‘তোর মেয়রগিরি ছুটাচ্ছি’
হাঁটার জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে পার্কের কাছে পৌঁছতেই কালো রঙের হাইয়েস মাইক্রোবাসের দরজা খুলে একজন ‘এই ছেলে’ বলে আমাকে ডাক দেয়। আমি একটু এগোতেই দুজন অচেনা লোক আমাকে ছোঁ মেরে গাড়িতে তুলে নেয়। গাড়ির দরজা বন্ধ হতেই এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারতে থাকে, চোখ বেঁধে ফেলে। আর বলতে থাকে, তোর মেয়রগিরি ছুটাচ্ছি। তারা আমাকে জোর করে তরল কিছু খাইয়ে দেয়। আমি অচেতন হয়ে পড়ি। যখন কিছুটা চেতনা ফেরে তখন আমি নিজেকে অচেনা জায়গায় আবিষ্কার করি।
এরপর থানা, হাসপাতাল হয়ে এখন নিজের বাসায় বিশ্রামে আছি। অপহরণের শিকার জামালপুরের সরিষাবাড়ীর পৌর মেয়র মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান রুকন ৬০, গাউসুল আজম এভিনিউয়ের বাসায় বসে গতকাল বুধবার এসব কথা বলেন। গত ২৫শে সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের খেলার মাঠের সামনে থেকে অপহরণের শিকার হন তিনি। ২৭শে সেপ্টেম্বর শ্রীমঙ্গল থেকে উদ্ধার হন তিনি। উদ্ধারের পর স্থানীয় থানা, ঢাকার ডিবি কার্যালয় হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সবশেষ ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে মঙ্গলবার উত্তরার ভাড়া বাসায় ফেরেন তিনি।
গতকাল আলাপকালে মেয়র রোকনুজ্জামান রুকন বলেন, মঙ্গলবার রাতে ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলে উত্তরা পশ্চিম থানা আমাকে ডেকে পাঠায়। থানায় গেলে পুলিশ আমাকে জেরা করে। বুধবারও তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুর রাজ্জাক বাসায় এসে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছেন।
মেয়র বলেন, আমি এখনো মানসিকভাবে অসুস্থ। স্মৃতিশক্তিতে সমস্যা হচ্ছে। ঘুম কম হচ্ছে। তিনি বলেন, সরিষাবাড়ীতে গত ২৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের কেউ মেয়র হতে পারেনি। আমিই প্রথম আওয়ামী লীগের মেয়র। অথচ আমি কোনোদিন মেয়র হবো তা কল্পনাও করিনি। কারণ আমি কখনও সক্রিয় রাজনীতি করতাম না। ভোট দিতাম বিএনপিকে। সামাজিক কাজকর্ম করতাম। হঠাৎ রাজনীতিতে এসে কীভাবে মেয়র হলাম সে বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তা আমার কাছে জানতে চেয়েছে। আমি পুলিশকে বিস্তারিত বলেছি।
অপহরণের সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে মেয়র বলেন, বেশ কয়েকজন কাছের মানুষের স্বার্থে আঘাত লাগায় আমার সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়। এর মধ্যে রয়েছে আমার সাবেক গানম্যান মারুফ পল্লব, জাতীয় পার্টির নেতা রফিকুল ইসলাম রফিক, স্থানীয় সাংবাদিক মাসুদুর রহমান এবং পৌরসভার ‘কর আদায়কারী’ মিয়া হাসান মুন্নাফ।
মেয়র হওয়ার কাহিনী বর্ণনা করে রুকন বলেন, ২০১৪ সালে একটি ধর্মসভায় ।জেলা বিএনপির সভাপতি ফরিদুল কবির শামীম এবং তৎকালীন পৌর মেয়র বিএনপি নেতা ফজলুল কবির তালুকদার আমাকে গালিগালাজ করেন। এরপর আমি মেয়র পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দেই। প্রথমে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের প্রচারণা চালাই। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ২০১৫ সালের ৩০শে ডিসেম্বর নির্বাচনে অংশ নেই। ওই সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইঞ্জিনিয়ার মাহবুবুর রহমান হেলাল, মনিরুজ্জামান মনি, আবদুল মালেক এবং মঞ্জুরুল ইসলাম বিদ্যুৎসহ ৭-৮ জন নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন।
আমাকে দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেয়ায় তারা সবাই আমার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। নির্বাচনের তিনদিন আগে বিএনপির নেতা-কর্মীরা আমার মিছিলের ওপর হামলা চালায়। এতে আমার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। নির্বাচিত হওয়ার পর গত বছরের ১৬ই ফেব্রুয়ারি সরিষাবাড়ী পৌরসভার মেয়র পদের দায়িত্ব নেই। এর পর থেকে এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক এবং ব্যতিক্রমী কাজ করায় আমার জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছিল।
কাছের মানুষের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার বিষয়ে মেয়র রুকন বলেন, মারুফ পল্লব নামে আমার একজন গানম্যান ছিল। সে ইয়াবা সেবন করায় আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছিল। তাই ৭-৮ মাস আগে আমি তাকে বরখাস্ত করি। এরপর গত আগস্ট মাসে একদিন আমার উত্তরার বাসায় কয়েকজন সন্ত্রাসী নিয়ে এসে মারুফ পল্লব পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। আমি শটগান দিয়ে ধাওয়া দেয়ায় তারা পালিয়ে যায়। এ নিয়ে গত ৭ই আগস্ট আমি উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। মেয়র বলেন, টিআর, কাবিখা এবং বয়স্ক ভাতা কার্ড নিয়ে কয়েকজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। তাই এসবের সুষ্ঠু বণ্টনের দায়িত্ব আমি নিজেই নিয়ে নেই। সব উন্নয়ন কাজের তদারকি নিজেই করছিলাম। তাই এসব কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এসব কারণে একাধিক কমিশনার এবং ঠিকাদার আমার প্রতি বিরাগভাজন ছিল।
রোকনুজ্জামান রুকন বলেন, গত ঈদুল আজহার পর জাতীয় পার্টির নেতা প্রিন্সিপাল রফিকুল ইসলাম রফিক আমার সরিষাবাড়ীর বাসায় ঠিকাদারি লাইসেন্স দেয়ার জন্য কালু চাচা নামে একজনকে পাঠায়। কালু চাচাকে লাইসেন্স দিতে আওয়ামী লীগের এক নেতাও তদবির করেছিলেন। আমি লাইসেন্সের অনুমোদন না দেয়ায় ওইদিনই আমাকে মেয়র পদে থাকতে দেবে না বলে হুমকি দেয় রফিক এবং তার ছেলে রেসি বাবু। আমার ওপর আক্রমণ করতে এলে আমি রেসি বাবুকে থাপ্পড় দেই। তখন রেসি বাবু এই বলে হুমকি দেয় যে, ঢাকায় এলে সে আমাকে হত্যা করবে। এ নিয়ে আমার পক্ষে থানায় জিডি করেন পৌরসভার লাইসেন্স পরিদর্শক মারুফ। পরে মারুফকে কুপিয়ে আহত করা হয়। এ নিয়ে আদালতে একটি মামলাও হয়েছে।
মেয়র রুকন বলেন, আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা পৌর নির্বাচনের সময় সরাসরি আমার বিরোধিতা করেন। তাদের মধ্যে ৪-৫ জনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীকেন্দ্রিক একটি চক্রও আমার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। আমাকে অপহরণের পেছনে এসব কারণ থাকতে পারে বলে আমি তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছি।
তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জানান, মেয়রের পারিবারিক বিষয়সহ অনেকগুলো বিষয়কে ঘিরে তদন্ত চলছে। এখনো বলার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি।