• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

কালের আয়নায়: পর্ব ৮ ॥ পীর হাবিবুর রহমান

প্রকাশ:  ০৭ অক্টোবর ২০১৭, ০১:৫৪ | আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০১৭, ০২:০২
পীর হাবিবুর রহমান
প্রিন্ট

কালের আয়নায় রাজনীতি ও গণমাধ্যমের অনেক অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হবে। যেগুলো ফেসবুক বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করবো না। আজ ছাত্রজীবনের দু’চারটি মজার ঘটনা বলি। আমাদের এক বন্ধু নদীর পাড়ে থাকতো। উকিল পাড়ার আড্ডায় একদিন এসে জানালো মামলা খেয়ে দু’দিন পলাতক ছিল। চোর ধরা পরায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করতে গিয়ে সে যে কাজটি করেছে এতে সন্দেহভাজন চোরের অভিভাবক তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো- দুই আঙুলকে আড়াআড়িভাবে টান দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের এই কৌশল তোকে কে শিখিয়েছে? আমাদের বন্ধু জানালো, গোয়েন্দা সিরিজ মাসুদ রানা থেকে সে এটি শিখেছিল। দুই আঙুল দুই দিকে টান দিতে গিয়ে ছেলেটির চামড়া খানিকটা ছিঁড়ে গেছে এবং সে ভীষণ ব্যাথা পেয়েছে।

এরশাদ জমানায় পুলিশী ধরপাকড়ের মুখে পালিয়ে থাকতে গিয়ে আমরা বন্ধুরা একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, আজ রাতে আমাদের সঙ্গে ওই বন্ধুটিকেও সঙ্গে নিবো। রাতে তার বাসার গেইটে গিয়ে ডাক দিতেই তার আব্বা বেরিয়ে আসলেন। পরিস্থিতি তখন থমথমে। বন্ধুর বাবা আমাদের কাছে জানতে চাইলেন, বাবারা কি চাও তোমরা? আমরা তার ছেলের নাম ধরে বললাম, তাকে নিয়ে যেতে এসেছি, আমরা কেউ বাড়িতে থাকছি না। বাইরে গোপনীয়তা রক্ষা করে অন্য জায়গায় একসঙ্গে থাকবো, বাড়িতে থাকা তার ঠিক নয়।

বন্ধুর বাবা বললেন, তোমরা পালিয়ে থাকো, অসুবিধা নেই। কিন্তু আমার ছেলেকে পুলিশ কেন ধরতে আসবে? আমাদের এক বন্ধু বললো গোয়েন্দা পুলিশের কাছে তার নাম আছে। সে জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে গ্রন্থনা সম্পাদক। তিনি বললেন, ঠিক আছে তোমরা যাও, আমি তার ব্যবস্থা করছি। তিনদিন পর আমাদের সঙ্গে ঐ বন্ধুটির যখন দেখা, তখন সে মহাক্ষুব্ধ। সে বলে, হ্যাঁ-তোরা আমাকে আড্ডা মারার জন্য আনতে গিয়ে তিনটা দিন ফুফুর বাসায় বন্দি করে রেখেছিস।

কি হয়েছিল? জানতে চাইলে; সে বললো-সেদিন রাতে আমরা চলে আসার পর তার আব্বা তার ফুফুর বাসায় নিয়ে যান এবং বলেন, তিনি না নেয়া পর্যন্ত তার ছেলেকে যেন ঘরের বাইরে যেতে দেয়া না হয়। আরেকবার বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। সেনাশাসক এরশাদের মার্শাল ল দফায় দফায় কঠোর হতো। এমনি এক পরিস্থিতিতে সুনামগঞ্জ পুরোনো সার্কিট হাউজে সামরিক আইনের অধীনে দায়িত্ব পালনরত সেনা কর্মকর্তারা সেখানে থাকছেন। শহরে মাঝে মধ্যে সেনাটহল হচ্ছে। এক বিকালে বাসা থেকে যখন বেরুচ্ছি তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোটবেলার বন্ধু সেও বের হয়ে এসেছে। সে আমার আগে আগে হাঁটছে আর আমি তার খানিকটা পিছনে। তার সামনে যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে, তাদেরকে আমি মাথার দিকে আঙুল ঘুরিয়ে ওই বন্ধুটিকে ইঙ্গিত করে বুঝাতে চাইছি-ওর মাথার সমস্যা দেখা দিয়েছে।

গালর্স স্কুল পয়েন্টে তখনকার প্রভাবশালী ছাত্রনেতা সুবীর তালুকদার বাপটুসহ অনেকের সঙ্গে দেখা। তারা আমার কানে কানে জানতে চাইলেন, ওর কি হয়েছে? আমি বললাম, ডাক্তার বলেছে ওর মাথায় সমস্যা। বাসায় পাগলামি করছে। তার মা আমাকে পাঠিয়েছেন তাকে বুঝিয়ে বাসায় নেয়ার জন্য। এতে করে সবাই তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলেন। তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন, তোমার বাইরে থাকার দরকার নাই, তুমি বাসায় চলে যাও। এখন সে নিজের সম্পর্কে যাই বলে, কেউ আর বিশ্বাস করছেন না। এতে ভিতরে ভিতরে আমার বন্ধু ফুসছে। এভাবে চেনা পথে, চেনা শহরের চেনা মানুষ যার সঙ্গেই দেখা হয়, তাকেই ইঙ্গিত করে একই বার্তা দিচ্ছি।

আর সবাই তাকে একইভাবে সহানুভূতি দেখিয়ে বাসায় যাবার অনুরোধ করছে। সুনামগঞ্জ শহরে ট্রাফিক পয়েন্ট হলো বৈকালিক বা সান্ধ্যকালীন আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। সব বয়সের সব মত পথের মানুষজনদের আড্ডা জমে উঠে। সেখানে অনেকের সঙ্গে দেখা হলে তাদেরকেও অভিন্ন ইঙ্গিতে বুঝাতে সফল হলাম, আমার বন্ধুর মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। এতে একের পর এক অসংখ্য অগ্রজরা তাকে শান্তভাবে, কেউ কেউ বা পাগল থেকে দূরে থাকাই ভালো এমন মনোভাব নিয়ে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন, তুমি বাসায় যাও, বিশ্রাম করো। তোমার মা তোমার জন্য চিন্তা করছেন। রাগে, ক্ষোভে হন হন করে সে ফিরে আসতে থাকে।

তখনো আমাদের আড্ডার জায়গা উকিলপাড়া। আমাদের গ্রুপটাই নয়, অগ্রজ-অনুজদের মিলে দিনভর আড্ডার আসর ছিল এখানে। শীতেষের চায়ের দোকান তখন জমজমাট। মিষ্টি, সিঙ্গারা, লবঙ্গ, চা ছিল সুস্বাদু। এখানে ভিড় হতো অনেক বেশি। আমাদের সবার বাকির খাতা নিয়মিত হয়েছিল। কলেজ জীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পর্যন্ত অনেক টাকা এখানে দিতে হয়েছে। এর পাশেই ছিল মনিরের চায়ের দোকান। সেটি এত জমজমাট ছিল না। এমনও হয়েছে, আমরা যারা দোকান খোলার পর আগে এসেছি; তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দুধ, চা পাতা, চিনি কিনেই মনিরের দিনের ব্যবসা শুরু হয়েছে। সীতারামের দোকান ছিল উল্টো দিকের কর্নারে। জায়গা বিক্রি করে কোথায় যে গেল পরিবার নিয়ে জানি না। আমরা কখনো কিছু কিনতে গেলে ইচ্ছে করেই দাম দর করতাম। হিন্দী এক্সসেন্টে সিলেটী ভাষা বলতো সীতারাম। কথায় কথায় বলতো, লাভ নাই সাব। আমরা বলতাম, লাভ নাই তো লস দিয়ে ব্যবসা করো কেন?

যাক, উকিলপাড়ায় ট্রাফিক পয়েন্ট থেকে আমার সেই ক্ষুব্ধ বন্ধু যখন ফিরে এলো আমিও ফিরে এলাম। রীতিমতো রাগে, ক্ষোভে সে তখন গোঙাচ্ছে, কথা বলতে পারছে না। এখানেও আমি যাকে পেলাম তাকেই বুঝাতে সক্ষম হলাম, তার মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। একজন সুস্থ মানুষ কিভাবে মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টুমি করলে রীতিমতো পাগল নয়, উন্মাদ হয়ে যায়; তা খানিক পরেই টের পেলাম। সীতেশের চায়ের কাপে চুমুক দিতে পারিনি। চুলা থেকে বিশাল লম্বা জলন্ত লাকরি বের করে সে আমার দিকে তেড়ে আসতেই আমি এক দৌঁড়ে উকিলপাড়া কলেজ শিক্ষকদের মেসে ছুটে যাই। আমাদের লজিক পড়াতেন আফতাব উদ্দিন স্যার। পরবর্তীতে সুনামগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ও সিলেট শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হয়ে অবসর নিয়েছেন। তিনি চমকে গেছেন আমি হাজির হতেই।

টিচার্স মেসের টিউবওয়েলে তিনি পানি নিতে এসেছিলেন। তার পাশে আমি দাঁড়ানো। কয়েক গজ সামনেই পাকা রাস্তায় আমার ওই বন্ধু জলন্ত লাকরি নিয়ে গর্জন করছে। ভয়ার্ত চোখে স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? আমি স্যারকে আবার মাথার দিকে আঙুল ঘুরিয়ে তাকে ইশারা করলাম। তখন সে স্যারের সামনে রীতিমতো যত জোরে চিৎকার দেয়া যায়, তত জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। স্যার আমাকে বললেন, এখন কি হয়েছিল? আমি বললাম, স্যার-আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?’ এতেই সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। স্যার তখন তাকে বললেন, বাবা তুমি বাসায় চলে যাও। তোমার এখন বেড রেস্ট দরকার। সে গজরাতে গজরাতে তার মামার বাসার দিকে চলে গেল।

চলবে...