• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

মেধাবী ছাত্র ফরহাদের মৃত্যুর দায় নেবে কে?

প্রকাশ:  ০৮ জুলাই ২০১৯, ০৯:১৯ | আপডেট : ০৮ জুলাই ২০১৯, ০৯:৩৬
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

চাঁদপুর সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম সাপদি গ্রামের বাসিন্দা ও ফরক্কাবাদ ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির মেধাবী শিক্ষার্থী ফরহাদ হোসেন অন্তরকে (১৬) প্রেমের পরীক্ষা দিতে গিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। তার এই অকাল মৃত্যুর দায় নেবে কে? অভিভাবক কিংবা সমাজ কেউ কি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবে? তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে সামাজিক অবক্ষয় হয়েছে ঠিক, কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণ করা কার দায়িত্ব? এতোসব প্রশ্নের উত্তর আর এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা রোধ করতে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক আন্দোলন খুবই জরুরি হয়ে পড়ছে বলে সচেতন মহল ও অভিভাবকরা মনে করেন।
ঘটনা সূত্রে ও অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ফরহাদ তাদের বাড়ির কাছেই নানার বাড়ি জমাদার বাড়িতে নানীর কাছে থেকে পড়ালেখা করতো। তার পিতা মোঃ মুনসুর আহেমদ প্রবাসী, স্পেন থাকেন। ২০১৯ সালে ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ফরহাদ এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। ফরক্কাবাদ ডিগ্রি কলেজে একদাশ শ্রেণীতে ভর্তিও হয়।
তার সাথে দীর্ঘদিন প্রেমের সম্পর্ক ছিলো তার নানার বাড়ির স্বপন জমাদারের কন্যা ও ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী মাসুমার (১৪)। অপ্রাপ্তদের এ প্রেমের মধ্যে জড়িয়ে ছিলো আবেগ আর অকল্পনীয় স্বপ্ন। ঠিক এ বয়সে তারা অভিভাবক কিংবা আত্মীয় স্বজন থেকে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত না পেয়ে অজানা পথেই তারা হাঁটতে থাকে। যা ফরহাদ তার ফেসবুক (ঋড়ৎযধফ ঐড়ংংধরহ অহঃড়ৎ) প্রোফাইলে লিখেছে।
অপরদিকে মাসুমা কৌতূহলবশত কিংবা অবক্ষয়ের সমাজ থেকে শিক্ষা নিয়ে ফরহাদকে প্রেমের পরীক্ষা দেয়ার জন্যে বলে। অর্থাৎ ফরহাদ মাসুমাকে কতটুকু ভালবাসে তার পরীক্ষার দেয়ার জন্যে। মাসুমার কথানুযায়ী ফরহাদ কয়েকবার ঘুমের ঔষধ সেবন করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এসব বিষয় উভয় পরিবারের লোকজনই জানতো। সর্বশেষ গত ২৮ জুন মাসুমার পিতা-মাতা ফরহাদের নানার বাসায় গিয়ে ফরহাদকে কঠোর ভাষায় শাসন করে এবং বলে আসে ‘তুমি বিষ খেয়ে মরতে পার না’। সে থেকেই ফরহাদ মনের মধ্যে ক্ষোভ লালন করতে থাকে এবং ওইদিনেই সে বিষপান করে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিষয়টি টের পেয়ে তার নানী ও মাসহ স্বজনরা প্রথমে তাকে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে এনে ভর্তি করায়। এ হাসপাতালে তার ৩ দিন চিকিৎসা চলার পর অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপতালে রেফার করে চিকিৎসক। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফরহাদ গত ৫ জুলাই রাতে মারা যায়। পরদিন ৬ জুলাই শনিবার বাদ আছর নামাজে জানাজা শেষে ফরহাদকে দাফন করা হয়।
ফরহাদের সম্পর্কে নানা মোঃ ইসমাইল জানান, ফরহাদের মৃত্যুর পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়না তদন্ত হয়। সেই তদন্ত রিপোর্ট এখনো পাওয়া যায়নি। হয়তো হাসপাতাল থেকে পরে থানায় পাঠানো হবে। এ ঘটনায় তাদের পরিবার থেকে কোনো ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে তিনি জানান।
ফরহাদের নানী রহিমা বেগম বলেন, আমার নাতি আমার কাছে থেকেই পড়ালেখা করত। এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। একাদশ শ্রেণিতে তাকে ভর্তি করিয়েছি। আমাদের বাড়ির স্বপন জমাদারের মেয়ে মাসুমার সাথে আমার নাতীর প্রেমের সম্পর্ক ছিলো জেনে মেয়ের পিতা-মাতাকে জানাই। তারা কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো ফরহাদকে হুমকি ধমকি দিয়ে শাসিয়ে যায়। তারা আমার ঘরে এসে বলে, ‘হারমাজাদা তোর কোনো সম্পত্তি নেই, তুই কেনো আমার মেয়র সাথে প্রেম করিস’। ২৮ জুন তারা আবার এসে আমার নাতিকে মারধর করে এবং বলে ‘তুই মরিস না কেন? বিষ খেয়ে মর’। এ কথায় অভিমান করেই আমার নাতি বিষ খেয়ে মরেছে।
তিনি আরো বলেন, মাসুমা একাধিকবার ফরহাদ হোসেনকে বলেছে, আমাকে ভালোবাসো সেটার প্রমাণ দাও। এটা শুনে ফরহাদ একাধিকবার ঘুমের ঔষধ খায়। এ ধরনের ঘটনা মেয়ের বাবা স্বপন জমাদার জেনেও মেয়েকে শাসন করেনি কিংবা কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি বরং উল্টো আমার নাতিকে হুমকি দেয়।
রহিমা বেগম আরো বলেন, ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর এলাকার বাসিন্দা ও নয়াহাট কলেজের প্রভাষক মোহাম্মদ হোসেন আমাকে চাপ দেন যেনো ঘটনাটি কোনো সাংবাদিককে জানানো না হয়। যদি জানানো হয়, তাহলে তাদের সমস্যা হবে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্যে মাসুমাদের বাড়িতে গেলে তার পিতা স্বপন জামাদার সাংবাদিক দেখে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন। যার কারণে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে ফরক্কাবাদ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ হাসান খান বলেন, ঘটনাটি আমরা পরে জেনেছি। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। এ ধরনের ঘটনায় উভয়পক্ষের অভিভাবক দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। এটি একটি সামাজিক অবক্ষয় বটে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েকে এ ধরনের অবস্থায় অভিভাবকদের খোলামেলা কথা বলা প্রয়োজন। তাদেরকে বুঝিয়ে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। আর না হয় এ ধরনের ঘটনা বার বার ঘটতে থাকবে। সামাজিকভাবেও আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিত।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পদোন্নতিপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার) মোঃ মিজানুর রহমান ঘটনাটি জেনে খুবই দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনায় পিতা-মাতাকেই ভূমিকা নিতে হবে। কারণ তার সন্তান কোথায় থাকে, কী করছে, কার সাথে মিশছে এসব বিষয় পিতা-মাতাই সবার আগে জানেন। আর সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা খুবই প্রয়োজন। পরিবার থেকেই তারা নৈতিক শিক্ষাগ্রহণ করে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই শেখার অনেক কিছু আছে, তবে তা সীমিত আকারে। মূল ভূমিকা পরিবার থেকেই আসবে। এ ধরনের ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। কিন্তু মূলত সন্তান যখন বড় হয়, তার শারীরিক ও আচরণগত পরিবর্তন আসে, তখনকার সময়টা বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন। পিতা-মাতাকে কোনো ধরনের লজ্জা কিংবা জড়তার মধ্যে না থেকে সন্তানের বন্ধু হতে হবে। এখন সময় হয়েছে সমাজের মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা  এবং সকলেই এগিয়ে আসা।
তিনি আরো বলেন, ফরহাদের মৃত্যুর ঘটনাটি খুবই করুণ। সে একজন মেধাবী ছাত্রছিলো। তার কাছ থেকে জাতি অনেক কিছু পেতো। পারিবারিক কাউন্সিলিং না থাকায় একটি মেধাবী ছাত্রের মৃত্যু হলো।