• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

প্রতিহিংসার বড় অস্ত্র ধর্ষণ!

প্রকাশ:  ০৬ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:৪৬
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে একটি সংবাদের লিংক। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ধানের শীষে ভোট দেওয়ায় স্বামী ও চার সন্তানকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণ। ধর্ষণ শব্দটি শুনলে যেকোনো নারীরই তীব্র অসহায় লাগে, অনিরাপদ অনুভূতি মাথা চাড়া দেয়।
    একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে আমরা মানবিক হওয়ার পরিবর্তে পাশবিক হয়ে উঠছি। পাশবিক আচরণের যে ধারা আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া, সেটি থেকে বের হতে পারিনি আমরা। আর সেটির বড় শিকার নারীর সম্ভ্রম। এর বড় প্রমাণ পূর্ণিমা শীল, পারুল কিংবা বগুড়ার সেই মা-মেয়ে।
    সুদূর অতীতে না গিয়ে আমরা ২০০১ সালের নির্বাচনেই যাই, পূর্ণিমা শীল আমাদের কাছে এক জ্বলন্ত উদাহরণ। ‘সব হিন্দুরা আওয়ামী লীগে ভোট দেয়' তাই বিএনপির কর্মী খলিল, লিটন, আলতাফদের কাছে ধর্ষণ করেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা সহজ ছিল। সেটাই ঘটেছিল। আর আমাদের কানে বেজেছে পূর্ণিমার মায়ের আর্তনাদ, ‘বাবারা তোমরা একজন একজন করে আসো, আমার মেয়েটা ছোট, ও মরে যাবে'। এই নারকীয় ঘটনার ১৭ বছর পর পূর্ণিমার সঙ্গে একদিন দীর্ঘসময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিলো। তাকে জড়িয়ে ধরে আমি শুধু ‘দুঃখিত' উচ্চারণ করতে পেরেছিলাম। আমার ব্যক্তিগত অক্ষমতা হয়তো এতে খানিকটা প্রশমিত হয়েছিল। কিন্তু পূর্ণিমার ক্ষত গত ১৮ বছরে একই আছে। পূর্ণিমা হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘আমার কিসের লজ্জা, এ লজ্জা রাষ্ট্রের।
    নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ। তার ওপর পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়। এছাড়া বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ নাকি জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
    পূর্ণিমাদের সাজানো সংসার ছিল, বোনেদের বিয়ে হয়েছিল। বোন ধর্ষিত হয়েছে এই অপরাধে ফিরতে হয়েছিল পূর্ণিমার বোনদের। এলাকা ছাড়া হতে হয়েছিল পরিবারকে। এতদিনের সাজানো সংসার ছেড়ে পূর্ণিমার মাকে শুধু বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল। সব প্রতিকূলতা ছাপিয়ে পূর্ণিমা আজ সমাজের মুখে থুথুু দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু সমাজ কী সংশোধিত হয়েছে? আজও পূর্ণিমাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেনস্থা হতে হয়, কারণ তিনি ধর্ষিতা হয়েছিলেন। তার ছবি, ফোন নম্বর ব্যবহার করে খোলা হয় পর্ন পেইজ। তাঁর দোষ একটাই, ধর্ষিত হয়ে তিনি সিমি বেগম বা সীমাদের মতো মরে যাননি, বেঁচে আছেন।
    এই ধারাবাহিকতায় নিকট অতীত ঘাঁটলে পাই বগুড়ার ঘটনায় দলীয় ক্যাডার দিয়ে একজন কিশোরীকে তুলে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে।   কয়েকদিন পর আবারো ক্যাডার দিয়ে বাড়ি থেকে তুলে এনে ধর্ষণের শিকার মেয়েটি ও তার মায়ের মাথার চুল কামিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর মা মেয়ে বাড়ি ছাড়া, তিন মাস কাটাতে হয়েছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে।
    শুধু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বলে চাইলেই ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটানো যায়? আর রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা ধর্ষণকেই কেনো প্রতিহিংসার বড় অস্ত্র হিসেবে লালন করেন এই প্রশ্নের কোনও ব্যাখ্যা বা জবাব কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
    মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের সঙ্গে আমাদের পাওনা ২ লাখ বীরাঙ্গনা। যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করার পাশাপাশি নিজেদের পৌরুষত্বের জোর পরীক্ষা করে বীরাঙ্গনাদের নারকীয় দুঃসহ জীবন ‘উপহার' দিয়ে গেছে সেই পাষ-রা। স্বাধীন দেশে তার পুনরাবৃত্তি চলছেই।
    নিজ দেশের মানুষই কেবল ভোটাধিকার প্রয়োগের জের ধরে চার সন্তানের সামনে গণধর্ষণ করতে পারে। সুবর্ণচরের সেই নারীর স্বামীর দেওয়া বয়ান শোনার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যেটাই বলেন সেটা হয়েছিল। অসহায় সে পুরুষ নিজ স্ত্রীকে ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি। নিম্নবিত্ত এই পরিবারটির বাস্তবতাটি কি কেউ খতিয়ে দেখছি? কোথায় যাবেন তারা? আমাদের সমাজ কি তাকে মেনে নেবে? বিয়ে হবে সেই নারীর সন্তানদের? পূর্ণিমাকে যেমন একঘরে করা হয়েছিল, তেমনটি হবে না? বাস্তবে তেমনটিই হবে। আমাদের সামাজিক ও কূপম-ুক বাস্তবতা ধর্ষিতাকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করবে আচরণ দিয়ে। আর প্রতিহিংসা চরিতার্থের যেসব উদাহরণ রেখে যাচ্ছে আমাদের তথাকথিত রাজনীতিকরা, সেটিই চর্চিত হবে বারংবার।
    পূর্ণিমা বা পারুলদের খবর আমাদের পর্যন্ত এসেছে। কিন্তু আরও অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা কেবল ধর্ষকের সামাজিক ও রাজনৈতিক দাপটের জোরে প্রকাশিত হয় না। ধর্ষণের মামলা হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে  নারী ও শিশু ধর্ষণ সংক্রান্ত ১৭ হাজার ২৮৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ভিকটিমের সংখ্যা ১৭ হাজার ৩৮৯ জন। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৮৬১ জন নারী ও তিন হাজার ৫২৮জন শিশু। তিন হাজার ৪৩০টি ধর্ষণ মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় ১৭ জনকে মৃত্যুদ-, ৮০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ-, ৫৭৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাসহ ৬৭৩ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।
    এবার আসুন পরিসংখ্যানে আসি। প্রায় সাড়ে তিন হাজার ধর্ষণ মামলার ঘটনায় সাজা পেয়েছেন মাত্র এক হাজার ৩৪৬ জন। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি মামলা ধোপে টেকেনি। ধর্ষিতা প্রমাণ দিতে পারেননি তিনি ধর্ষিত হয়েছিলেন। সুতরাং সাজা হয়নি আসামীর।
    আসামী ধর্ষণ করেনি এমন প্রমাণের ভিত্তিতেই ছাড়া পেয়ে গেছে। ধর্ষিতা কিন্তু সমাজ ও সংসারের চোখে ধর্ষিতা হয়েই বেঁচে আছেন।  কোথায় কেমন আছেন সেই তথ্য আমাদের কাছে নেই৷ হয়তো শিগগিরই রুহুল আমিন প্রমাণ করতে পারবেন তিনি ও তার সঙ্গীরা  পারুলের গণধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু পারুলের যে তকমা লেগে গেছে। সেটি তো আর  মুছবে না।
    তবে যতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তার প্রায় ৭০ শতাংশ বিচারের দ্বার পর্যন্ত আসে না। আমাদের সমাজের বিভীষিকাময় আচরণের কাছে বেশিরভাগ পিতামাতা ও স্বজন লুকিয়ে ফেলেন ধর্ষণের ঘটনা। এমনটাই ঘটে এসেছে। প্রকাশ্য কোনও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে হয়তো এভাবেই লুকিয়ে থাকতে হবে ধর্ষিতাকে। আর প্রতিহিংসা চরিতার্থের অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণ পুরুষদের প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ এই অপরাধে তো শাস্তির নজির নেই।
সূত্র : ফাতেমা আবেদীন নাজলা, ডি ডব্লিউ ব্লগ।

 

 

সর্বাধিক পঠিত