নারী শুধু একজন মা নন সফল উদ্যোক্তাও
নারী কখনো একজন মা, কখনো কন্যা কিংবা কখনো স্ত্রী রুপে দাঁপিয়ে বেড়ায় এই জগত সংসার। শিক্ষাদীক্ষার সর্বোচ্চ দ্বারে পৌঁছে যাওয়া অনেক নারীরা সময়ের হিসাবে বন্দী ক্যারিয়ারে জড়াতে চান না আজকাল। কিংবা সংসার আর সন্তানের দেখভাল করা, কিংবা সন্তানকে ঘরে রেখে যাবার মতো পরিস্থিতি না থাকার দরুন বাইরে কাজ করার সুযোগ ও অনেক নারীর হয়ে উঠে না। কেউ বা অল্প বয়সে বিয়ে এবং বাচ্চা হবার জন্য, কিংবা পারিবারিক কিছু বিধিনিষেধের কারনেও ক্যারিয়ার শুরু করতে পারেন না।
বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ আর দশটা কাজের মতো বিজনেসের পালেও হাওয়া দিয়েছে। নারীরা ঘরে বসেও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সংসার, সন্তান আর অন্য সব দায়িত্ব কর্তব্যের পাশাপাশি নিজের শ্রম আর মেধা খাটিয়ে অনলাইন বিজনেস সেক্টরে নারীরা এগিয়ে আসছেন ,হয়ে উঠেছেন সফল উদ্যোক্তা।
একজন মা তার সন্তানকে যতটা আদর, যত্ন আর ভালোবাসা নিয়ে বড় করে তুলেন, ঠিক ততটাই আদর, যত্ন আর ধৈর্য্যৈর পরিচয় দেন নিজের কাজের জায়গায়তেও।
নারী অন্যান্যা, অপরিসীম ধৈর্যের প্রতীক। সন্তান জন্মদানের ব্যথার মতো তীব্র ব্যথা নারী মুখ বুজে যেমন সহ্য করার ক্ষমতা রাখেন তেমনি পারিবারিক, সামাজিক আর পারিপার্শ্বিক সকল বাঁধা বিঘ্ন কাটিয়ে ধীরে ধীরে একটি সন্তানের মতোই তিনি তার উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যান।
শিক্ষা,প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের প্রসারতার এ যুগে নারী ঘরে বসেও তার মেধার স্বাক্ষর রাখার সুযোগ পাচ্ছেন অনলাইন সেক্টরের কারনে । সরকারের সহযোগিতামূলক কার্যক্রম, ফেসবুকের পেজের মত অনলাইন মাধ্যমের কারনে ঘরে বসেই নারী তার নিপুণ হাতের কাজ সারা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারছেন।কাপড়ে হাতের কাজ,রান্নাবান্না, ক্রাফটিং, পেইন্টিং, বেকিং,এমনকি শখের ফুলের গাছ কিংবা অর্নামেন্টাল মাছ এসব নিয়ে ও নারীরা আজ বিজনেস করছে।
কেউ করোনাকালীন একটা টানাপোড়েনের মধ্যে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছেন,কেউ শখের বশেই কাজে নেমে আজ পুরোদস্তুর উদ্যোক্তা আবার কেউ বা নয়টা পাঁচটার গৎবাধা নিয়ম থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই বেছে নিয়েছেন উদ্যোক্তা জীবন। সারা দেশে কয়েক লক্ষ পুরুষ উদ্যোক্তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারী উদ্যোক্তারাও কাজ করছেন, অবদান রাখছেন এদেশের অর্থনীতিতে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই নারীরা কাজে নামলেও সরকারি, বেসরকারি নানা ধরনের প্রশিক্ষণ অনলাইন এবং অফলাইনের মাধ্যমে নিয়ে নিজেদের মেধা আর যোগ্যতাকে আরও শানিত করে তুলেছেন। সারা দেশের উদ্যোক্তাদের মত চাঁদপুরের নারী উদ্যোক্তারাও পিছিয়ে নেই। নিজের মেধার আর যোগ্যতার প্রমাণ রেখে চলেছেন বিজনেস সেক্টরে। নিজের পাশাপাশি আরও অনেক নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন তারা। চাঁদপুরের নারীরা শুধু যে কেবল কাপড় কিংবা খাবার নিয়ে কাজ করছেন তা নয় , কাঁচা মাছ বিশেষ করে ইলিশ মাছ নিয়েও কাজ করছেন তাঁরা। বিজনেসের পাশাপাশি তাঁরা নিজেদের সংসার এবং সন্তান ও সমানতালে প্রতিপালন করছেন। অনেকেই সরকারের নানা ধরনের আর্থিক সহযোগিতা ও পাচ্ছেন।
শুরুটা ঘর থেকে হলেও আজ অনেকেই নিজেদের পন্য নিয়ে আউটলেট দিয়েছেন। ব্যবসার গন্ডি হয়েছে বড়। স্বামীর পাশাপাশি সংসারের আর্থিক দায়িত্ব ও তারা নিচ্ছেন। সন্তান তাদের কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি।বরং চব্বিশ ঘন্টা সময়কে আরও প্রোডাক্টিভ করে তুলেছেন কর্মব্যস্তায় । একা হাতে সন্তানের দেখাশোনা, সংসারের অন্যান্য সকল কাজ আর ব্যবসার জন্য বাইরের কাজ ও তারা নিজেরা করছেন। চ্যালেন্জিং পণ্য নিয়ে কাজ করতে ও পিছু হটছেন না তারা। চাঁদপুর হলো ইলিশের রাজধানী। ইলিশের মতো সেনসিটিভ পণ্য নিয়ে কাজ করছেন উদ্যোক্তা বোনেরা।
রোকেয়া আক্তার প্রীতি
মাছ নিয়ে কাজ করছেন চাঁদপুরের নারী উদ্যোক্তা রোকেয়া আক্তার প্রীতি। শুরুটা ইলিশ মাছ নিয়ে হলে ও বর্তমানে সব ধরনের মাছ নিয়ে কাজ করছেন তিনি। ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে দিয়েছেন নিজের আউটলেট, ক্রেতারা অনলাইনের পাশাপাশি সেখানে চোখে দেখেও মাছ কিনতে পারেন। এ উদ্যোক্তা ঢাকার ইডেন কলেজে অনার্সে পড়ছেন, পাশাপাশি তিনি এক সন্তানের জননী। স্বামী, সংসার, সন্তান , পড়াশোনা আর উদ্যোগ একা হাতে সামলাচ্ছেন সব। এমনকি তিনি ঢাকায় আউটলেট দিলেও প্রতি সপ্তাহেই চাঁদপুরে এসে নিজে মাছ সংগ্রহ করেন। কারন তাজা ফিশ নামের পেজে তিনি গ্রাহককে তাজা মাছ দেবার অঙ্গীকার করেছেন।
ফাতেমাতুজ জোহরা বন্যা
ইলিশ নিয়ে আরও কাজ ইলিশতনয়া পেজের উদ্যোক্তা ফাতেমাতুজ জোহরা বন্যা। ইলিশ সরাসরি ঘাট থেকে সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে ডেলিভারীর কাজ ও করে থাকেন নিজেই। অনলাইন পেজের মাধ্যমে চাঁদপুরের ইলিশ সারাদেশে তিনি সরবরাহ করেন। ঢাকার উত্তরায় দিয়েছেন মাছের আউটলেট,যেখান থেকে ক্রেতা সরাসরি মাছ কেনার সুযোগ পাবেন। চাঁদপুর সরকারি কলেজে অনার্সে পড়ার পাশাপাশি তিনি একজন কন্যা সন্তানের জননী। সন্তান যার কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি, বরং সন্তানকে সাথে নিয়ে সব করছেন। চাকরির কারনে স্বামী চাঁদপুরের বাইরে থাকার কারনে একা হাতেই সংসার,সন্তান, পড়াশোনা আর উদ্যোগের কাজ করছেন সমানভাবে।
নারীরা শুধু নিজের কথা ভাবে তা নয়। বিজনেস করতে এসে নারী একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন ও অনুভব করে। একই ছাদের নিচে নিজেদের সমমনা সব বোনদের নিয়ে একসাথে এগিয়ে চলার কথা ভাবেন দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে কাজ করা গৃহাঙ্গনের স্বতাধিকারী জেসমিন নাসরিন। শুরুটা আর দশজনের মত অল্প কিছু জিনিস দিয়ে হলেও বর্তমানে তিনি চাঁদপুরে একটি আউটলেট চালাচ্ছেন। দীর্ঘদিনের অফলাইন বিজনেসের পাশাপাশি বর্তমানে অনলাইনে ও সরব তিনি। চার সন্তানের এ জননী স্বামীর অসুস্হতায় সংসারের পাশাপাশি বিজনেস সামলাচ্ছেন দক্ষ হাতে। নানা জায়গা ঘুরে বিজনেসের পন্য সংগ্রহ করেন তিনি নিজে । কাজ করতে গিয়ে যখন হোঁচট খেতে লাগলেন তখনই অনুভব করলেন নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি ব্যবসায়িক ছায়াতল প্রতিষ্ঠা করার। সে লক্ষেই তিনি উইমেন চেম্বার অফ কমার্সের চাঁদপুর শাখা গঠনের কাজ শুরু করলেন, বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের সহ সভাপতি।
তানিয়া ইসলাম
তানিয়া ইসলাম, একাধারে একজন নারী উদ্যোক্তা, একজন নারী সমাজসেবী। ড্রেস ও কসমেটিকস নিয়ে সবাই মিলের অনলাইন ও অফলাইনের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, পাশাপাশি সবাই মিলে ফাস্ট ফুড ও কফি শপ ও পরিচালনা করেছেন। তিনি এক সন্তানের জননী, সন্তানকে দেখাশোনা ও নিজের উদ্যোগ দুটো কাজই পাশাপাশি দক্ষ হাতে পরিচালনা করেছেন। পাশাপাশি নানামুখী সামাজিক কাজের সাথে জড়িত। নিজের আউটলেটে অনলাইনে কাজ করছেন এমন ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের পণ্য প্রদর্শনের সুযোগ দিয়ে থাকেন। অনেক নারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন যাতে করে তারা স্বাবলম্বী হতে পারেন।প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে কাজে উৎসাহ দেওয়াই সবাই মিলের কাজ। সবাই মিলে একটি নারী উদ্দ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান।
তানিয়া ইশতিয়াক খান
তানিয়া ইশতিয়াক খান, আমরা বিজয়ী সংগঠনের সভাপতি ও খানস ধাবার স্বত্বাধিকারী। খাবার নিয়ে করোনাকালীন শুরুটা অনলাইনে হলেও পরবর্তীতে তিনি একটি ফাস্ট ফুড আউটলেট দিয়েছেন। এছাড়া নিজ সংগঠনের মাধ্যমে নারীদের তিনি প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। অনেক নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করেছেন, প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। নিজে স্বাবলম্বী হবার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য নারীদের স্বাবলম্বী হবার পথ দেখাচ্ছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন নানা পুরষ্কার ও। ব্যাক্তিজীবনে দুই কন্যা সন্তানের জননী এই নারী উদ্যোক্তা স্বামী, সংসার, সন্তান,উদ্যোগ আর নিজের সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন একা হাতে।
কানিজ ফাতেমা প্রিয়া মানামা
কানিজ ফাতেমা প্রিয়া মানামা একজন সফল নারী উদ্যোক্তা।যিনি চাঁদপুর জেলার প্রথম নারী উদ্যোক্তা। যিনি একসাথে একটি পোশাক ব্রান্ড ডিভাস স্টাইল এবং দ্যা রুফ ক্যাফে রেস্টুরেন্টের সত্ত্বাধিকারী। নিজ উদ্যোগের পোশাক ডিজাইন থেকে শুরু করে অন্যান্য উদ্যোক্তাদের উদ্যাক্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।তিনি আর্ট অফ ডিভা ফাউন্ডেশন এর প্রেসিডেন্ট এবং কাজ করছেন তরুন যুবক ও নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে।বতমানে তিনি অন্ট্রোপ্রিনিয়রস ক্লাব অব বাংলাদেশ এর ওমেন্স ফোরাম এর চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং ই কমার্স এসসিয়েশন অব বাংলাদেশ(ই-ক্যাব) এর কমার্স এলিয়্যান্স এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর। সরকার থেকে পেয়েছেন উদ্যোক্তা গ্রান্ট। ব্যক্তিজীবনে দুই সন্তানের জননী তিনি। বিএসসি ইলেকট্রনিক এবং টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনা শেষ করা এ উদ্যোক্তার ফ্যাশন ডিজাইনিং এ আছে পেশাগত ডিগ্রি। জয়ী সন্মাননা, পদ্মা ব্যাংক পাওয়ার ওমেন , এবং সাউথ এশিয়ান বিজনেস এক্সিলেন্ন্স আওয়ার্ড, সাউথ এশিয়ার ১০০ সেরা নারী উদ্যাক্তা হিসেবে সন্মানিত হয়েছেন গুণী এই উদ্যোক্তা।
ইরা খান ইশা
ইরা খান ইশার পিঠাঘরের সত্ত্বাধিকারী। কাজ করছেন হাজীগঞ্জ সদর উপজেলাতে। খাবার নিয়েই যিনি নিজ ক্যারিয়ার গড়েছেন।সারা বছর ব্যস্ত সময় কাটে, কখনো কেক, কখনো পিঠা, কখনো শাহী ভোজন থালি। বিনামূল্যে দরিদ্র ও অসহায়দের বেকিং শিখান তিনি। এক ছেলে এক মেয়ের জননী এই উদ্যোক্তার হাতের জাদুতে মোহগ্রস্ত ক্রেতারা। উপজেলা শহরে অনেক অনেক রেস্টুরেন্টের ভীড়ে নিজেকে দাঁড় করানোর মতো কঠিন কাজে সফল তিনি।
পূর্ণিমা রায়
পূর্ণিমা রায় উইমেন এন্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট এর চাঁদপুরের জেলা প্রতিনিধি । খাবার পন্য নিয়ে কাজ করছেন হাজীগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রাম বলাখাল থেকে। দুই সন্তানের এই জননী জয়ী এওয়ার্ড পেয়েছেন কাজের স্বীকৃতি হিসেবে। নারকেলের তৈরি নাড়ু নিয়ে যার কাজ, তার পণ্য পৌঁছে গেছে দেশ ও দেশের বাইরে। সংসারের হাল ধরেছেন স্বামীর পাশাপাশি। গড়েছেন নিজের ওয়েবসাইট, সরকার থেকে পেয়েছেন উদ্যোক্তা গ্রান্ট। স্বপ্ন দেখেন একদিন উদ্যোগ বড় হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে অনেকের।
নারী যদি সঠিক পরিবেশ ও পরিবার থেকে মানসিক সাপোর্ট পান তাহলে নয়টা পাঁচটার ডেস্ক জব হোক আর উদ্যোক্তা জীবন হোক দুটোতেই সফল হতে পারেন। উদ্যোক্তা জীবন অনেক কঠিন, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সময়ের, কথার ও কাজের হেরফের হলে কাস্টমার অন্য পেজে চলে যান।সেই কঠিন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কাজ, সংসার, সন্তান সব সমান্তরালে রেখে, নিজেকে ভালো রেখে যারা কাজটাকে এগিয়ে নিতে পারছেন তারাই আজ সফল।
সফলতার সংজ্ঞা,ব্যাখ্যা নানা জনের কাছে নানা রকম। নারীদের জীবনে বাঁধা বিপত্তির শেষ নেই,সেসব ডিঙিয়ে, যারা কাজ নিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলছেন সকলেই সফল। সফলতার সীমা নেই। একটার পর একটা প্রাপ্তিই আমাদের সফল করে তোলে। সে হিসেবে সংসার, সন্তান,উদ্যোগ তিনটা কাজ একই সমান্তরালে চালানো সফলতার ধাপ অবশ্যই। এসব উদ্যমী নারী উদ্যোক্তাদের থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। সরকার ও তাদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সহযোগিতা করছেন। যাতে নিজ উদ্যোগ নিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পারেন।