• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

কালের আয়নায়: পর্ব ৩ ॥ পীর হাবিবুর রহমান

প্রকাশ:  ০২ অক্টোবর ২০১৭, ০০:২০ | আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০১৭, ০০:২২
পীর হাবিবুর রহমান
প্রিন্ট

জুবিলী স্কুলে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ নানা উৎসব লেগেই থাকতো। স্কুল ইউনিফর্ম ছিল সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট অথবা সাদা শার্ট ও সাদা পায়জামা। ইউসুফ স্যারের তত্ত্বাবধানে একবার কোর্ট মসজিদে গিয়ে জোহরের নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শহরের বড় ব্যবসায়ী ছিলেন আফাজ উদ্দিন আহমেদ। তার ছেলে আহমেদ পারভেজ সামীর সঙ্গে স্কুল জীবন থেকেই সখ্যতা। জুবিলীতে একাডেমিকেলি এক বছরের সিনিয়র হলেও এসএসসির পর আমার গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। কলেজে উঠেই সামী, সাবেরীন, শিবলুরা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়। সে গল্পে পরে আসছি।

সিক্স-সেভেনে থাকতে ইউসুফ স্যারের কড়া নজরদারিতে জোহরের নামাজ পড়তে গিয়ে মসজিদে দেখা সামীর সঙ্গে। সামী বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চায়, তুমি মুসলমান? আমি ভেবেছি, তুমি হিন্দু। এই কথা মনে হলে এখনো আমার হাসি পায়। ‍আমাদের ছেলেবেলায় ক্রিকেট খেলার পুরো সেট সামী ও তুহিনের ছিল। কিন্তু এই দুজনই কোনো ক্রিকেট দলের হয়ে জেলা ক্রিকেট লীগে খেলেনি। আমরা যারা মাঠে ঘাটে কাঠের বানানো ব্যাট আর টেনিস বল, বাঁশ দিয়ে স্ট্যাম্প বানিয়ে খেলেছি তারাই স্কুলজীবনেই জেলা ক্রিকেট লীগে অভিষেক ঘটিয়েছি। আজকালকার শিশুদের হাতে সব কিছুই সহজলভ্য। আমাদের সময় বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীদের জীবনে তা স্বপ্নের মতো ছিল।

বড় সংসার, টানাপোড়েন, হিসাব-নিকাশের মধ্যে পরিবার থেকে কতটা পাওয়া যাবে সেই হিসাব নিয়েই আমরা বেড়ে উঠেছি। সামীর বাবা বিত্তশালী ব্যবসায়ীই ছিলেন না, অমায়িক ব্যবহারের আধুনিক, ফ্যাশনেবল মানুষ ছিলেন। সুমানগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স উনার নিজের হাতে গড়া। সামীর লেখাপড়ার বিষয়ে তার আম্মা ছিলেন কড়া। সামীর বাসায় গেলে হরেক রকমের খাবার পাঠাতেন দফায় দফায়। ষাটের দশকে তার বাবার কেনা জিপ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফুলটাইম ব্যবহার হয়েছে।

স্বাধীনতাত্তোর ছাত্রলীগ সভাপতি নুরুজ্জামান চৌধুরী শাহী এখন যুক্তরাষ্ট্রে শারিরীক অসুস্থতার জন্য অবসর জীবন যাপন করছেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর তার এবং তার পরিবারের ওপর অনেক ঝড় ঝাপটা গেছে। পরে তিনি জার্মান হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে তার হৃদয়কে কখনো ছিন্ন করেননি। প্রবাসেও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তার সঙ্গে আড্ডায় বসলে আফাজ উদ্দিন আহমদের মতো আওয়ামী লীগের মহাদুর্দিনের মানুষদের গল্প শোনা যায়।

স্কুলে আমাদের আগের ব্যাচ হওয়ায় সামী, সাবেরীন, শিবলু, বাপ্পারা ছেলেবেলার বন্ধু হলেও একবছর আগে কলেজে পা রাখে। ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি কবিতা, সাহিত্য চর্চায় এই গ্রুপটি বড়সড় আকার নিয়ে যেমন তৎপর হয়ে উঠে তেমনি তুমুল আড্ডা আর নানা পথে হৃদয় খুলে একেকজন এপাড়ায় ওপাড়ায় প্রেমেই পড়েনি, সারাদিন একসঙ্গে চলে রাতবিরাতে মারামারিতেও লিপ্ত হয়েছে। বালিকা কাকে মন দিবে, নাকি দেবেই না; তার কোনো খবর নেই! গার্লস স্কুলের সামনে ছুটির ঘন্টা বাজতেই নিজেদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা। এ নিয়ে সামনে বিস্তর কথা বলবো।
কিছু কিছু ঘটনায় স্কুল কর্তৃপক্ষের ইচ্ছেকে ভয়ে মেনে নিতে হয়। মনের বিরুদ্ধে সরকারের হুকুমে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বেতের ডগায় লাইন ধরিয়ে কখনো সরকার প্রধান কখনো বা মন্ত্রীর আগমনে যখন দাঁড় করান, তখন মনে হয় তারা একবারও ভাবেন না; এইসব নাবালক সন্তানদেরও ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা কিংবা মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে!

সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে প্রহসনের গণভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাক বা না যাক, স্কুল , শিক্ষকরা বেত নাচিয়ে নাচিয়ে আমাদেরকে সেই ভোটের প্রচারে নামিয়েছিলেন। এখনো মনে পড়ে, ‘ ৩০ মে সোমবার, গণভোট, গণভোট’ স্লোগান দিতে দিতে কয়েক গজ এগিয়ে কেটে পরেছিলাম।

বুকের ভেতর তখনো ১৯৭৫ এর আগস্টে পরিবার পরিজনসহ নিহত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য কান্না। ছাত্রলীগের রাজনীতিকে সংগঠিত করার কাজে সেই অন্ধকার সময়ে ছেলে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত মা বারান্দায় রাত গভীরে বসে থাকতেন। আর আমি শিক্ষকদের বেতের ভয়ে একটি প্রহসনের নির্বাচনের প্রচারে গেছি!কি বেদনা! সেদিনের মিছিলে যাওয়া সকল ছাত্রদের মধ্যে হাতেগোনা কিছু ছাড়া বাকি সবাই সেই সেনাশাসকের রাজনীতির বাইরের রাজনীতিতেই যুক্ত হয়েছিলেন।

আরেকবার সেনাশাসকের পোশাক পরে জিয়াউর রহমান স্টেডিয়ামে এলেন। আমাদেরকেও স্কুল থেকে কড়া প্রহড়ায় নিয়ে যাওয়া হলো। সেবারও সেখান থেকে কেটে এসেছিলাম। কেটে পরতে পারিনি সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের খালকাটা বিপ্লবে সেকালের কমিউনিস্টরা যখন ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে অবৈধ শাসনকে কবুল করছেন, তখন আমাদেরকে শিক্ষকরা শিমুলবাক ইউনিয়নের পৈন্দায় খালকাটায় শরিক করেছেন। এই ঘটনাগুলো সেদিন হৃদয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, সেখান থেকে আজো যখন সরকারের মন্ত্রীরা যাবেন বলে বিভিন্ন এলাকায় দেখি স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে তখন মন বড় বেশি দ্রোহ করে।

যাক সেসব কথা, সুনামগঞ্জের বৃষ্টি চেরাপুঞ্জির পরেই বেশি নাম করেছে। স্কুলের পাশেই শহরের বুক চিড়ে বহমান সুরমা। চারদিকে হাওর। বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে স্কুলে গেছি। অনেকবার ফেলে এসেছি না হয় ছাতার কুড়া ভেঙে এসেছি। ছাতার চেয়ে বৃষ্টিতে ভিজে দৌঁড় দিতে দিতে হৈ হেল্লোর করে ঘরে ফেরার আনন্দই ছিল অন্যরকম। ক্লাস এইটে পড়ার সময় স্কাউট ক্যাম্পিংয়ে আমরা মৌলভীবাজার গেলাম। একটি স্কুল ভবনে সুনামগঞ্জ স্কাউটদের থাকার ব্যবস্থা হলো। আমাদের স্কুল ছাড়াও এইচ এম পি এবং বুলচাঁন্দ হাইস্কুলের স্কাউট এবং শিক্ষকরা ছিলেন। সেবার স্কাউটিংয়ে তাবু জলসায় আমরা সুনামগঞ্জের ‘রঙিলা জামাই, যাইতা শ্বশুর বাড়ি’ অভিনয়ের সঙ্গে পরিবেশন করেছিলাম।

কিন্তু যেদিন এটি পরিবেশনের কথা সেদিন দুপুরেই খাওয়া দাওয়ার পর আমরা যখন বিশ্রাম নিচ্ছি তখনই শোরগোল। সেই স্কুল জামানায় লুকিয়ে ধূমপানে আসক্ত দুই বন্ধু যারা আমাদেরও এই কাজে সাক্ষী রাখতে ভয় পেত তারা ‍দূরে গিয়ে সুখের টান টানার সময় কাশিনাথ স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে গণ্ডগোল বাঁধিয়ে বসে। সেখানে কাশিনাথ স্কুল এলাকার শক্তির লু-হাওয়া বইতো। অর্থাৎ স্থানীয় অন্য পাড়ার ছেলেরাও কাশিনাথকে ভয় পেত। কিন্তু এই তুচ্ছ ঘটনাকে ঘিরে শিক্ষকরা সামাল দেয়ার আগেই খলিলুর নেতৃত্বে রান্নাবান্নার জন্য রাখার চেলি বা লাকরির আঘাতে কাশিনাথের কয়েকজন ছেলের মাথা ফেঁটে রক্ত ঝড়ছে। তুমুল উত্তেজনা শহর জুড়ে। স্থানীয় প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষ আমাদের নিরাপত্তায় তটস্থ। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে কাশিনাথ এলাকা।

সুনামগঞ্জের ছেলেরা তাদের ছেলেদের রক্ত জড়িয়েছে, এটি তাদের অহমে জোর আঘাত করেছে। তাদের ছেলেরা মারামারি বাঁধালেও আমলে নিতে নারাজ। সুনামগঞ্জের স্কাউটদের ফিরে যেতে তারা দেবে না। আমাদের স্কাউট শিক্ষকদের চোখেমুখে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। আমাদেরও টেনশন। রাতে যখন তাবু জলসায় যাচ্ছি, পরিস্থিতি থমথমে। গায়ে পরে ঝগড়া বাঁধানোর জন্য বাজারের সালামকে একজন ধাক্কা দিলে সে আমলে না নিয়ে সরি ভাই বলে চলে আসলো। আমাদের রঙিলা জামাই ছিল সালাম। জামাইয়ের বাবা ছিলাম আমি।

তাবু জলসা শেষ করে দ্রুত আমরা ফিরে এলাম। বাইরে পুলিশ প্রহড়া। ভোর রাতে আমাদের ঘুম থেকে উঠানো হলো। মৌলভীবাজার জেগে উঠার আগেই সিলেট হয়ে সুনামগঞ্জ ফিরে এলাম। স্কাউট ক্যাম্পিং আমাদের জন্য অসমাপ্ত থাকলো। সকল স্কাউটদের সেবার দৌঁড়ে মালনীছড়ার চা বাগানের ভিতর দিয়ে অনেক দূর যেতে হয়েছিল। ‍সেই হাইকিংয়ে আমরা যে সনদপত্র পেয়েছিলাম, স্কাউট কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ দেন দরবারের পর বিলম্বে দিয়েছিলেন। এখনো ভাবলে অবাক হই, কি হালকা পাতলাই না ছিলাম! মাথাভর্তি কি চুলই না ছিল!সব গেছে আজ হারিয়ে!

প্রতিবছর জুবিলী স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো। হোয়াইট হাউজ, রেড হাউজ, ব্লু হাউজ ও গ্রিন হাউজ এই চার নামে সকল ছাত্রদের বিভক্ত করে প্রতিযোগিতায় উঠিয়ে আনা হতো। সকল স্কুলেই এমনটি হতো। কিন্তু জুবিলী স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছিল বর্ণাঢ্য। আমি যখন বর্তমান শরীরের ওজন নিয়ে বলি, হাইজাম্পে প্রথম হয়েছিলাম; তখন আমার ছেলে মেয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। সেবার আমি ও শাফকাত পুরষ্কার বিতরণের দিন শেষ প্রতিযোগিতা ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ তে অন্ধ ভিখারি সেজে পুরষ্কার জিতেছিলাম।

লঞ্চঘাট ছিল এক আকর্ষণীয় জায়গা। যারা সিগারেট টানতেন, নিষিদ্ধ লোবানের মতো আকর্ষণ নিয়ে ওখানে যেতেন। স্যারদের কাছে ধরা খেলে খবর হয়ে যেত। বিশেষ করে পিআই স্যারের চোখে পড়লে। পিআই স্যার নানা অনুষ্ঠান, নানা রিহার্সেলে নিজের পকেটের টাকায় চা, বন রুটি, কেক খাওয়াতেন। স্যারের ছোট ছেলে ঘুরঘুর করতো। একদিন সালাম ওর শার্টের পিঠে লিখে দিল, ‘আমায় একটি বন রুটি দাও।’ লঞ্চঘাটের বুন্দিয়া দুধে ফেলে গরম পরোটায় খেতে কি যে ভালো লাগতো; বলার মতো নয়। এই খাবারের অভিযানে তুহিন নেতৃত্ব দিতো।

যাক, যেমন খুশি তেমন সাজো তে ভিখারি সেজে আমি ও শাফকাত পুরষ্কারই জিতিনি আধুলি সহ ১০ টাকার মতো ভিক্ষেও পেয়েছিলাম। ভিক্ষের টাকায় সব বন্ধুরা লঞ্চঘাটে খেতে গেলাম মহানন্দে। খাবার অর্ডার দেয়ার সময় সবাই তৃপ্তিভরে চায়ের মধ্যে কেক ডুবিয়ে খেলো। এক বন্ধু ভিক্ষের টাকায় খেতে রাজি নয়। অনড় তার অবস্থান। এখন সে পেশায় আইনজীবী, মক্কেলের কাছ থেকে পাই পাই মামলার ফি বুঝে নেয় । সে আমার বন্ধু সাহারুল ইসলাম।

যে শহরকে আবিষ্কার করেছিলাম প্রেমের শহর বলে, যে শহরকে আবিষ্কার করেছিলাম কবিতা ও গানের শহর বলে; হাওরের রাজধানী, বাউলের তীর্থস্থান তাকে আমি ভালোবেসে ডাকি জল-জোছনার শহর বলে। সেই শহরের হৃদয় খান খান করা কত প্রেমিক বুক ভেঙে দেশান্তরী, কত প্রেমিক সাফল্যের মুকুট পরে এ শহরেই নয়, দেশ-বিদেশে বসত গড়েছেন। কেউ কেউ দেবদাস হয়ে বোহেমেনিয়ানের জীবন কাটিয়েছেন। কৈশোরে সবার আকর্ষণের জায়গা ছিল সতীশ চন্দ্র উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। প্রেমিকার হৃদয় হরণে কেউ কেউ স্কুলের পিছনের ভূতের গাছ সাক্ষী রেখে বিশাল পুকুরে হুট খোলা জিপে বসে বরশি ফেলতেন। সেইসব নানা ঘটনাবলি ঠাঁই পাচ্ছে এই বইয়ে।
চলবে...