• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

ফরিদগঞ্জে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে পরকীয়া

ভাঙছে সংসার ॥ ঘটছে খুনের মতো ঘটনাও

প্রকাশ:  ১২ মার্চ ২০১৯, ১০:১৭
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

ফরিদগঞ্জে পরকীয়ার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। পরকীয়ায় জড়িয়ে একাধিক খুনের ঘটনাও ঘটেছে এ উপজেলায়। স্বামীর হাতে স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের শিকার হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পরকীয়ার বলি হচ্ছে তৃতীয় কেউ। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন সামাজিক বন্ধনে চিড় ধরা, অস্থিরতা ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও টানাপড়েনে আপনজনকে খুনের সংখ্যা বেড়েই চলছে। তবে এর পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে হতাশা, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যাওয়া, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারিবারিক বন্ধন জোরদার করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়ানোর পাশাপাশি চাহিদা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান কমাতে হবে। সমাজে বিজ্ঞজন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা এবং গণমাধ্যমও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করেন তারা।
ফরিদগঞ্জে বেশ কয়েক বছর ধরে পরকীয়ার সাথে জড়িত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। স্বামী, সংসার এমনকি প্রাণের টুকরা সন্তানকে রেখে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। দুই তিন সন্তানের মায়েরাও প্রেমিকার হাত ধরে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। তবে পরকীয়ার ক্ষেত্রে প্রবাসীদের স্ত্রীদের প্রবণতা বেশি। অনেক যুবককে দেখা গেছে বিয়ে করার কয়েকদিন পরই বিদেশ চলে যায়। ২/৩ বছর পর তারা দেশে ফিরে। কারণ ইসলাম ধর্মে স্পষ্টভাবে বলা আছে ৪০ দিনের বেশি স্ত্রী থেকে দূরে না থাকা। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ফরিদগঞ্জের ১নং বালিথুবার দেইচর গ্রামে পুত্রবধূর পরকীয়া প্রেমিকার সাথে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক দেখে ফেলায় প্রেমিক কর্তৃক শাশুড়ি খুন হন। ২৮ এপ্রিল ফরিদগঞ্জের গোবিন্দপুরে পরকীয়ার টানে ৯ মাসের শিশু সন্তান রেখে পালিয়ে গেলো সালমা বেগম নামের নিষ্ঠুর এক মা। গত বছরের ২২ মে ফরিদগঞ্জের চরমান্দারী গ্রামে প্রেমিকের হাত ধরে প্রবাসীর স্ত্রী উধাও হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একই বছরে ৭ জুলাই উপজেলার সুবিদপুর পশ্চিম ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামে তিন মাসের শিশু সন্তানকে রেখে সুমি বেগম নামের গৃহবধূ পালিয়েছে।
সচেতনরা বলছেন, আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটি দিন দিন কমে যাচ্ছে। আর সে সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধন অটুট রাখতে হবে। স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে প্রচুর সময় দিতে হবে। একই সঙ্গে সন্তানদের প্রতিও যতœবান হতে হবে। স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে যায় সেক্ষেত্রে ভালোবাসার মাধ্যমেই তাদের ফেরাতে হবে।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, পরকীয়া এক ধরনের সম্পর্ক। কিন্তু এটা আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে কিংবা ধর্মীয় মূল্যবোধের জায়গা থেকে গ্রহণ করতে পারি না। আইনের দিক থেকে জোরালো কোনো বাধা না থাকলেও সামাজিকভাবে এর বড় একটা বাধা রয়েছে। একই সমাজে চলতে গেলে কারো প্রতি ভালো লাগা বা মন্দলাগা তৈরি হতেই পারে। তবে যদি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে অন্য কোনো সম্পর্ক চলে আসে তাহলে সেটা নিয়ে ঝামেলায় না গিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা উচিত।
পরকীয়া সম্পর্ক নতুন কোনো বিষয় নয়! বর্তমান বিশ্বের পাশাপাশি আমাদের দেশেও এখন এর প্রবণতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে মোবাইল ফোন, ফেসবুকসহ নানা প্রযুক্তি মানুষের হাতের মুঠোয়, তাই আজকাল পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে তোলা অনেক সহজ। বেশির ভাগ পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে উঠে নারী বা পুরুষের শারীরিক ও মানসিক চাহিদা মেটানোর জন্য। আমাদের সমাজে এমন কি ধর্মেও এই পরকীয়া সম্পর্ককে অবৈধ সম্পর্ক হিসেবে বলা হয়েছে। কিন্তু কখনো কি আমরা এটা জানার বা বুঝার চেষ্টা করেছি যে, কেন আমাদের সমাজে এই সম্পর্কের হার বেড়ে গেছে? নারী বা পুরুষ তাদের বিবাহিত জীবন নিয়ে কি সন্তুষ্ট নন? এর উত্তর হচ্ছে, আমরা নিজেরাই প্রধানত দায়ী। আমাদেরই বেশ কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আজ এই পরকীয়া সম্পর্কের হার বেড়ে গেছে এবং ঘরে ঘরে তালাক বা ডিভোর্স হচ্ছে। সমাজতাত্ত্বিকরা এর ভালো বিশ্লেষণ করতে পারবেন। তবে বিগত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখে কয়েকটা কারণ উল্লেখ করা যায়।
অল্প বয়সে বিয়ে : আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেক তরুণ তরুণী কম বয়সে বিয়ে করে ফেলে। এই সময়ে ছেলে বা মেয়ের মধ্যে মানসিক বুদ্ধি-চিন্তা কাজ করে না। যুক্তির চেয়ে আবেগই বড় হয়ে দেখা দেয়। যার কারণে বিয়ের কিছুদিন পরই সেইসব স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন রকমের মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এবং এই সময়েই সেই স্বামী বা স্ত্রী পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ফলে, একসময় এই বিবাহিত জীবন ডিভোর্স এর পর্যায়ে চলে যায়। গ্রামের অভিভাবকরা এখনো টাকাওয়ালা ছেলে ফেলে বিশেষ করে প্রবাসী ছেলের হাতে নিজের অপ্রাপ্ত মেয়েকে তুলে দিচ্ছেন।
শারীরিক সমস্যা : বিবাহিত জীবনে এটি হচ্ছে প্রধান সমস্যা। এই সমস্যাটি তখনই দেখা দেয়, যখন স্বামী ও স্ত্রী সমবয়সী হয় অথবা স্বামীর থেকে স্ত্রী যদি বয়সে বড় হয়ে থাকে। যার কারণে সে সব স্বামী বা স্ত্রী বাইরের অন্য কারো সাথে পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে।
ভুল মানুষ নির্বাচন করা : মূলত এই সমস্যাটি বেশি দেখা যায় স্যাটেল ম্যারেজ বা অভিভাবকের পছন্দানুযায়ী বিয়ে করার ক্ষেত্রে। অনেক সময় অভিভাবকরা তাদের নিজেদের কথাই ভাবেন এবং ভাল-মন্দ কোনো কিছু না দেখে-শুনে অনেক তাড়াহুড়ো করেই তাদের সন্তানদের বিয়ে দিয়ে দেন। ছেলে-মেয়ের পছন্দ বা মতামতকে তারা প্রাধান্য দেন না। যার ফলে এসব ছেলে-মেয়ের বিবাহিত জীবন সুখের হয় না। আর তখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পরবর্তীতে তারা পরকীয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
দ্রুত অভিভাবক হওয়া : বিয়ের পর স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে মধুর সম্পর্কে তখনি ব্যাপক পরিবর্তন আসে, যখন তারা অভিভাবক হয়ে যান। একটা সন্তান পরিবারে আসার পর মূলত সন্তানদের দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। সন্তানদের নিয়ে অতি ব্যস্ত থাকার কারণে স্বামী-স্ত্রী কেউই একে অপরকে সময় দিতে পারছে না। যার কারণে আগের মত সেই মায়া, ভালবাসা থাকে না। তখনই সে সব পুরুষ বা নারীদের মন বাইরে চলে যায় অর্থাৎ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে নারীবাদী সংগঠন ‘ধ্রুপদী’র আহ্বায়ক কবি ফাতেমা আক্তার শিল্পী বলেন,‘ ধর্মীয় অনুশাসন থেকে আমরা দূরে থাকার করণেই পরকীয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া দীর্ঘ সময় ভৌগোলিক দূরত্বও সম্পর্ককে হালকা করে দেয়। এ সুযোগই নারী পুরুষ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। সমবয়সী অথবা বয়সের অতি ব্যবধান এবং বাল্য বিয়েও এর অন্যতম কারণ।’

সর্বাধিক পঠিত