• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

মায়ের খোঁজে আহাজারি কোহিনুরের তিন সন্তানের

স্ত্রীকে হারিয়ে সন্তানদের চিন্তায় প্রবাসী পিতার করুণ দিনযাপন

প্রকাশ:  ২৭ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:০৬
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

এ এক অমানবিক ঘটনা। সম্প্রতি শাহরাস্তিতে সংঘটিত কোহিনুর হত্যাকা-ের পর তার সন্তান এবং স্বামী দিশেহারা অবস্থায় করুণ জীবনযাপন করছেন। কোহিনুরের তিন শিশু সন্তান তাদের মায়ের খোঁজে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে।
মাত্র ৪ বছর বয়সী কোহিনুরের ছোট মেয়ে কামরুন্নাহার লিজা। মৃত্যু কী তা বোঝার আগেই মাকে হারালো সে। খাওয়ার সময় তার মা আর তাকে ডাকছেন না, দুপুরের গোসল, আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছেন না, কিছুক্ষণ পর পর লিজা বলে আর ডাকছেন না। মা কোথায়-কিছুক্ষণ পর পর মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে লিজা। মাকে খোঁজ করলেই লিজার দাদী মাকসুদা বেগম তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত¡না দিচ্ছেন। মা কাজে গেছেন, চলে আসবে। আর কত সান্ত¡না, আর কত অপেক্ষার পালা লিজা জানে না। অথচ তার মা আর কোনো দিনও তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবেন না, আদর করে খাইয়ে দিবেন না, দুষ্টুমি করলে আর তাকে বকা শুনতে হবে না।
কোহিনুরের সন্তানদের চোখে টলমল করছে জল। কোহিনুরের বড় মেয়ে মুক্তা আক্তার ভাটনী খোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণীতে পড়ছে। কয়েক দিন ধরে সে স্কুলে যায় না। মায়ের হত্যা সম্পর্কে তার কিছুটা ধারণা থাকলেও তার বিশ^াস, তার মা আবার ফিরে আসবে। তাদের আদর করে চোখের পানি মুছে দিবে। হঠাৎ হঠাৎ করে মায়ের জন্যে কেঁদে উঠছে মুক্তা। সুযোগ পেলেই মায়ের কবরের পাশে গিয়ে মাকে যেনো দেখে আসছে মুক্তা।
কোহিনুরের একমাত্র ছেলে তারেক হোসেন। টামটা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র। মায়ের হত্যার ঘটনার চিত্র আজও তার চোখে ভাসছে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মাকে শেষ বিদায় দেয় তারেক। মায়ের কবর বাড়ির সামনেই, কিছুক্ষণ পরপর সেই কবর দেখে আসে সে। চোখে মুখে অন্ধকার ; মা-হারা পৃথিবী কেমন তা শুধু তারেকই বুঝতে পারে।
কোহিনুরের স্বামী সৌদী আরব প্রবাসী আরিফুল ইসলাম, এক সময় রিক্সা চালিয়ে জীবন-যাপন করতেন। প্রায় ১৬ বছর পূর্বে কোহিনুরের সাথে তার বিবাহ হয়। তাদের অনেক কষ্টের সংসার, বাড়িতে দোচালা টিনের ঘর। বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করে এর আগে দু’বার বিদেশে গিয়েছিলেন। ভগ্যের নির্মম পরিহাসে সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেননি। অবশেষে তার এক ভাই তাকে বছর খানেক পূর্বে সৌদি আরবে নিয়ে যান। বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন আরিফ। কাজের বেতন তেমন করে পাচ্ছেন না। স্ত্রী হত্যার সংবাদ শুনে দেশে আসার জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকায় আসতেও পারছেন না। প্রতিদিন খোঁজ-খবর নিচ্ছেন সেখান থেকেই। একদিকে স্ত্রী পরপারে অন্যদিকে দেশের মাটিতে মা-হারা তিন সন্তান। চোখে মুখে আরিফুলের শুধুই অন্ধকার। মাকে হারিয়ে বাবার চেহারাটুকুও দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে না বুঝ জ্ঞান না হওয়া আরিফের সন্তানদের।
আরিফের মা মাকসুদা বেগম সারাক্ষণ কান্না করে দিন পার করছেন। আরিফের ভাই শরীফ আলম একজন দলিল লেখক। নিজের সন্তানদের মত ভাইয়ের সন্তানদের লালন-পালন করার  জন্যে সব সময় পাশে থাকার কথা জানালেন। সেই সাথে কোহিনুরের ভাইদের সহযোগিতার কথা স্মরণ করেন শরীফ।
গত ১৮ এপ্রিল রাত ২টায় সিঁদ কেটে জহির নামে বাড়ির সম্পর্কের এক ভাসুর ঘরে ঢুকে ছুরি দিয়ে জখম করে কোহিনুরকে। তিনদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার পর অবশেষে ২২ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোহিনুর মৃত্যুবরণ করেন।
একটি ঘটনার জের ধরে হত্যা করা হয় কোহিনুরকে। শুধুমাত্র ভাসুরের জেদের বশবর্তী হয়ে কোহিনুর প্রাণ হারান। ঘাতক জহির ছোটবেলা থেকেই উশৃঙ্খল, তার স্ত্রী লাকি বেগম তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে তালাক দেয়। তালাকের এক বছর পর কোহিনুর তার ভাইয়ের বৌ করে লাকিকে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়। সেই থেকেই জহির লাকির পিছনে লাগে। মাঝে মধ্যে হুমকি-ধমকি দিলেও বাড়ির লোকজন তা তোয়াক্কা করেনি। এ ঘটনার খেসারত এভাবে প্রাণের বিনিময়ে দিতে হবে তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি।
মামলার প্রধান আসামী জহিরকে এখনো আটক করতে পারেনি পুলিশ। পরিবারের দাবি, জহিরকে আইনের আওতায় এনে ফাঁসি দিলে কোহিনুরের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।