের ০১৭১৭৫৪১৪২৩ নম্বরে কল করেই যাচ্ছিলেন। জবাব আসছিলো সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। লঞ্চ যখন সদরঘাটের কাছাকাছি। পোস্তগোলা ব্রীজের কাছে। আর মিনিট পাঁচেক পরই ঘাটে ভিড়বে লঞ্চ। তখনই পাভেল বুকের ব্যথার যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন। বাবার দিকে এক নজর তাকালেন আর মাথা ফেলে দিলেন বালিশের এক পাশে। পাভেল এখন আর কাতরাচ্ছে না, বুকে কোনো কম্পন নেই, মুখে শব্দ নেই, জুস খাবার আকুতি নেই, নাক দিয়ে বের হচ্ছে না নিঃশ্বাস। বাবা নিশ্চিত তার সন্তান আর পৃথিবীতে নেই। সন্তানের লাশ সামনে রেখে বাবা তাজুল ইসলাম তখন চোখে কুয়াশা দেখছেন। ঝাপসা হয়ে আসছিলো তার দু'চোখ। মৃদুভাবে তবুও ডেকেই চলছেন, পাভেলরে? পাভেল? ও পাভেল..? কথা ক বাবা।
ততক্ষণে লঞ্চ ঘাটে ভিড়লো। বাবার বিশ্বাস হাসপাতালে নিলে ডাক্তাররা মিরাকল কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে তুলবেন। হয়তো জ্ঞান হারিয়েছে সে। জ্বরে বেঁহুশ হয়ে গেছে, হাসপাতালে নিলে ঠিকই জ্ঞান ফিরবে। কত শত ভরসা নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে বাবা লঞ্চ থেকে সদরঘাটে নামলেন। পাভেলের সহপাঠীরা শিক্ষক হাসান গাজীসহ নিয়ে গেলেন সদরঘাটের নিকটস্থ মিডফোর্ড হাসপাতালে। জরুরি বিভাগের ডাক্তার দেখে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেন, রোগী মারা গেছেন! বাবা তাজুল ইসলাম তখন নিজের ভিতরের কান্নাগুলো আর আটকে রাখতে পারলেন না। লুটিয়ে পড়লেন লাশের উপর। বারবার মনে পড়ছিলো সন্তানের শেষ কথোপকথনটি, 'আব্বা আমাকে একটু জুস খাওয়ান।'
মুহূর্তেই পাভেলের মৃত্যু সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পাভেলের মা সন্তানহারানোর শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে নিয়ে গত প্রায় ১ সপ্তাহ হাসপাতালে ব্যস্ত ছিলেন তার বাবা তাজুল ইসলাম। গতকাল হাসপাতাল থেকে ফিরেই সাংবাদিকদের জানান সন্তান হারানোর দুঃসময়ের মুহূর্তগুলোর কথা। দাবি করেন অস্বাভাবিকভাবে নয় ডাক্তার খালেদ ইমতিয়াজ দোলনের ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার কারণেই তার সন্তানের মৃত্যু হয়।
পাভেলের মৃত্যু সংবাদ যখন সোস্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে তখন সকাল ১১টার পরে পাভেলের বাবার নম্বরে কল করেন ডাঃ খালেদ ইমতিয়াজ দোলন। তখন কথা বলতে পারেননি তিনি। তারপর থেকে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ডাঃ খালেদ ইমতিয়াজ দোলন সান্ত্বত্মনা সূচক একটি ফোনও দেননি পাভেলের অভিভাবককে। সেই আক্ষেপও ফুটে ওঠে পাভেলের বাবার কথায়।
এ বিষয়ে পাভেলের মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষক হাসান গাজী অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান, পাভেলের বাবার কাছে শুনেই তাকে দেখতে লঞ্চের কেবিনে যাই। ছেলেটার বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্টে দম নিতে পারছে না, তবুও আমাকে সালাম দিতে ভুলেনি। বিছানা থেকে উঠে বালিশে হেলান দিয়ে আমাকে সালাম জানালো, একটু পর ঘামিয়ে উঠলো, বাইরে গিয়ে চেয়ারে বসতে চাইলো, কিছুক্ষণ পর নাকে মুখে লালা বের হয়ে মৃত্যুর কোলে হেলে পড়লো। তবুও আমরা সান্ত্বনা সূচক হাসপাতালে নেই। ডাক্তার মৃত ঘোষণা করার সাথে সাথেই পাভেলের বাবা জ্ঞান হারান। চোখের সামনে ঘটা সে দৃশ্য বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
পাভেলের বাবা বলেন, আমি সারাজীবন পত্রিকার বান্ডেল খুলেছি। অজানা সংবাদ পত্রিকার মাধ্যমে বন্টন করে মানুষকে জানিয়েছি, আর আজ আমার সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ আমি পত্রিকা বন্টন করে মানুষকে জানাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমার শয্যাশায়ী সন্তানের চেহারা দিকে তাকাচ্ছি আর ডাঃ খালেদ ইমতিয়াজ দোলনকে কল দিচ্ছি। তিনি মোবাইল বন্ধ করে রেখেছেন। শনিবার সাড়ে ৫ ঘণ্টা অপেক্ষায় রেখে কেন তিনি আমার ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি দিলেন না? আমার ছেলের হার্টে একটি ছিদ্র আছে জেনেও কেন দোলন ডাক্তার তাকে এত পাওয়ারি ইনজেকশন দিলেন? কেন একজন কার্ডিওলজিস্টের কাছে হস্তান্তর করলেন না? কেন ভালো একটি হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ না দিয়ে বাড়িতে রেখে দিনে ৫ বার দু'টি ইনজেকশন পুশ করার পরামর্শ দিলেন তা আমার জানা নেই। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। আর যেন আমার মত কোনো বাবার বুক খালি না হয়।
এ বিষয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা ডাঃ আশরাফ আহমেদ চৌধুরী বলেন, সাধারণত টাইফয়েড হলে আমরা এসিফিন ২ গ্রাম দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি। এটি হায়ার এন্টিবায়োটিক। তবে পাভেলকে কোন্ প্রেক্ষাপটে, কোন্ রিপোর্টের আলোকে ডাঃ খালেদ ইমতিয়াজ দোলন জেন্টামাইসিনের পাশাপাশি এই ঔষধ দিয়েছেন তা রিপোর্ট না দেখে বলা যাচ্ছে না। তবে ডাঃ খালেদ ইমতিয়াজ দোলন নিঃসন্দেহে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। যেহেতু ছেলেটির হার্টে প্রবলেম ছিলো তা তিনি জানতেন এবং দীর্ঘদিন ধরে জ্বর কমছিলো না, সেক্ষেত্রে তাকে কোনো কার্ডিওলজিস্টের কাছে রেফার করাটাই যুক্তিযুক্ত ছিলো। আমি হলে তা-ই করতাম। চাঁদপুর সদর হাসপাতালেও কার্ডিওলজিস্ট চিকিৎসক আছেন। সেখানে তাকে তাৎক্ষণিক রেফার করলে ছেলেটি প্রোপার ট্রিটমেন্টই পেতো। ভুল চিকিৎসায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র মারা গেছে কি-না এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কার্ডিওলজিস্ট বা বিশেষায়িত ডাক্তারদের বোর্ড গঠন করলে তারা রায় দিতে পারবেন। সকল রিপোর্ট না দেখে, রোগীর গতিবিধি না বুঝে বর্তমান চিকিৎসাকে ভুল চিকিৎসা বলা ঠিক হবে না।
চাঁদপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোঃ সাখাওয়াত উল্যাহ বলেন, ছেলেটির সর্বশেষ রিপোর্টের কপি হাতে পেলে তা পর্যালোচনা করে বলা যাবে সে যথাযথ চিকিৎসা পেয়েছে কি-না। আগামীকাল (আজ) আমার কাছে তার সমস্ত রিপোর্ট নিয়ে আসলে আমি তা দেখে মন্তব্য করতে পারবো। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর এমন মৃত্যু সত্যিই দুঃখজনক।
এ বিষয়ে চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে ডাঃ খালেদ ইমতিয়াজ দোলনের সাথে মুঠোফোনে কথা বলার জন্য বহুবার চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ইমরান হোসেন পাভেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনের দাবি জানায় প্রশাসনের কাছে। পাভেলের স্কুল, কলেজের সহপাঠীরাও বিষয়টি খতিয়ে দেখে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানায়।
ইমরান পাভেলের মৃত্যুতে পৃথক শোকবার্তায় শোক জানিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মিজানুর রহমান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোস্তফা কামাল।
সূত্র : চাঁদপুর কণ্ঠ