• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

বাংলার উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দীপ্যমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

প্রকাশ:  ৩০ মার্চ ২০২৪, ১৬:৩১
প্রিন্ট

কোন জাতি যখন প্রকৃতই কোনো সঙ্কটের সম্মুখীন হয়, তখন ঠিকই সেই জাতির পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে কোনো না কোন মহাপুরুষের। বাংলাদেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনই একজন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কস্বরূপ। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি যখন ভুগছে অস্তিত্ব সংকটে, তখনই বাঙালি জাতির পরিত্রাণের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লাল সবুজের পতাকার ইতিহাসে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু নামটি অবিচ্ছেদ্য। তিনি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন, মানুষকে স্বপ্ন দেখাতেন। বঙ্গবন্ধু দয়ালু মানুষ ছিলেন। তার ইতিহাসবোধ বাঙালি জাতিকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। বাঙালির চাওয়া, তাদের দাবি, আশা ও আকাক্সক্ষা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-শেখ লুৎফর রহমান, মা-সায়েরা খাতুন। দুই ভাই, চার বোনের মধ্যে তিনি পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান।
তিনি ১৯৩৯ সালে মিশনারী স্কুলে পড়ার সময় স্কুলের ছাদ সংস্কারের দল গঠন করে নিজ নেতৃত্বে তিনি শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের নিকট দাবি পেশ করেন। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে একবছরের জন্যে যুক্ত হন। ১৯৪২ সালে এনট্র্যান্স পাশ কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে আইনে ভর্তি হন। ওই কলেজে পড়া থেকেই সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগদান করার সুবাধে তিনি বাঙালি মুসলিম নেতা হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গড়ে তোলার আন্দোলনে তিনি ১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হওয়ার পর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। মুসলিমদের রক্ষা করার জন্যে তিনি সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত হন। এরপর ঢাকায় ফিরে এসে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারির ৪ তারিখের পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনে-প্রাণে বাঙালি। শৈশবেই বাঙাি জাতির শৃঙ্খলমুক্তির আকাক্সক্ষা এবং রাজনৈতিক চেতনার বীজ রুপিত হয়েছিল। গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলন কিশোর মুজিবের মানসচেতনায় রোপণ করেছিল বাঙালিয়ানার বীজ। ১৯৩৯ সালে গোপালঞ্জ মিশনারীর স্কুলে ৮ম শ্রেণিতে ভর্তির পর তিনি এ আন্দোলনে যুক্ত হন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতে ও বাঙালির মধ্যে জ্ঞান, শ্রম, একতা ও দেশপ্রেমের দীক্ষাদানে ১৯৩১ সালে গুরুসদয় দত্ত ব্রতচারী আন্দোলনের সূচনা করেন। গুরুসদয় দত্তের বাঙালিয়ানার মন্ত্র-
ষোল আনা বাঙালি হ’
বিশ্ব মানব হবি
যদি শাশ্বত বাঙালি হ’
শোণিতে ধারণ করেই শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। ব্রতচারী আন্দোলনের স্বদেশপ্রেম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা হৃদয়ে লালন করেই শেখ মুজিব সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১’র সময় পর্যন্ত অনেক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল বাঙালি জাতিকে। অনেক ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে আমরা পেলাম স্বাধীনতা। তবে এ স্বাধীনতা একদিনে অর্জিত হয়নি। তরুণ বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হল তার স্বাধীনতার অর্জনের মূল সোপান। ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালে বহুবার মুজিবকে জেলে নেয়া হয়েছিল। যতোবার জেলে গিয়েছেন ততবার যেন আরও মনে শক্তি সঞ্চার করেছিলেন। অবশেষে ১৯৫৪ সালের ৭ মে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়।
এরপর ১৯৬৬ সালে তিনি পেশ করেন বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক মুক্তির সনদ ছয়দফা। এ সময় নিরাপত্তা আইনে তিনি বারবার গ্রেফতার হতে থাকেন। গ্রেফতার হয়ে মুক্ত হলে সন্ধ্যায় তিনি আবার গ্রেফতার হন। এরকমই চলে পর্যায়ক্রমিক গ্রেফতার। তিনি কারারুদ্ধ জীবনযাপন করতে থাকেন। আগরতলা মামলা তাকে প্রধান আসামী করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু হয়। যা পরবর্তীতে গণআন্দোলনের রূপ নেয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক।নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
৭ মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর  ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞে সারা বাংলাদেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এমনি অবস্থায় গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতার ঘােষণা দেন। শুরু হয় বাংলাদেশর মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা পেলাম স্বাধীনতা। সেই সাথে  বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ পেলো একটি নতুন মানচিত্র ও লাল-সবুজের পতাকা। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেমিক মানুষের উন্নত সমৃদ্ধ এক আধুনিক বাংলাদেশের।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল নতুন দেশ পুনর্গঠনের নীলনকশা ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা এবং আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি যদি দেশবাসী খাবার না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে পূর্ণ হবে না। স্বাধীন দেশের আর্থ সামাজিক চরিত্রের পাশাপাশি আদর্শিক ভিত্তিটিও নির্দেশিত হয়েছিল এমনভাবে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। কোন ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষত।
১৯৭২ সালের গোড়ায় যে দেশটি স্বীকৃতি ও বান্ধবহীন ছিল, সে দেশটি ২ বছরের মধ্যে ১৯৭৪ এর সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি মর্যাদাপূর্ণ আসন করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে যত দ্রুত সম্ভব অগ্রগতির পথে নিয়ে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম আর মংলা বন্দরের মাইন অপসারণ করে বন্দরকে পুনরায় ব্যবহারযােগ্য করে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যকে সচল করে তুলেছিলেন খুব কম সময়ের মধ্যে। দেশের ৫৮০টি শিল্পকারখানাসহ পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সব সম্পদ জাতীয়করণ। হাজার হাজার শ্রমিককর্মচারীদের কর্মসংস্থান। মাদ্রাসা বাের্ডের পুনর্গঠনসহ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট স্থাপন। দেশের কৃষক শ্রেণি ও কৃষিব্যবস্থার ভাগ্য পরিবর্তন ও আমূল সংস্কারের জন্য স্বাধীনতা লাভের পরপরই ৩৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে-নামমাত্র মূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞান ও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন। একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। স্বাধীন হওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করেন।
স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকদূর এগিয়েছে। অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা স্থিতিশীলতায় আসার পর এখন শুরু হয়েছে মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন। এখন আমাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে টেকসই উন্নয়নের দিকে। ফলে অর্থনীতির সূচকগুলাের পাশাপাশি সামাজিক সূচকেও মৌলিক পরিবর্তন আসছে। শিল্প ব্যবসাবাণিজ্য, ব্যাংক-বিমা, বিভিন্ন সেবা খাত, যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে যুগোপযোগী ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা। বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি নিজ অর্থায়নে তৈরি হয়েছে দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম সেতু ‘পদ্মা সেতু’। এছাড়া মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাছি। এর ফলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে তার ভাবমূর্তিকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য যোগ্য নেতৃত্বদানকারী অসাধারণ এক নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃতিত্বের কথা বারবার আলোচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে যার নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দীপ্যমান তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর দূরদশী, বিচক্ষণ এবং সঠিক নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক। বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে অস্বীকার করার শামিল। ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ আজ সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে এক ও অভিন্ন নাম। আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। আসুন সবাই বলে উঠি-
 তোমার স্বপ্নে পথ চলি আজো
 চেতনায় মহীয়ান।
 মুজিব তোমার অমিত সাহসে
জেগে আছে কোটি প্রাণ।
লেখক : উজ্জ্বল হোসাইন, প্রবন্ধ লেখক ও সংগঠক, চাঁদপুর

 

সর্বাধিক পঠিত