সেই অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এখন
উপমহাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের একজন তিনি। প্রায় আট দশকের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন তার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমসাময়িক এই বর্ষীয়ান নেতার বয়স এখন ৯৮ বছর।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম কুশীলব মোজাফফর আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক জীবন বেছে নেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ সভাপতি তিনি। দেশের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ এই রাজনীতিক গত তিন বছর ধরে বার্ধক্যজনিত কারণে শয্যাশায়ী। তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। ঘনিষ্ঠজনদের দেখলে কেবল অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। মাঝে-মধ্যে একমাত্র মেয়ে আইভী আহমদ এবং স্ত্রী আমিনা আহমদের সঙ্গে একটু একটু করে কথা বলার চেষ্টা করেন তিনি। এ্যাপোলো হাসপাতালের ডা. বোরহান উদ্দীনের অধীনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন অধ্যাপক মোজাফফর। তার পরামর্শ অনুযায়ী বারিধারার বাসভবনের একটি কক্ষে চিকিৎসার বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে তার চিকিৎসা চলছে। নিজ দলের নেতারা ছাড়াও ঘনিষ্ঠজনদের কেউ কেউ মাঝে-মধ্যে তাকে দেখতে আসেন। গতকাল মোজাফফর আহমদের বাসায় বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে মেয়ে আইভী আহমদ এবং ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। এ সময় মোজাফফর আহমদের চিকিৎসার ব্যয় বহন করা পরিবারের পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে বলে জানান ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। মেয়ে আইভী আহমদ এবং স্ত্রী আমিনা আহমদ মোজাফফর আহমদের দেখভাল করেন। তরল খাবার তৈরি করে টিউবের মাধ্যমে তাকে খাওয়ানো হয়। সম্প্রতি সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাঈদুজ্জামান এবং রাজনীতিক মোনায়েম সরকার অধ্যাপক মোজাফফরকে দেখতে এসেছিলেন। ২০১৫ সালে সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ খেতাব ‘স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত করে। তবে রাজনৈতিক আদর্শের কারণে তিনি সবিনয়ে এ পদক গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। অধ্যাপক মোজাফফর বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করতে গিয়ে তিনি লেখেন, ‘স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার বন্ধু ছিলেন’। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘তিনিই প্রথম জাতীয় নেতা যাকে বাংলার আমজনতা তাদের আপন লোক ভাবতে পেরেছিলেন।’ মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এ দেশের রাজনীতি বড়লোকের প্রাসাদ থেকে সাধারণ মানুষের মাঝে নিয়ে আসার ব্যাপারে শেরেবাংলা ফজলুল হকের চেয়ে মওলানা ভাসানীর অবদান কম নয়।’ শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রের সাধক হিসেবে মন্তব্য করেন। আর এ যুগের রাজনীতিবিদ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশে রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে পেটনীতি, ব্যবসা ও দুর্নীতির আড্ডাখানায়। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক। দেশ স্বাধীন হয়েছে ২০ বছর (১৯৯১ সালের লেখা)। এত অল্প সময়ে এত সম্পদ কিছু লোকের হাতে এসেছে তা ভাবতে অবাক লাগে।’ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল (পয়লা বৈশাখ) কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আলহাজ কেয়াম উদ্দিন ভূইয়া স্কুলশিক্ষক ছিলেন। মায়ের নাম আফজারুন্নেছা। মোজাফফর আহমদ হোসেনতলা স্কুল, জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশন, দেবিদ্বার রেয়াজউদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও ভিক্টোরিয়া কলেজে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে পড়ালেখা করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং ইউনেস্কোর ডিপ্লোমা লাভ করেন। দীর্ঘদিন তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। মোজাফফর আহমদের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ১৯৩৭ সালে। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি ও তার স্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৫৪ সালে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি রাজনীতির সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে দেবিদ্বার আসনে মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রীকে তিনি পরাজিত করেন। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করে। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। তিনি আত্মগোপনে থেকে আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংঘটিত করেন। আট বছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। তিনি রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মূল নেতৃত্বের একজন ছিলেন তিনি। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। ওই সময় তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের নিজস্ব ১৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধা গঠনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। অধ্যাপক মোজাফফর ১৯৭৯ সালে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে ন্যাপ, সিপিবি ও প্রগতিশীল শক্তির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শুরুতে তিনি কারারুদ্ধ হন।