কলেজ নিয়ে বিক্ষিপ্ত স্মৃতি ও কিছু কথা
আমি যতোবারই কলেজ জীবন নিয়ে ভাবতে বসি ততোবারই অবাক হই আর একটা প্রশ্নই মনের মাঝে আসেÑকলেজ জীবনটা এতো মধুর কেন? পরক্ষণেই ভিতর থেকে কেউ একজন উত্তর দেয় কলেজ জীবনটা মধুর জীবন। জীবন যেন চলছে ব্রেকফেল করা কোনো গাড়ির মতো, যেটি ইচ্ছা করলেই থামানো যায় না। হয়ত একদিন নিজের ইচ্ছায় থেমে যাবে। যাই হোক, এইতো বহুদিন আগের কথা, মাত্র কলেজ জীবন শেষ করে কর্মক্ষেত্রে পদার্পণ করলাম। অনেক কৌতূহল, স্বপ্ন আর আশা নিয়ে শুরু হয়েছিলো এই নতুন কলেজ জীবনের পথচলা। কলেজের প্রথম দিনের স্মৃতিটা আজও যেন ভাসছে চোখের সামনে। এছাড়াও আরো অনেক ঘটনা বা স্মৃতিগুলো ডায়েরির পাতায় নয় জীবনের রঙ্গিন পাতায়ও লেখা হয়েছে। কলেজ জীবনের অতীত হয়ে যাওয়া সময়ে কী পেয়েছি আমরা? যা হোক, কালের আবর্তে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব মেলানো সম্ভব নয়। তবে এটা বলতেই হয়, এই চাঁদপুর সরকারি কলেজটিই অনেকের জীবনের ভিত গড়ে দিয়েছে।
এই কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীবৃন্দ অনেকেই দেশের নামকরা, যাঁরা নিজেরা খ্যাতির আলো ছড়িয়েছেন। তাঁরা হলেন : ওয়ালী উল্লাহ নওজোয়ান (গবেষক, রাজনীতিবিদ, ভাষা আন্দোলনের সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংবিধান রচয়িতা ও শিক্ষক); আব্দুল্লাহ সরকার, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ; মোঃ সবুর খান, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন। আরো ছিলেন হুমায়ুন ফরিদী, যিনি দেশখ্যাত অভিনেতা ছিলেন। বর্তমানে জীবিত আছেন মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, যিনি বাংলাদেশ পুলিশের ২৯তম মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে দেশের সেবা করেছেন। মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, যিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ, বর্তমানে চাঁদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য। নামকরা গীতিকার কবির বকুল। তিনি বহুবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। এসডি রুবেল, দেশের নামকরা সঙ্গীত শিল্পী। আরো অনেক নাম না জানা গুণী ও কৃতী ব্যক্তি গড়ে উঠেছে আমাদের এই প্রিয় বিদ্যাপীঠে।
বর্তমানে কলেজটিতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক আছেন বিভিন্ন বিভাগে। তাঁরা প্রত্যেকেই শিক্ষার্থীদের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক। প্রত্যেকটা ছাত্র-ছাত্রীর ব্যাপারে তারা যত্নশীল। যে কোনো সময় যে কোনো পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে থাকে। এছাড়া অনেক শিক্ষকই আছেন, যাঁরা বিভিন্ন বইয়ের রাইটার এবং তাঁদের লেখা বই পাঠ্য।
পূর্বে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কোনো ড্রেসকোড ছিলো না। কিন্তু বর্তমানে নির্দিষ্ট ড্রেসকোড রয়েছে। তার মধ্যে ছাত্রদের সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট ও কালো জুতা আর ছাত্রীদের জন্যে সাদা কামিজ, সাদা স্কার্ফ ও সাদা জুতা।
চাঁদপুর সরকারি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শাখার ক্লাসের সময়সীমা সকাল ৯:০০ থেকে দুপুর ১:৩০ পর্যন্ত। শিক্ষার্থীদের সকাল ৯টার আগেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হয়। তারপর আবার ছুটির পর ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে নিজের কলেজে অবস্থানের তথ্য নিশ্চিত করতে হয়। ক্লাস টাইমের পর ২টা ৩০ মিনিট থেকে ৪টা পর্যন্ত ল্যাব ক্লাস করানো হয়।
কলেজের শিক্ষকদের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি পিতৃসুলভ আচরণ সবসময়ই দেখা যায়। আবার শিক্ষকগণ শাসনও করেন, যখন সেটি শৃঙ্খলা পরিপন্থি হয়। পূর্বে কলেজের শিক্ষকগণও শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় বেত নিয়ে যেতেন। তাঁদের শাসন ও আদর মিশ্রিত পড়াশোনা সত্যিই মধুর ছিলো। আধুনিকতার ছোঁয়ায় শ্রেণিকক্ষে নেই বেতের ব্যবহার। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের পাশাপাশি শিক্ষকদের রাগও কমেছে।
আমাদের সময় ছাত্র রাজনীতি অনেকটাই জোরালো ছিলো। চাঁদপুর সরকারি কলেজ ভবনের দুপাশে বারান্দা। একটা সময় কলেজের দুপাশের বারান্দা দিয়ে স্লোগান দিতো ছাত্রনেতারা। এ বিষয়ে একটি কথা খুব বেশি মনে পড়ে। ১৯৯৯ সালে চাঁদপুর সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। তখন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের হেড ছিলেন মাসুদা জাহান, পদার্থবিদ্যায় আনোয়ার হোসেন ও রসায়ন বিভাগে সফিউদ্দিন স্যার। একদিন রসায়নবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম স্যার আমাদের রসায়ন বিষয়ের অর্গানিক ক্যামিস্ট্রি পড়াচ্ছিলেন। এমন সময় একটি ছাত্র সংগঠনের নেতারা বারান্দা দিয়ে স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন। স্যার বিরক্ত হয়েই বললেন, এ রকম আমি কোথাও দেখিনি যে, এভাবে বারান্দা দিয়ে স্লোগান দেয়া। তখন স্যার রসিকতা করে বলেছিলেন, দুই দিকে দুটি বারান্দা মাঝখানে আমরা ক্লাস নিচ্ছি, মনে হয় যেনো একটা সিনেমা হল। কলেজে পড়াবস্থায় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে যাই। তখন ভিপি পলাশ ভাই ছিলেন কলেজের ভিপি। যিনি আমার ছাত্র রাজনীতির আইকন। তিনি বর্তমানে সুদূর আমেরিকায় বসবাস করছেন।
আসলে চাঁদপুর সরকারি কলেজের মূল ভবনটি ব্যতিক্রম। কারণ এই ভবনের মতো করে বাংলাদেশে আর কোথাও ভবন আছে কি না তা আমার জানা নেই।
কলেজে প্রবেশের আগে নজরে আসে শহিদ রাজু চত্বর। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার সরকার বিরোধী আন্দোলন চলাকালে কলেজের ছাত্র জিয়াউর রহমান রাজু আন্দোলন করতে গিয়ে মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়েছিলেন। যার ফলে তাঁর স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ এই চত্বরটি তৈরি করা হয়। চিত্রলেখা মোড়ে চাঁদপুর পৌরসভার অর্থায়নে রাজু চত্বর নির্মিত হয়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের ৩ তারিখে রাজু চত্বর উন্মোচন করা হয়।
কলেজে রাজুর সমাধির পাশেই শহিদ মিনার। এই শহিদ মিনারে ভাষা শহিদদের স্মরণ করা হয়। সম্প্রতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে নির্মিত হয়েছে মুজিব ভাস্কর্য ‘বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল’। এই ম্যুরালের বর্ণনা থেকে জানা যায়, মুজিববর্ষের একটি লোগো নির্মাণ করে বরেণ্য চিত্রশিল্পী সব্যসাচী হাজরা। বঙ্গবন্ধুর যে ছবিটি অবলম্বনে লোগোটি সৃজন করা হয়েছে, সে ছবিটি নির্বাচন করেছেন জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং। এই লোগোটিতে বঙ্গবন্ধুর হাসিমাখা মুখ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং লোগোটির ট্যাগ লাইনে বাংলায় লাল রঙে ‘মুজিব’ ও তার নিচে কালো রঙে ‘শতবর্ষ’ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার পাশে সোনালি রঙে ইংরেজিতে ‘গটঔওই ১০০’ উৎকীর্ণ আছে। লিপির টাইপে ঊনিশশো ষাটের দশকে পত্রিকায় ব্যবহৃত মুদ্রণ লিপির শৈলী ব্যবহার করা হয়েছে।
মুজিববর্ষকে সামনে রেখে ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনের জন্যে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও চাঁদপুর সদর আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য, ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদের কন্যা ডাঃ দীপু মনি এমপি মহোদয় চাঁদপুর সরকারি কলেজ মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব অংশকে নির্বাচন করেন। তাঁর পরিকল্পনা ও উদ্যোগে এবং চাঁদপুর সরকারি কলেজের সংশ্লিষ্টতায় এখানে নির্মিত হয় সুদৃশ্য ও গৌরবময় বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল, যা মুজিববর্ষের লোগোরই হবহু ভাস্কর্যে রূপদান। এই ম্যুরালে মুজিববর্ষের লোগোর সাথে বাঙালি জাতির আরো বড় দুই অর্জনকে সংযুক্ত করা হয়েছে। আমাদের ভাষা আন্দোলনের স্মারক পবিত্র শহিদ মিনার ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মারক জাতীয় স্মৃতিসৌধকে দুপাশে রেখে মাঝখানে মুজিববর্ষের লোগো তথা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালটি স্থাপন করা হয়েছে। এই তিনটি স্থাপনাকে একসাথে সংযুক্ত করে বড় আকারের একটি মুক্তমঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, যাতে পুষ্প-শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা যায় এবং বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতিকেন্দ্রিক কোনো অনুষ্ঠান সহজেই মঞ্চস্থ করা যায়। সন্ধ্যার অবকাশে এখানে জ্বলে উঠে স্পট লাইটগুলো, যাতে ভাস্কর্যটির নান্দনিকতা দূর হতেও চোখে পড়ে। দিনের আলোয় যখন সূর্যের সোনালি কিরণ ম্যুরালজুড়ে বিম্বিত হয় তখন বঙ্গবন্ধুর হাসিমাখা মুখখানি জীবন্ত হয়ে উঠে যেন। এই চাঁদপুর সরকারি কলেজ মাঠে বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকবার নিজে এসেছেন এবং জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। ম্যুরালটি দুহাজার কুড়ি সালের সতের মার্চ বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিন এবং মুজিববর্ষের সূচনালগ্নে উদ্বোধন করা হয়। এটি উদ্বোধন করেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এই ভাস্কর্য কলেজের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণ। কলেজ মাঠের এই ভাস্কর্যগুলো যে কাউকেই বিমোহিত করবে। কলেজের পূর্বপাশে পুকুরে সবসময় পানি থৈ থৈ করে। পুকুরটির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর অসিত বরণ দাশ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। কলেজের দক্ষিণ পাশটি পূর্বে খোলা ছিলো। বর্তমানে সেখানে দুটি সুদৃশ্য ভবন নির্মিত হয়েছে। সেখানে অধ্যক্ষ মহোদয়ের কার্যালয়, এক্সামিনিশেন কক্ষ রয়েছে।
আমি যেহেতু বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম, তাই মূল ভবন ছাড়া অন্য ভবনে আমাদের তেমন একটা ক্লাস হয়নি বললেই চলে। মূল ভবনেই বিজ্ঞান বিভাগের সব বিভাগ। তাই মূল ভবনে ক্লাস করেছি। একাদশ বিজ্ঞান ক্লাসের অনেক বন্ধুকে আজ মনে করতে পারছি না। তবে কয়েকজনের কথা মনে আছে, তারা হলো : এনামুল হক, তৌসিফ, আনিস, রাশেদ, রেখা, ইব্রাহিম খলিল, মোস্তাফিজুর রহমান, কামরুল ইসলাম, রেখা আক্তার, আব্দুল্লাহ খান, পুনম রায়, রিতা দাস, ইয়াসমিন ও মেহেদী হাসান। তবে ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে নাম ভুলে যাওয়া সেই বন্ধুদের আবারো হয়ত ফিরে পাবো সেই প্রত্যাশা থাকলো।
উজ্জ্বল হোসাইন : আইটি কর্মকর্তা, চাঁদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল; প্রাক্তন শিক্ষার্থী, শিক্ষাবর্ষ ১৯৯৮-৯৯।