• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

কালের আয়নায়: পর্ব ৪ ॥ পীর হাবিবুর রহমান

প্রকাশ:  ০৩ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:১০
পীর হাবিবুর রহমান
প্রিন্ট

খাদ্য বিভাগের এক কর্মকর্তার সুন্দরী মেয়ে সতীশ চন্দ্র উচ্চ বালিকা বিদ্যালয থেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আলোকিত করেছিলেন নাচে, গানে। ছেলেবেলা মা হারানো রাজনীতিবিদ, বিত্তশালী পিতার বড় ছেলে তার প্রেমে পরেছিলেন। বাবার হুট খোলা জিপ নিয়ে বালিকার দৃষ্টি আর্কষণে স্কুলের পিছনের বিশাল পুকুর বরশি ফেলতেন। জীবনটাকে উপভোগ করেছেন। দারুণ ফূর্তিবাজ, আড্ডাবাজ এই মানুষটি আমাদের অনেকের আপনজন ছিলেন। অকালে স্ত্রীকেই হারাননি, নিজেও ইন্তেকাল করেছেন।

আমাদের সময় ছুটির ঘন্টা জুবিলী স্কুল ও গালর্স স্কুলে একই সঙ্গে বাজতো। গালর্স স্কুলের পয়েন্টে আমরা যখন আসতাম সাদা ইউনির্ফম পরা বেণী দুলানো বালিকারাও রাস্তায় ভেসে আসতো ঘরে ফেরায় তাড়ায়। বড় জোর আঁড়চোখে তাকানোর সাহসটুকু ছিল। এরবেশি কিছু ছিল না। গালর্স স্কুল পয়েন্ট অতিক্রম করে ছোট্ট ব্রিজ ।শহরের রোমান্টিক পরিচ্ছন্ন ইমেজের সৃজনশীল তরুণরা পথে পথে হেঁটে বেড়াবারকালে এখানে খানিকটা ঝিরিয়ে নিতেন।

শালীনতার নেকাব কেউ খুলতে পারতেন না। সামাজিক মূল্যবোধের শৃঙ্খলে ময়-মুরুব্বিদের প্রতি ভীতি কাজ করতো। ব্রিজের পাশেই নন্দী বাড়ি। বাড়ির কর্তা প্রবীণ মানুষটি খুব সুন্দর ছিলেন। বৃদ্ধকালেও তার চেহারায় আভিজাত্য ও রূপের মাধুর্যের ছটা ছিল। স্কুল থেকে ফেরার পথে নন্দী বাড়ির গাছের আমলকির লোভ সামলাতে পারতাম না। এমন বড় বড় রসালো আমলকি আর কখনো দেখিনি। গাছে ঢিল মারতেই থোকা থোকা আমলকি পরতো। কিন্তু বাড়ির কর্তা গভীর মমতা নিয়ে ছোট্ট ঝুড়িতে নিজেই এসে আমাদের আমলকি দিতেন। আসলে শহর ছিল পরিবারের বন্ধনে বাঁধা। সব বাড়ির ফলমূল সবার জন্য উন্মুক্ত।

নন্দী বাড়ির এই কর্তার দুই নাতনী অপরূপা সুন্দরী ছিলেন। আমাদের সমবয়সী গোপা এখন যুক্তরাষ্ট্রে সংসারী। তার ছোটবোন মুন্নি কোথায় জানিনা। দু’বোনই ছিলেন পড়ালেখায় মেধাবি আর ভদ্র-নম্র। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারগুলোর মতোই তাদেরকে কঠোর বেষ্টনীর মতো অভিভাবকরা রেখে ছিলেন। মুন্নির জন্য প্রাণ আকুল হওয়া একদল তরুণ নিজেরাই মারামারি করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মুন্নি জানলোও না, তাকে নিয়ে গালর্স স্কুলের বাইরে তুলকালাম উত্তেজনা। মনে মনে যিনি নায়ক ছিলেন ব্রাইটন প্রবাসী ইমামুজ্জামান মহির স্নেহধন্য আমাদের সেই বন্ধুটি এখন কলেজ শিক্ষক।

কবি শামীম লুৎফার যুক্তরাষ্ট্রে। ইমামুজ্জামান মহি যুক্তরাজ্যে বসত গড়েছেন। স্বাধীনতা উত্তর তারুণ্যকালে দুষ্টুমিতে যুগলভাবে আলোচিত হয়েছেন। তাদের পাল্লায় পরে বেকুব প্রেমিকরা যেখানে সেখানে প্রেমপত্র দিয়ে অভিভাবকদের কাছে হয়েছেন নাজেহাল। নিজেদের প্রণয়ের পাঠ তারা নিয়েছেন একান্ত গোপনে। গালর্স স্কুলের সামনে আরেকখানি বটবৃক্ষ। তার পিছনে রাহাত মঞ্জিল, গনি দারোগার বাড়ি। গনি দারোগা মানে যুদ্ধাপরাধী। একাত্তরের হানাদার বাহিনীর দোসর। ছেলেরা তার আলবদর। মুক্তিযুদ্ধে বাড়িঘর ফেলে ভারতে চলে যাওয়া হিন্দুদের বিভিন্ন সম্পদ লুটের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। তিনিই ফতোয়া দিয়েছিলেন এসব গনিমতের মাল, যে যা পারো নাও।

তার বাড়ির বটবৃক্ষে ভূত আছে, গালর্স স্কুলের সামনে পিছনে ভূতের ভয়। তবুও আকর্ষণ হারায়নি শহরের কিশোরেরা। পরিবারের শাসন না মানা কিছু কিছু বেপোরোয়া রোমিওরা পাখি শিকারের ইয়ার গান নিয়ে রিক্সায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন এপাড়া ওপাড়া। লেখাপড়ার পাঠ তাদের বেশিদূর যায়নি।

যাক, নন্দী বাড়ি পার হয়েই খ্রিস্টান মিশনে এক ধরণের টক মিষ্টি ফল পাওয়া যেত, সম্ভবত তোকফল বলা হতো। সেটিও আমরা গাছ থেকে পেরে দলবেধে খেয়েছি। কেউ বাঁধা দিতেন না। আমাদের বাসায় মা ফলজ বৃক্ষই বেশি লাগিয়েছিলেন। তেঁতুল, চালতা, বড়ই, জলপাই, আমড়া আরো কতকিছু ছিল। পুকুরপাড় জুড়ে ছিল লেবুর গাছ। গরমকালে টিউবওয়েলের পানি জগভর্তি করে এনে লেবুর শরবত বানিয়ে যখন পান করতাম, অমৃতের মতো লাগতো। আমাদের পাশের বাসার খালাম্মা পুকুরপাড় জুড়ে পেয়ারা ও লেবু গাছ পাহারা দিতেন। কিন্তু দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুমাতে গেলেই আমরা হানা দিতাম। বাঁশের বেড়া আমাদের তাণ্ডবে কত যে ভেঙেছে! এই বাড়ির পেয়ারা ছিল খুব মজার। যেটির ভেতর লাল, সেটিকে চৌধুরী পেয়ারা; আর যেটির ভিতর সাদা, সেটিকে কেন যে সৈয়দী পেয়ারা বলতাম, জানি না।

খালাম্মার বড় ছেলে সরকারি চাকরি জীবন থেকে অবসর নিয়ে ইন্তেকাল করেছেন। ছোট ছেলে হল্যান্ড প্রবাসী। উনিই কেবল বেঁচে আছেন। এ বাড়িতে এত পেয়ারা হতো খাল্লামা একসময় বিক্রি করা শুরু করলেন।এক টাকায় মজাদার একহালি পেয়ারা পাওয়া যেত। আমাদের শাফকাত টাকা এ্যাডভান্স রেখে দিত। আমরা দলবেধে পেয়ারা কিনতাম। গলির মুখে বা খেলার মাঠে আনন্দ করে খেতাম। খালম্মার বাড়িতে যখন তার মেয়েরা আসতেন জামাই, নাতিনসহ; তখন আমাদের খুশির শেষ নেই। কারণ তখন খালাম্মা পেয়ারা বিক্রি করতেন না। আমরা কেনার জন্য গেলেই এমনিই তিনি দু’হাত ভরে পেয়ারা দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যেতে বলতেন।

আমাদের বন্ধু ওদুদ এখন লন্ডনে। রমজান মাসে আমাদের স্কুল জীবনে পুরোটাই কাটতো মসজিদে ইবাদত বন্দেগীতে। সারাদিন মসজিদেই পরে থাকতে হতো। প্রতিযোগিতা করে নামাজের সময় আযান দিতাম। তুহিনদের পাড়ার মসজিদে আযানের জন্য ইমাম সাহেবের কাছে তার কদর ছিল বেশি। ষোলঘর মসজিদে ছিল এখন জাঁজরেল আমলা, আমাদের বন্ধু সালেহ আহমদ মোজাফরের। তাদের মধ্যে তুহিনের কণ্ঠ ছিল সুরেলা। সে যখন নাটকে ঢুকলো, খালাম্মা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, কি সুন্দর তেলওয়াত করতো, আর এখন কাজ নাই, নাটকে ঢুকেছে।

ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় জুবিলী স্কুলের বার্ষিক নাটকে আমিও চান্স পেয়েছিলাম। রিহার্সেলে যেতে হবে শুনে মা বললেন, ‘বাবারে এসবের দরকার নেই। টাকা দিচ্ছি দেশবন্ধু থেকে মিষ্টি খেয়ে আয়।’ দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টির খ্যাতি ছিল বৃহত্তর সিলেট জুড়ে। ছোটবেলা মিষ্টির দোকান দেখলে আমার ইচ্ছে হতো বড় হয়ে মিষ্টির দোকান দিবো। যত খুশি খাবো। আইসক্রিমওয়ালা হাক দিলে বালিকারা যেভাবে ভিড় করতো, চানাচুরওয়ালার চারদিকে ঘিরে দাঁড়াতো; আমাদের দিকে ফিরেও তাকাতো না, তখন আমার আইসক্রিমওয়ালা বা চানাচুরওয়ালা হতে ইচ্ছে করতো।আরো ইচ্ছে হতো বাংলা সিনেমা দেখলে বড় হয়ে ঢাকা যাবো কুকুর হইতে সাবধান বাড়ির গাড়ি চালক হয়ে ববিতার সাথেই প্রেমে করবো।

এস এস সি পরীক্ষার আগে স্কুল নেই। সেটি টেস্ট পরীক্ষার পরের সময়। বড় ভাই ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। আমার বাংলা ঘর জুড়ে তুমুল আড্ডা। পাড়ার সহপাঠী বিশু ছিল ঘরকোনো। বোনদের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘর গোছানো থেকে গৃহকর্মেই ব্যস্ত থাকতো। আড্ডা দিতে চাইতো না। জোর করে তাকে নিয়ে আসতাম। একদিন সারারাত তাসের আড্ডায় তাকে আটকে রেখেছিলাম।তাসের শিক্ষক আমাদের এখন যুক্তরাজ্যে বসত করা হোসেন।পাড়ার আরেক সহপাঠী বান্ধবী কলেজ জীবন শেষে টিএন্ডটিতে চাকরি নেয়। সেই বান্ধবীর কথা বলে বিশুকে বললাম, তুই তাকে প্রেমপত্র দে। লজ্জায় ঘাবড়ে গিয়ে নার্ভাস বিশুর একদম বেহাল দশা। ঘামতে থাকে, শেষ পর্যন্ত আমাদের চাপে, আমাদের বলা কথা মতো প্রেমপত্র লিখে আমাদের পর্যবেক্ষনের মধ্যে সেই মেয়েটির হাতে যখন দিতে গেল; তখন বান্ধবীটি জিজ্ঞেস করলো-এটি কি? নার্ভাস বিশু, না মানে মানে বলে এক দৌঁড়...।

যাক ওদুদের কথা বলছিলাম। রমজান মাসে ওদুদ পরামর্শ দিলো, রোজা রেখে সময় কাটানোর জন্য ফুটবল খেলাই উত্তম। কিন্তু ফুটবল খেলতে গিয়ে সেই আগে চিৎ হয়ে পরলো। হাছননগর পয়েন্টে ময়নার দোকান ছিল আমাদের পূর্বসূরীদের তারুণ্যের আমলে জমজমাট চায়ের আড্ডা। উল্টো দিকেই ছিল তার ভাইয়ের জমজমাট মুদির দোকান। ওদুদরা বাসার বাজার সেখান থেকেই করতো। মাস শেষে তার বাবা একসাথে বিল দিতেন। বাসার কথা বলে ওদুদ সেখান থেকে ১২ টা দরে ২ কেজি চিনি কিনে ষোলগড় পয়েন্টে আরেক মুদির দোকানে ১০ টাকা করে বিক্রি করে দিলো। ছেলেবেলায় লাভ-ক্ষতির অংক এভাবেই শেখা হলো তার।

এসএসসি পরীক্ষার আগে ছাত্র রাজনীতির জন্য বড় ভাই গভীর রাতে বাসায় ফিরতেন। আমিও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। একদিন আমার এক বন্ধু অনুরোধ করলো রাতে তার প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। রাতে যাতে কেউ চিনতে না পারে সেজন্য দুজনে কালো শার্ট-প্যান্ট পরে অন্ধকার রাতে চলে গেলাম। তার প্রেমিকাকে ডেকে আনার দায়িত্বটি আমাকেই দিল। বাড়ির ভিতরে উঠোনে ঢুকতেই সাক্ষাত বিপদ আমার মুখোমুখি...
চলবে...

সর্বাধিক পঠিত