• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

প্রিয়া সাহা, ডনাল্ড ট্রাম্প এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু রাজনীতি

প্রকাশ:  ২৫ জুলাই ২০১৯, ১৪:১৬
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেওর উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী ‘ধর্মীয় স্বাধীনতায় অগ্রগতি’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের শেষে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত ২৭ জনের সাথে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করেন। এ ২৭ জনের মাঝে একজন ছিলেন বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিযদের নেত্রী প্রিয়া সাহা। সেখানে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এ বলে অবহিত করেন যে,বাংলাদেশ থেকে ৩ কোটি ৭০ লাখ ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিখোঁজ বা গুম হয়ে গেছে। তিনি মার্কিন রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানান, এখনো যে ১ কোটি ৮০ লাখ ধর্মীয় সংখ্যালঘু দেশে রয়েছে, তাদেরকে রক্ষা করতে তিনি যেন পদক্ষেপ নেন। পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে প্রিয়া  জানিয়েছেন, তার বক্তব্যে তিনি অটল আছেন এবং যা বলেছেন তা জেনেশুনে অত্যন্ত সচেতন ভাবেই বলেছেন।

প্রিয়া সাহা বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক, এনজিওর কর্ণধার এবং একটি পত্রিকার সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তার মানে তিনি একজন সচেতন নাগরিক। এখন প্রশ্ন হল প্রিয়া সাহাই কি প্রথম বাংলাদেশি যিনি দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে কোন বিদেশির কাছে অভিযোগ করেছেন?

এর সরাসরি উত্তর হল না। লর্ড ক্লাইভের আমল থেকেই এ অঞ্চলের কিছু স্বার্থান্বেষী বিদেশিদের কাছে দেশের বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে তাদের সহযোগিতা চেয়ে আসছে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর এ ধরনের কিছু আর দেখা যাবে না। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও দেখা গেছে, মোটামুটি দলমত নির্বিশেষে রাজনীতিবিদ এবং সিভিল সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা, দেশের সমস্যা নিয়ে বিদেশিদের ক্রমাগত কান ভারী করেছেন।পরাধীনতার দীর্ঘ ইতিহাসের ফলে মনোজগতে যে উপনিবেশ বাসা বেঁধেছে, তার ফলে তারা বিদেশিদেরকে শ্রেষ্ঠ ভেবে আসছেন। অবশ্য বিদেশিদের শ্রেষ্ঠ ভাবার বিষয়ে আম জনতার একটা বড় অংশও পিছিয়ে নেই।

‘ইসলামপন্থা’ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতি যারা করেন তাদের অভিযোগ জানাবার সবচেয়ে বড় জায়গা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য। লক্ষ্যণীয় যে, তারা যে রাজনীতি করেন তার বিপরীত মেরু অর্থাৎ, তুলনামূলক বিচারে সেক্যুলার দেশগুলিতে তারা ছোটেন অভিযোগ জানাতে। অপরদিকে, সেক্যুলার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করে বলে দাবি করেন, তারা উপরোক্ত রাষ্ট্র দুটি ব্যতীতও ছুটে গিয়েছেন ভারতের কাছে। বিভিন্ন সময় এ সমস্ত সংবাদ নির্ভর এবং অনির্ভরযোগ্য সূত্র ধরে নানা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

এ সমস্ত সংবাদ নিয়ে অতীতে কাউকে মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি। তাহলে হঠাৎ প্রিয়া সাহার বিষয়টা নিয়ে এত মাতামাতির কারণ কি? তিনি হিন্দু বলে? মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সরাসরি অভিযোগ করতে পারছেন বলে (যা  দেশের অনেক বিরোধী রাজনীতিবিদরই আকাঙক্ষা)? নাকি এ অভিযোগের দৃশ্য দেখতে পাবার ফলে (যেটা আগে কখনো হয়নি, অর্থাৎ, এ সমস্ত অভিযোগের দৃশ্য মানুষ আগে কখনো লাইভ দেখেনি)? নাকি এর সবকিছুর সম্মিলিত ফলে?

কথা উঠেছে প্রিয়া সাহার উল্লিখিত ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যার বিষয়টি নিয়ে। বলা হচ্ছে তিনি অতিরঞ্জিত একটি তথ্য উপস্থাপন করেছেন মার্কিন প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করবার জন্য। মানুষের প্রবণতা হলো মানুষ যখন নালিশ বা অভিযোগ করে, তখন সাধারণত সেটা অনেক বাড়িয়ে বলে। এক্ষেত্রে প্রিয়া সাহাই একমাত্র ব্যক্তি নন।

আমার মনে আছে ২০১৭ সালে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ বিষয়ক এক সেমিনারে। সেমিনার বিরতির ফাঁকে আমরা যখন ব্যক্তিগত আলাপচারিতা করছিলাম সেসময় এক ভদ্রমহিলা, যিনি গত নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করেছেন, সেখানে উপস্থিত ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এক কংগ্রেসম্যানকে বাংলাদেশে গুম হওয়ার সংখ্যা সম্পর্কে অতিরঞ্জিত, কল্পিত এক তথ্য দিলেন।

প্রিয়া সাহার অতিরঞ্জনের বিষয় নিয়ে অনেকে যেটা বলার চেষ্টা করছেন সেটা হল তিনি অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের গবেষণা গ্রন্থ ‘অ্যান ইনকোয়ারি ইন টু কজেস অ্যান্ড কনসিকোয়েন্সেস অব ডিপ্রাইভেশন অব হিন্দু মাইনরিটিজ ইন বাংলাদেশ থ্রু দ্য ভেস্টেড প্রপার্টি অ্যাক্ট’ বইয়ে উল্লিখিত ১৯৬৪ সাল থেকে অদ্যাবধি প্রতি বছর ১ লাখ ৯৬ হাজার ২৯৬ জন হিন্দু ‘হারিয়ে যাচ্ছেন’ বলে যা উল্লেখ করেছেন, সে রেফেরেন্সের  সূত্র ধরে একথা বলেছেন। এখানে বলতেই হয় যে, একটি গবেষণা গ্রন্থ বা প্রবন্ধে একটি তথ্য থাকা মানেই সেটি ধ্রুব সত্য নয়। অন্য আরো গবেষণায় যেহেতু এ তথ্যের সমর্থনে হয়নি; সুতরাং, এ সংখ্যাটি যে প্রামাণ্য সেটি বলা যাবে না। তবে বইটির মূল বক্তব্যের সাথে দ্বিমত করবার অবকাশ বোধহয় খুব কম।

এখন প্রশ্ন হল অতিরঞ্জিত এ বক্তব্য দ্বারা প্রিয়া সাহা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে কোন রাজনীতি এবং কাদের রাজনীতি প্রমোট করতে চান? তার এ বক্তব্যে কারা লাভবান আর কারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন? যে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘুর কথা তিনি উল্লেখ করলেন- তারা, বিশেষত সনাতন ধর্মালম্বীরা, তার কথায় কোনওভাবে উপকৃত হবেন, নাকি তা বাংলাদেশের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পালে নতুন হাওয়া লাগাবে? সমাজে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক বিভাজন তার কথায় প্রশমিত হবে, নাকি একে আরো গভীরতর করবে?

এখন দেখা যাক একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু বলতে আমরা কী বুঝি। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দুনিয়ার অনেক দেশেই, এমনকি প্রিয়া সাহা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ করেছেন সেখানেও, সমাজের সংখ্যাগুরু জনগণের কারো কারো কাছে সংখ্যালঘু বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। এ ধারণাকে ভিত্তি করে সেখানেও কেউ কেউ রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল করেন, যা আখেরে সংখ্যালঘুদের স্বার্থের বিপরীতে যায় বলেই অনেকে মনে করেন। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় সংখ্যালঘু বলতে আমরা কী বুঝি? সংখ্যালঘুদের সম অধিকার পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র কি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে?

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু বললেই সবার আগে আমাদের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের— অর্থাৎ, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের কথাই মনে আসে। বাংলাদেশে তাদের সম্মিলিত সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর সাত থেকে নয় শতাংশের মধ্যে হবে। এর বাইরে রয়েছে জাতিগত সংখ্যালঘু বা বিভিন্ন আদিবাসী বা জুম্ম জাতি, যাদেরকে সরকারী ভাষ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে বলা হয় ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’। এদের সম্মিলিত সংখ্যা এক শতাংশের বেশি নয়।

তবে, ধর্মীয় এবং জাতিগত ধারণার বাইরে অন্য ফর্মেও সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব কম বেশি সব রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেই দেখা যায়। এগুলি হল ভাষাগত, বর্ণগত, লিঙ্গীয়, মতাদর্শগত, যৌন আচরণ সংক্রান্ত এবং অন্যান্য। আজ পর্যন্ত এমন কোন রাষ্ট্র দেখা যায় নাই, যেখানে সব সংখ্যালঘুদের রাষ্ট্র এবং সমাজের সব ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরুদের মতই সম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

পাশ্চাত্যের উন্নত, উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে প্রচ্যের উন্নয়নশীল রাষ্ট্র, সব জায়গাতেই সংখ্যালঘুরা বৈষম্যের শিকার, পার্থক্য শুধু মাত্রাগত। তবে, দেখা গেছে তুলনামূলক বিচারে যেসমস্ত রাষ্ট্র অধিক গণতান্ত্রিক, সেক্যুলার এবং সমাজ ব্যবস্থা উদারনৈতিক, সেসমস্ত রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা মানসিকভাবে অধিক স্বস্তি বোধ করেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইসলামপন্থী এবং পরবর্তীতে মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের প্রচারণার ফলে বাংলাদেশে অনেকে সেক্যুলার এবং নাস্তিকতাকে প্রায় সমার্থক করে ফেলেন। পাশ্চাত্যের কোন রাষ্ট্র কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলির মত নাস্তিকতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হিসাবে ধরে নেয়নি। বরং শীতল যুদ্ধের সময় এ নাস্তিকতার বিরুদ্ধেই পাশ্চাত্যকে সরব থাকতে দেখা গেছে, যার ফলে ‘ইসলামপন্থী’, মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা সেসময় সেক্যুলার পাশ্চাত্যের সাথেই অধিক সংসক্তি বোধ করেছেন।

এখানে সেক্যুলার বলতে যে বিষয়টা বোঝানো হয়েছে সেটা হল রাষ্ট্র যেমন কোন ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হবে না, তেমনি শুধু কোন একটি ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা না করে, সমস্ত ধর্ম এবং ধর্ম সংক্রান্ত ধারণার বিকাশের সম পরিবেশ তৈরি করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পুরোপুরি সেক্যুলার রাষ্ট্র বলা যাবে কিনা এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও, সৌদি আরবের চেয়ে যে অধিক সেক্যুলার এ বিষয়ে কোন বিতর্ক নেই। ফলে জনসংখ্যার ১ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী সেখানে বিনা বাধায় ২,৬০০ এর অধিক মসজিদ তৈরি করতে পেরেছে।

অপরদিকে, ধর্ম নির্ভর রাজতন্ত্র থাকবার ফলে কোন অমুসলমানের পক্ষে সৌদি আরবে তাদের উপাসানালয় তৈরি করা সম্ভব নয়। এমনকি, সেখানকার অধিবাসী একজন শিয়া মুসলিম তার দেশের চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পাশ্চাত্যের কোন সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মনস্তাত্ত্বিকভাবে অধিক নিরাপদ বোধ করেন।

রাষ্ট্র ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হলেও সমাজ ব্যবস্থা যদি উদারনৈতিক না হয়, সেখানেও সংখ্যালঘুরা নিজেদের নিরাপদ বোধ করেন না। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, সমাজ উদারনৈতিক না হবার ফলে, গণতন্ত্র থাকা সত্ত্বেও ভারতের চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানরা অধিক নিরাপদ বোধ করেন, এমনকি ট্রাম্প আমলেও।

অপরদিকে, সমাজ ব্যবস্থা উদারনৈতিক হলেও রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি গণতান্ত্রিক না হয়, তাহলেও সে রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ করতে পারে না। উদাহারণস্বরূপ সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির কথা বলা যায়।

তাই দেখা যাচ্ছে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাবোধ তৈরির জন্য তিনটি উপাদান— বহুত্ববাদী গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম এবং উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা— জরুরী। এটা দেখা গেছে যে, এ তিনটির কোন একটির ঘাটতি যদি কোন রাষ্ট্রে থাকে, সে রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন থাকেন। যদিও এ তিনটি বিদ্যমান থাকবার অর্থ এই নয় যে, সংখ্যালঘুরা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হন না। কিন্তু, এ বৈষম্যের মাত্রা ধর্মীয় মৌলবাদী বা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চেয়ে কম। আজ পর্যন্ত এমন কোন রাষ্ট্র দেখা যায়নি, যা মৌলবাদ ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সেখানে অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান এবং একই সাথে সে রাষ্ট্রে সব রকমের সংখ্যালঘুরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন।

১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল তার মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল বহু মত ও পথকে ধারণ করে একটি সেক্যুলার, উদার গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী রাষ্ট্র গড়ে তোলা, যে রাষ্ট্র বাংলাদেশে বিশ্বাসী সব রকম সংখ্যালঘুদের ধারণ করবে। কিন্তু, বাস্তবতা হলো যে তিনটি উপাদান একটি রাষ্ট্র কাঠামোয় বিদ্যমান থাকলেও সংখ্যালঘুরা তুলনামূলক বিচারে নিরাপদ বোধ করেন; অর্থাৎ, বহুত্ববাদী (অর্থাৎ বহু মত এবং পথের উপস্থিতি)  গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম এবং উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা— তার কোনটিই আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপরই দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দলটি গণতন্ত্রের মূল উপাদান অর্থাৎ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বহুত্ববাদীতা এবং সংখ্যালঘুদের উপস্থিতির স্বীকৃতির বিপক্ষে দাঁড়াল। ‘ইসলামপন্থী’ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের মত একই সুরে তারাও সংখ্যাগুরুর জয়গান গাইলেন— যেটা ছিল পাকিস্তানি আমলের মূল চেতনা।

এ জয়গানের সূত্র ধরে সব জুম্ম জাতিকে নিজেদের পরিচয় ভুলে বাঙালি হয়ে যেতে বলা হল। পাকিস্তান আমলের শত্রু সম্পত্তি আইনের পুনরুজ্জীবন ঘটানো হল। উল্লেখ্য যে, হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করে দেশান্তরি করবার ক্ষেত্রে এ আইনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক মতাদর্শগত সংখ্যালঘুদের দমন করে একটি একক এবং তৎকালীন সময়ের সংখ্যাগুরুর মতবাদকে রাষ্ট্রে চাপিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হল।

পরবর্তী সময়ে সকল সামরিক এবং বেসামরিক শাসকরা কম বেশি একই পথে হেঁটেছেন। সংখ্যালঘু ইস্যুতে তাদের মাঝে দর্শনগত পার্থক্যের জায়গাটা খুব কম। পার্থক্যের যে জায়গাটা দেখা গেছে, সেটা মূলতঃ মাত্রাগত। ফলে সংখ্যালঘুরা (সব ধরনের, শুধু ধর্মীয় নয়) সব আমলেই কম-বেশি নিষ্পেষিত হয়েছেন।

২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর আওয়ামী লীগের অধীনে যে দুটো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এর দুটোই ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত এবং অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য। বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে একটি দল যখন ক্ষমতায় আসে তখন তার নৈতিক ভিত্তি স্বভাবতই কিছুটা দুর্বল থাকে। ফলে সে দলটি তার দুর্বলতা ঢাকবার চেষ্টা করে নানা বিষয়ে ক্রমাগত সফলতার জয়গান গেয়ে।

আওয়ামী লীগ তার শাসনামলে সবচেয়ে বড় যে সফলতার কথা বলে সেটি হল অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে তাদের আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ভালো আছে। পাশ্চাত্যের কাছে তারা নিজেদের ধারাবাহিক ক্ষমতায় থাকবার যৌক্তিকতা যে দুটো মূল উপাদানের উপর ভিত্তি করে তুলে ধরে তার একটি হল, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অপরটি হল, ‘ধর্মভিত্তিক’ রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদীদের (প্রচলিত ভাষায় জঙ্গি) দমনে সফল হওয়া। এ দুটো উপাদান আবার একে অন্যের সাথে যুক্ত। কেননা, এ সন্ত্রাসবাদীদের অন্যতম টার্গেট হলেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা।

প্রিয়া সাহা যে কাজটি করেছেন সেটি হল, যে মূল উপাদানের উপর দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ তার শাসনকে নৈতিকভাবে জায়েজ করে, সে মূল উপাদানকে ধরে টান দেয়া। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জানালেন যে, দশ বছরের অধিক শাসনেও আওয়ামী লীগ ‘মৌলবাদী’ সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে, তাদের দ্বারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গুম হয়ে যাওয়া অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ, দল হিসাবে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ এবং এ ক্ষেত্রে মার্কিন হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।

এর পূর্বে  মার্কিন রাষ্ট্রপতির কাছে গোপনে বা প্রকাশ্যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নেওয়ার অনুরোধ আর কেউ করেনি। বিএনপি, জামায়াত গত দশ বছরে চেষ্টা করেও যেটা করতে পারেনি, এক প্রিয়া সাহা সে কাজটি করে ফেলেছেন। দল হিসাবে আওয়ামী লীগকে তিনি খোদ মার্কিন পেসিডেন্টের কাছে ব্যর্থ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

এ বিব্রতকর অবস্থায় আওয়ামী লীগকে উদ্ধার করতে সবচেয়ে আগে এগিয়ে এসেছে বিএনপি এবং ‘ইসলামপন্থী’ দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। ক্রিকেট ছাড়া বাংলাদেশে কোন বিষয়ে তেমন জাতীয় ঐক্য দেখা যায় না। কিন্তু প্রিয়া সাহার প্রশ্নে কিছু ব্যতিক্রম বাদে ‘ইসলামপন্থী’, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, বামপন্থী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়েছেন।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যে সবচেয়ে ভালো আছে এ কথা ‘ইসলামপন্থী’ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের চেয়ে বেশি আর কেউ বলেনি। আওয়ামী লীগের এ সঙ্কটে ‘ইসলামপন্থী’ এবং বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে সরবে উপস্থিত হয়ে এ ‘সার্টিফিকেট’ দিয়ে দিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগ আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা শুধু ভালো নয়, ‘রাজা’র হালে আছেন। আওয়ামী লীগের প্রচারণা সেল দুর্বল বলে অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থক যে অভিযোগ করেন সেটাকে আমলে নিয়ে বলা যায়, তাদের এ দুর্বলতাটুকু ঢেকে দিয়েছেন তাদের প্রতিপক্ষ বিএনপি এবং ‘ইসলামপন্থী’ দলের কর্মীরা।

বিএনপি এবং ‘ইসলামপন্থী’ দলের কর্মীরা আওয়ামী লীগকে উদ্ধারের ব্রত নিয়ে যে এ কাজ করেছেন তা নয়। তারা এটি করেছেন তাদের মতাদর্শগত দুর্বলতার ফাঁদে পড়ে। তাদের মতাদর্শগত উৎস হল জিন্নাহর ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’। এ থেকে তারা এখনো বেরিয়ে আসতে পারেননি। এ তত্ত্ব অনুসারে তাদের মূল প্রতিপক্ষ এখনো হিন্দুরা। ফলে, তাদের রাজনীতির মূল বক্তব্য হল ‘সেক্যুলার’ আওয়ামী লীগের অধীনে হিন্দুসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যেহেতু ভালো আছেন, তাই মুসলমানদের ভালো থাকতে হলে ‘ইসলামপন্থী’ বা মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের বেছে নিতে হবে।

উল্লেখ্য যে, সেক্যুলার মতাদর্শ থেকে সরে গিয়ে বহু আগেই আওয়ামী লীগ মুসলিম জাতীয়তাবাদ এবং ‘ইসলামপন্থার’ রাজনীতির সাথে আপস করলেও, তারা এখনো এ দলটিকে সেক্যুলার বলে মনে করেন।বস্তুত, মুসলমান কেন্দ্রিক রাজনীতি করতে যেয়েই তারা ক্রমাগত আওয়ামী লীগকে এ ‘সার্টিফিকেট’ দিয়ে গেছেন যে, তাদের শাসনে মুসলমানরা নয় বরং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সবচাইতে ভালো আছেন।

গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের তত্ত্ব দিয়ে ২০১৯ এ রাজনীতি করতে যাবার সঙ্কটটা ‘ইসলামপন্থি’ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি। বর্তমান সময়ে যেকোন সংখ্যালঘুকে ভালো রাখতে পারা যে একটি দলের সফলতা, সেটি বুঝতে পারার অক্ষমতা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে যেমন সুবিধা দিয়েছে, তেমনি প্রিয়া সাহা ইস্যুতেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়বার হাত থেকে রক্ষা করেছে। বস্তুত,এর ফলেই অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতও প্রিয়া সাহার অভিযোগ যে সঠিক নয়, এ বিবৃতি দিয়েছেন।

এত দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাবার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়টা পরিষ্কার করতে চেয়েছে যে, বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের সাথে তারা সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। কেননা, এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে অন্য কোন বিকল্পও নেই। বিশ্ব রাজনীতিতে চীন এবং রাশিয়ার যে উত্থান তা ঠেকাবার জন্য অনির্ভরযোগ্য মিত্র ভারতকে পাশে পাওয়া ছাড়া আমেরিকার সামনে আর কোন পথ খোলা নেই।

অনির্ভরযোগ্য এ কারণে যে, ভারত আবার রাশিয়ার সাথে শক্তপোক্তভাবে গাঁটছাড়া বাঁধা। সে ভারতের বর্তমান শাসক দল বিজেপিসহ বিরোধী কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এমনকি পশ্চিম বাংলার তৃণমূলের বাংলাদেশের একমাত্র পছন্দের দল আওয়ামী লীগ। ফলে, যুক্তরাষ্ট্র এক দিকে যেমন ভারত বিরোধী অবস্থান নেওয়ার মত অবস্থায় নেই, তেমনি পাশাপাশি চীন, রাশিয়ার উত্থানসহ, আভ্যন্তরীণ নানাবিধ কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে আগের মত জোরালো ভূমিকা পালন করবার মত অবস্থায়ও নেই। পাশাপাশি, পূর্বের ওবামা প্রশাসনের চেয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ‘ইসলামপন্থী’ দলগুলো থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখবার নীতি অনুসরণ করছে; যার সব কিছুই বিশ্ব রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে গেছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও একক নেতৃত্বে পরিচালিত হবার ফলে দলের যে দুর্বলতা সেটা আবার প্রিয়া সাহা ইস্যুতে সামনে এসেছে। একক নেতৃত্বের মূল সমস্যা হল দলের কেন্দ্রীয় নেতা ছাড়া অন্যরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না অথবা ভুল সিদ্ধান্ত নেন।তাই ইদানিং দেখা যাচ্ছে নুসরাত হত্যাকাণ্ডসহ অনেক বিষয়েই প্রধানমন্ত্রীকে হসস্তক্ষেপ করতে বা সিদ্ধান্ত দিতে হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের নেতাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতি প্রকৃতি না বুঝেই প্রিয়া সাহাকে আইনের আওতায় আনা, বিচার, জিজ্ঞাসাবাদ করা ইত্যাদি বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। অতি উৎসাহীরা আবার এক কদম এগিয়ে, আবেগের বশে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা ঠুকে দিয়েছেন। একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই এসব অতি আবেগী কাজের ফলে আন্তর্জাতিক মহলে এর কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা বুঝতে পেরে এসব থেকে বিরত থাকবার নির্দেশ দিয়েছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে ধর্মসহ যেকোন বিষয়েই মত প্রকাশের একটি আপাত স্বাধীন পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ফলে, শেখ হাসিনা যে বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন সেটা হল, প্রিয়া সাহাকে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করাবার বা জিজ্ঞাসাবাদ করবার অর্থ হবে বর্তমান সরকারের অধীনে মত প্রকাশ বা ধর্মীয় স্বাধীনতা যে নেই, এ বিষয়টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে স্পস্ট করা। রাজনীতির যে ‘ট্র্যাপ’-টি তিনি বুঝতে পেরেছেন, সেটা দলের আর কেউ বুঝে উঠতে পারেননি।

একটি রাষ্ট্র কতটা গণতান্ত্রিক এবং কতটা মানবিক তা বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হল রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের সে রাষ্ট্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা। সব রকম সংখ্যালঘুরা যদি মনে করেন সে রাষ্ট্রটি গণতান্ত্রিক এবং মানবিক, তাহলেই সেটি গণতান্ত্রিক এবং মানবিক রাষ্ট্র। ভারত সম্পর্কে  ভালোভাবে জানাবার উপায় হল সেদেশের একজন মুসলমান বা খ্রিস্টানের সাথে আলাপ করা, পাকিস্তানে সেদেশের একজন হিন্দুর সাথে কথা বলা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেটা হবে একজন কৃষ্ণাঙ্গ, মুসলিম বা অন্য সংখ্যালঘু  সম্প্রদায়ের কেউ।তেমনি বাংলাদেশ কতটা গণতান্ত্রিক এবং মানবিক সেটি বোঝার ভালো উপায় হল এ সম্পর্কে  ধর্মীয়, জাতিগত, রাজনৈতিক এবং মতাদর্শিক সংখ্যালঘুদের মতামত।

প্রিয়া সাহা ‘ট্র্যাপ’ থেকে দল হিসাবে আওয়ামী লীগ আপাতত মুক্তি পেলেও সবরকমের সংখ্যালঘুরা ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন না,যতদিন পর্যন্ত  না মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শকে ধারণ করে, বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের ভিত্তিতে, সেক্যুলার রাষ্ট্র  এবং উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যাবে। আর তা না হওয়া পর্যন্ত সংখ্যালঘুরা নয়; বরং সংখ্যাগুরুরাই বলে যাবেন যে, সংখ্যালঘুরা  “ভালো আছেন”।

ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেওর উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী ‘ধর্মীয় স্বাধীনতায় অগ্রগতি’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের শেষে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত ২৭ জনের সাথে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করেন। এ ২৭ জনের মাঝে একজন ছিলেন বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিযদের নেত্রী প্রিয়া সাহা। সেখানে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এ বলে অবহিত করেন যে,বাংলাদেশ থেকে ৩ কোটি ৭০ লাখ ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিখোঁজ বা গুম হয়ে গেছে। তিনি মার্কিন রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানান, এখনো যে ১ কোটি ৮০ লাখ ধর্মীয় সংখ্যালঘু দেশে রয়েছে, তাদেরকে রক্ষা করতে তিনি যেন পদক্ষেপ নেন। পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে প্রিয়া  জানিয়েছেন, তার বক্তব্যে তিনি অটল আছেন এবং যা বলেছেন তা জেনেশুনে অত্যন্ত সচেতন ভাবেই বলেছেন।

প্রিয়া সাহা বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক, এনজিওর কর্ণধার এবং একটি পত্রিকার সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তার মানে তিনি একজন সচেতন নাগরিক। এখন প্রশ্ন হল প্রিয়া সাহাই কি প্রথম বাংলাদেশি যিনি দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে কোন বিদেশির কাছে অভিযোগ করেছেন?

এর সরাসরি উত্তর হল না। লর্ড ক্লাইভের আমল থেকেই এ অঞ্চলের কিছু স্বার্থান্বেষী বিদেশিদের কাছে দেশের বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে তাদের সহযোগিতা চেয়ে আসছে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর এ ধরনের কিছু আর দেখা যাবে না। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও দেখা গেছে, মোটামুটি দলমত নির্বিশেষে রাজনীতিবিদ এবং সিভিল সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা, দেশের সমস্যা নিয়ে বিদেশিদের ক্রমাগত কান ভারী করেছেন।পরাধীনতার দীর্ঘ ইতিহাসের ফলে মনোজগতে যে উপনিবেশ বাসা বেঁধেছে, তার ফলে তারা বিদেশিদেরকে শ্রেষ্ঠ ভেবে আসছেন। অবশ্য বিদেশিদের শ্রেষ্ঠ ভাবার বিষয়ে আম জনতার একটা বড় অংশও পিছিয়ে নেই।

‘ইসলামপন্থা’ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতি যারা করেন তাদের অভিযোগ জানাবার সবচেয়ে বড় জায়গা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য। লক্ষ্যণীয় যে, তারা যে রাজনীতি করেন তার বিপরীত মেরু অর্থাৎ, তুলনামূলক বিচারে সেক্যুলার দেশগুলিতে তারা ছোটেন অভিযোগ জানাতে। অপরদিকে, সেক্যুলার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করে বলে দাবি করেন, তারা উপরোক্ত রাষ্ট্র দুটি ব্যতীতও ছুটে গিয়েছেন ভারতের কাছে। বিভিন্ন সময় এ সমস্ত সংবাদ নির্ভর এবং অনির্ভরযোগ্য সূত্র ধরে নানা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

এ সমস্ত সংবাদ নিয়ে অতীতে কাউকে মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি। তাহলে হঠাৎ প্রিয়া সাহার বিষয়টা নিয়ে এত মাতামাতির কারণ কি? তিনি হিন্দু বলে? মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সরাসরি অভিযোগ করতে পারছেন বলে (যা  দেশের অনেক বিরোধী রাজনীতিবিদরই আকাঙক্ষা)? নাকি এ অভিযোগের দৃশ্য দেখতে পাবার ফলে (যেটা আগে কখনো হয়নি, অর্থাৎ, এ সমস্ত অভিযোগের দৃশ্য মানুষ আগে কখনো লাইভ দেখেনি)? নাকি এর সবকিছুর সম্মিলিত ফলে?

কথা উঠেছে প্রিয়া সাহার উল্লিখিত ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যার বিষয়টি নিয়ে। বলা হচ্ছে তিনি অতিরঞ্জিত একটি তথ্য উপস্থাপন করেছেন মার্কিন প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করবার জন্য। মানুষের প্রবণতা হলো মানুষ যখন নালিশ বা অভিযোগ করে, তখন সাধারণত সেটা অনেক বাড়িয়ে বলে। এক্ষেত্রে প্রিয়া সাহাই একমাত্র ব্যক্তি নন।

আমার মনে আছে ২০১৭ সালে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ বিষয়ক এক সেমিনারে। সেমিনার বিরতির ফাঁকে আমরা যখন ব্যক্তিগত আলাপচারিতা করছিলাম সেসময় এক ভদ্রমহিলা, যিনি গত নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করেছেন, সেখানে উপস্থিত ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এক কংগ্রেসম্যানকে বাংলাদেশে গুম হওয়ার সংখ্যা সম্পর্কে অতিরঞ্জিত, কল্পিত এক তথ্য দিলেন।

প্রিয়া সাহার অতিরঞ্জনের বিষয় নিয়ে অনেকে যেটা বলার চেষ্টা করছেন সেটা হল তিনি অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের গবেষণা গ্রন্থ ‘অ্যান ইনকোয়ারি ইন টু কজেস অ্যান্ড কনসিকোয়েন্সেস অব ডিপ্রাইভেশন অব হিন্দু মাইনরিটিজ ইন বাংলাদেশ থ্রু দ্য ভেস্টেড প্রপার্টি অ্যাক্ট’ বইয়ে উল্লিখিত ১৯৬৪ সাল থেকে অদ্যাবধি প্রতি বছর ১ লাখ ৯৬ হাজার ২৯৬ জন হিন্দু ‘হারিয়ে যাচ্ছেন’ বলে যা উল্লেখ করেছেন, সে রেফেরেন্সের  সূত্র ধরে একথা বলেছেন। এখানে বলতেই হয় যে, একটি গবেষণা গ্রন্থ বা প্রবন্ধে একটি তথ্য থাকা মানেই সেটি ধ্রুব সত্য নয়। অন্য আরো গবেষণায় যেহেতু এ তথ্যের সমর্থনে হয়নি; সুতরাং, এ সংখ্যাটি যে প্রামাণ্য সেটি বলা যাবে না। তবে বইটির মূল বক্তব্যের সাথে দ্বিমত করবার অবকাশ বোধহয় খুব কম।

এখন প্রশ্ন হল অতিরঞ্জিত এ বক্তব্য দ্বারা প্রিয়া সাহা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে কোন রাজনীতি এবং কাদের রাজনীতি প্রমোট করতে চান? তার এ বক্তব্যে কারা লাভবান আর কারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন? যে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘুর কথা তিনি উল্লেখ করলেন- তারা, বিশেষত সনাতন ধর্মালম্বীরা, তার কথায় কোনওভাবে উপকৃত হবেন, নাকি তা বাংলাদেশের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পালে নতুন হাওয়া লাগাবে? সমাজে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক বিভাজন তার কথায় প্রশমিত হবে, নাকি একে আরো গভীরতর করবে?

এখন দেখা যাক একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু বলতে আমরা কী বুঝি। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দুনিয়ার অনেক দেশেই, এমনকি প্রিয়া সাহা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ করেছেন সেখানেও, সমাজের সংখ্যাগুরু জনগণের কারো কারো কাছে সংখ্যালঘু বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। এ ধারণাকে ভিত্তি করে সেখানেও কেউ কেউ রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল করেন, যা আখেরে সংখ্যালঘুদের স্বার্থের বিপরীতে যায় বলেই অনেকে মনে করেন। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় সংখ্যালঘু বলতে আমরা কী বুঝি? সংখ্যালঘুদের সম অধিকার পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র কি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে?

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু বললেই সবার আগে আমাদের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের— অর্থাৎ, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের কথাই মনে আসে। বাংলাদেশে তাদের সম্মিলিত সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর সাত থেকে নয় শতাংশের মধ্যে হবে। এর বাইরে রয়েছে জাতিগত সংখ্যালঘু বা বিভিন্ন আদিবাসী বা জুম্ম জাতি, যাদেরকে সরকারী ভাষ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে বলা হয় ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’। এদের সম্মিলিত সংখ্যা এক শতাংশের বেশি নয়।

তবে, ধর্মীয় এবং জাতিগত ধারণার বাইরে অন্য ফর্মেও সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব কম বেশি সব রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেই দেখা যায়। এগুলি হল ভাষাগত, বর্ণগত, লিঙ্গীয়, মতাদর্শগত, যৌন আচরণ সংক্রান্ত এবং অন্যান্য। আজ পর্যন্ত এমন কোন রাষ্ট্র দেখা যায় নাই, যেখানে সব সংখ্যালঘুদের রাষ্ট্র এবং সমাজের সব ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরুদের মতই সম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

পাশ্চাত্যের উন্নত, উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে প্রচ্যের উন্নয়নশীল রাষ্ট্র, সব জায়গাতেই সংখ্যালঘুরা বৈষম্যের শিকার, পার্থক্য শুধু মাত্রাগত। তবে, দেখা গেছে তুলনামূলক বিচারে যেসমস্ত রাষ্ট্র অধিক গণতান্ত্রিক, সেক্যুলার এবং সমাজ ব্যবস্থা উদারনৈতিক, সেসমস্ত রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা মানসিকভাবে অধিক স্বস্তি বোধ করেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইসলামপন্থী এবং পরবর্তীতে মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের প্রচারণার ফলে বাংলাদেশে অনেকে সেক্যুলার এবং নাস্তিকতাকে প্রায় সমার্থক করে ফেলেন। পাশ্চাত্যের কোন রাষ্ট্র কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলির মত নাস্তিকতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হিসাবে ধরে নেয়নি। বরং শীতল যুদ্ধের সময় এ নাস্তিকতার বিরুদ্ধেই পাশ্চাত্যকে সরব থাকতে দেখা গেছে, যার ফলে ‘ইসলামপন্থী’, মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা সেসময় সেক্যুলার পাশ্চাত্যের সাথেই অধিক সংসক্তি বোধ করেছেন।

এখানে সেক্যুলার বলতে যে বিষয়টা বোঝানো হয়েছে সেটা হল রাষ্ট্র যেমন কোন ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হবে না, তেমনি শুধু কোন একটি ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা না করে, সমস্ত ধর্ম এবং ধর্ম সংক্রান্ত ধারণার বিকাশের সম পরিবেশ তৈরি করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পুরোপুরি সেক্যুলার রাষ্ট্র বলা যাবে কিনা এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও, সৌদি আরবের চেয়ে যে অধিক সেক্যুলার এ বিষয়ে কোন বিতর্ক নেই। ফলে জনসংখ্যার ১ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী সেখানে বিনা বাধায় ২,৬০০ এর অধিক মসজিদ তৈরি করতে পেরেছে।

অপরদিকে, ধর্ম নির্ভর রাজতন্ত্র থাকবার ফলে কোন অমুসলমানের পক্ষে সৌদি আরবে তাদের উপাসানালয় তৈরি করা সম্ভব নয়। এমনকি, সেখানকার অধিবাসী একজন শিয়া মুসলিম তার দেশের চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পাশ্চাত্যের কোন সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মনস্তাত্ত্বিকভাবে অধিক নিরাপদ বোধ করেন।

রাষ্ট্র ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হলেও সমাজ ব্যবস্থা যদি উদারনৈতিক না হয়, সেখানেও সংখ্যালঘুরা নিজেদের নিরাপদ বোধ করেন না। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, সমাজ উদারনৈতিক না হবার ফলে, গণতন্ত্র থাকা সত্ত্বেও ভারতের চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানরা অধিক নিরাপদ বোধ করেন, এমনকি ট্রাম্প আমলেও।

অপরদিকে, সমাজ ব্যবস্থা উদারনৈতিক হলেও রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি গণতান্ত্রিক না হয়, তাহলেও সে রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ করতে পারে না। উদাহারণস্বরূপ সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির কথা বলা যায়।

তাই দেখা যাচ্ছে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাবোধ তৈরির জন্য তিনটি উপাদান— বহুত্ববাদী গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম এবং উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা— জরুরী। এটা দেখা গেছে যে, এ তিনটির কোন একটির ঘাটতি যদি কোন রাষ্ট্রে থাকে, সে রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন থাকেন। যদিও এ তিনটি বিদ্যমান থাকবার অর্থ এই নয় যে, সংখ্যালঘুরা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হন না। কিন্তু, এ বৈষম্যের মাত্রা ধর্মীয় মৌলবাদী বা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চেয়ে কম। আজ পর্যন্ত এমন কোন রাষ্ট্র দেখা যায়নি, যা মৌলবাদ ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সেখানে অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান এবং একই সাথে সে রাষ্ট্রে সব রকমের সংখ্যালঘুরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন।

১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল তার মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল বহু মত ও পথকে ধারণ করে একটি সেক্যুলার, উদার গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী রাষ্ট্র গড়ে তোলা, যে রাষ্ট্র বাংলাদেশে বিশ্বাসী সব রকম সংখ্যালঘুদের ধারণ করবে। কিন্তু, বাস্তবতা হলো যে তিনটি উপাদান একটি রাষ্ট্র কাঠামোয় বিদ্যমান থাকলেও সংখ্যালঘুরা তুলনামূলক বিচারে নিরাপদ বোধ করেন; অর্থাৎ, বহুত্ববাদী (অর্থাৎ বহু মত এবং পথের উপস্থিতি)  গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম এবং উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা— তার কোনটিই আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপরই দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দলটি গণতন্ত্রের মূল উপাদান অর্থাৎ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বহুত্ববাদীতা এবং সংখ্যালঘুদের উপস্থিতির স্বীকৃতির বিপক্ষে দাঁড়াল। ‘ইসলামপন্থী’ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের মত একই সুরে তারাও সংখ্যাগুরুর জয়গান গাইলেন— যেটা ছিল পাকিস্তানি আমলের মূল চেতনা।

এ জয়গানের সূত্র ধরে সব জুম্ম জাতিকে নিজেদের পরিচয় ভুলে বাঙালি হয়ে যেতে বলা হল। পাকিস্তান আমলের শত্রু সম্পত্তি আইনের পুনরুজ্জীবন ঘটানো হল। উল্লেখ্য যে, হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করে দেশান্তরি করবার ক্ষেত্রে এ আইনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক মতাদর্শগত সংখ্যালঘুদের দমন করে একটি একক এবং তৎকালীন সময়ের সংখ্যাগুরুর মতবাদকে রাষ্ট্রে চাপিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হল।

পরবর্তী সময়ে সকল সামরিক এবং বেসামরিক শাসকরা কম বেশি একই পথে হেঁটেছেন। সংখ্যালঘু ইস্যুতে তাদের মাঝে দর্শনগত পার্থক্যের জায়গাটা খুব কম। পার্থক্যের যে জায়গাটা দেখা গেছে, সেটা মূলতঃ মাত্রাগত। ফলে সংখ্যালঘুরা (সব ধরনের, শুধু ধর্মীয় নয়) সব আমলেই কম-বেশি নিষ্পেষিত হয়েছেন।

২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর আওয়ামী লীগের অধীনে যে দুটো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এর দুটোই ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত এবং অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য। বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে একটি দল যখন ক্ষমতায় আসে তখন তার নৈতিক ভিত্তি স্বভাবতই কিছুটা দুর্বল থাকে। ফলে সে দলটি তার দুর্বলতা ঢাকবার চেষ্টা করে নানা বিষয়ে ক্রমাগত সফলতার জয়গান গেয়ে।

আওয়ামী লীগ তার শাসনামলে সবচেয়ে বড় যে সফলতার কথা বলে সেটি হল অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে তাদের আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ভালো আছে। পাশ্চাত্যের কাছে তারা নিজেদের ধারাবাহিক ক্ষমতায় থাকবার যৌক্তিকতা যে দুটো মূল উপাদানের উপর ভিত্তি করে তুলে ধরে তার একটি হল, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অপরটি হল, ‘ধর্মভিত্তিক’ রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদীদের (প্রচলিত ভাষায় জঙ্গি) দমনে সফল হওয়া। এ দুটো উপাদান আবার একে অন্যের সাথে যুক্ত। কেননা, এ সন্ত্রাসবাদীদের অন্যতম টার্গেট হলেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা।

প্রিয়া সাহা যে কাজটি করেছেন সেটি হল, যে মূল উপাদানের উপর দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ তার শাসনকে নৈতিকভাবে জায়েজ করে, সে মূল উপাদানকে ধরে টান দেয়া। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জানালেন যে, দশ বছরের অধিক শাসনেও আওয়ামী লীগ ‘মৌলবাদী’ সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে, তাদের দ্বারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গুম হয়ে যাওয়া অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ, দল হিসাবে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ এবং এ ক্ষেত্রে মার্কিন হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।

এর পূর্বে  মার্কিন রাষ্ট্রপতির কাছে গোপনে বা প্রকাশ্যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নেওয়ার অনুরোধ আর কেউ করেনি। বিএনপি, জামায়াত গত দশ বছরে চেষ্টা করেও যেটা করতে পারেনি, এক প্রিয়া সাহা সে কাজটি করে ফেলেছেন। দল হিসাবে আওয়ামী লীগকে তিনি খোদ মার্কিন পেসিডেন্টের কাছে ব্যর্থ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

এ বিব্রতকর অবস্থায় আওয়ামী লীগকে উদ্ধার করতে সবচেয়ে আগে এগিয়ে এসেছে বিএনপি এবং ‘ইসলামপন্থী’ দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। ক্রিকেট ছাড়া বাংলাদেশে কোন বিষয়ে তেমন জাতীয় ঐক্য দেখা যায় না। কিন্তু প্রিয়া সাহার প্রশ্নে কিছু ব্যতিক্রম বাদে ‘ইসলামপন্থী’, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, বামপন্থী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়েছেন।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যে সবচেয়ে ভালো আছে এ কথা ‘ইসলামপন্থী’ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের চেয়ে বেশি আর কেউ বলেনি। আওয়ামী লীগের এ সঙ্কটে ‘ইসলামপন্থী’ এবং বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে সরবে উপস্থিত হয়ে এ ‘সার্টিফিকেট’ দিয়ে দিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগ আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা শুধু ভালো নয়, ‘রাজা’র হালে আছেন। আওয়ামী লীগের প্রচারণা সেল দুর্বল বলে অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থক যে অভিযোগ করেন সেটাকে আমলে নিয়ে বলা যায়, তাদের এ দুর্বলতাটুকু ঢেকে দিয়েছেন তাদের প্রতিপক্ষ বিএনপি এবং ‘ইসলামপন্থী’ দলের কর্মীরা।

বিএনপি এবং ‘ইসলামপন্থী’ দলের কর্মীরা আওয়ামী লীগকে উদ্ধারের ব্রত নিয়ে যে এ কাজ করেছেন তা নয়। তারা এটি করেছেন তাদের মতাদর্শগত দুর্বলতার ফাঁদে পড়ে। তাদের মতাদর্শগত উৎস হল জিন্নাহর ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’। এ থেকে তারা এখনো বেরিয়ে আসতে পারেননি। এ তত্ত্ব অনুসারে তাদের মূল প্রতিপক্ষ এখনো হিন্দুরা। ফলে, তাদের রাজনীতির মূল বক্তব্য হল ‘সেক্যুলার’ আওয়ামী লীগের অধীনে হিন্দুসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যেহেতু ভালো আছেন, তাই মুসলমানদের ভালো থাকতে হলে ‘ইসলামপন্থী’ বা মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের বেছে নিতে হবে।

উল্লেখ্য যে, সেক্যুলার মতাদর্শ থেকে সরে গিয়ে বহু আগেই আওয়ামী লীগ মুসলিম জাতীয়তাবাদ এবং ‘ইসলামপন্থার’ রাজনীতির সাথে আপস করলেও, তারা এখনো এ দলটিকে সেক্যুলার বলে মনে করেন।বস্তুত, মুসলমান কেন্দ্রিক রাজনীতি করতে যেয়েই তারা ক্রমাগত আওয়ামী লীগকে এ ‘সার্টিফিকেট’ দিয়ে গেছেন যে, তাদের শাসনে মুসলমানরা নয় বরং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সবচাইতে ভালো আছেন।

গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের তত্ত্ব দিয়ে ২০১৯ এ রাজনীতি করতে যাবার সঙ্কটটা ‘ইসলামপন্থি’ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি। বর্তমান সময়ে যেকোন সংখ্যালঘুকে ভালো রাখতে পারা যে একটি দলের সফলতা, সেটি বুঝতে পারার অক্ষমতা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে যেমন সুবিধা দিয়েছে, তেমনি প্রিয়া সাহা ইস্যুতেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়বার হাত থেকে রক্ষা করেছে। বস্তুত,এর ফলেই অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতও প্রিয়া সাহার অভিযোগ যে সঠিক নয়, এ বিবৃতি দিয়েছেন।

এত দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাবার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়টা পরিষ্কার করতে চেয়েছে যে, বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের সাথে তারা সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। কেননা, এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে অন্য কোন বিকল্পও নেই। বিশ্ব রাজনীতিতে চীন এবং রাশিয়ার যে উত্থান তা ঠেকাবার জন্য অনির্ভরযোগ্য মিত্র ভারতকে পাশে পাওয়া ছাড়া আমেরিকার সামনে আর কোন পথ খোলা নেই।

অনির্ভরযোগ্য এ কারণে যে, ভারত আবার রাশিয়ার সাথে শক্তপোক্তভাবে গাঁটছাড়া বাঁধা। সে ভারতের বর্তমান শাসক দল বিজেপিসহ বিরোধী কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এমনকি পশ্চিম বাংলার তৃণমূলের বাংলাদেশের একমাত্র পছন্দের দল আওয়ামী লীগ। ফলে, যুক্তরাষ্ট্র এক দিকে যেমন ভারত বিরোধী অবস্থান নেওয়ার মত অবস্থায় নেই, তেমনি পাশাপাশি চীন, রাশিয়ার উত্থানসহ, আভ্যন্তরীণ নানাবিধ কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে আগের মত জোরালো ভূমিকা পালন করবার মত অবস্থায়ও নেই। পাশাপাশি, পূর্বের ওবামা প্রশাসনের চেয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ‘ইসলামপন্থী’ দলগুলো থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখবার নীতি অনুসরণ করছে; যার সব কিছুই বিশ্ব রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে গেছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও একক নেতৃত্বে পরিচালিত হবার ফলে দলের যে দুর্বলতা সেটা আবার প্রিয়া সাহা ইস্যুতে সামনে এসেছে। একক নেতৃত্বের মূল সমস্যা হল দলের কেন্দ্রীয় নেতা ছাড়া অন্যরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না অথবা ভুল সিদ্ধান্ত নেন।তাই ইদানিং দেখা যাচ্ছে নুসরাত হত্যাকাণ্ডসহ অনেক বিষয়েই প্রধানমন্ত্রীকে হসস্তক্ষেপ করতে বা সিদ্ধান্ত দিতে হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের নেতাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতি প্রকৃতি না বুঝেই প্রিয়া সাহাকে আইনের আওতায় আনা, বিচার, জিজ্ঞাসাবাদ করা ইত্যাদি বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। অতি উৎসাহীরা আবার এক কদম এগিয়ে, আবেগের বশে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা ঠুকে দিয়েছেন। একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই এসব অতি আবেগী কাজের ফলে আন্তর্জাতিক মহলে এর কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা বুঝতে পেরে এসব থেকে বিরত থাকবার নির্দেশ দিয়েছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে ধর্মসহ যেকোন বিষয়েই মত প্রকাশের একটি আপাত স্বাধীন পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ফলে, শেখ হাসিনা যে বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন সেটা হল, প্রিয়া সাহাকে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করাবার বা জিজ্ঞাসাবাদ করবার অর্থ হবে বর্তমান সরকারের অধীনে মত প্রকাশ বা ধর্মীয় স্বাধীনতা যে নেই, এ বিষয়টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে স্পস্ট করা। রাজনীতির যে ‘ট্র্যাপ’-টি তিনি বুঝতে পেরেছেন, সেটা দলের আর কেউ বুঝে উঠতে পারেননি।

একটি রাষ্ট্র কতটা গণতান্ত্রিক এবং কতটা মানবিক তা বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হল রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের সে রাষ্ট্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা। সব রকম সংখ্যালঘুরা যদি মনে করেন সে রাষ্ট্রটি গণতান্ত্রিক এবং মানবিক, তাহলেই সেটি গণতান্ত্রিক এবং মানবিক রাষ্ট্র। ভারত সম্পর্কে  ভালোভাবে জানাবার উপায় হল সেদেশের একজন মুসলমান বা খ্রিস্টানের সাথে আলাপ করা, পাকিস্তানে সেদেশের একজন হিন্দুর সাথে কথা বলা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেটা হবে একজন কৃষ্ণাঙ্গ, মুসলিম বা অন্য সংখ্যালঘু  সম্প্রদায়ের কেউ।তেমনি বাংলাদেশ কতটা গণতান্ত্রিক এবং মানবিক সেটি বোঝার ভালো উপায় হল এ সম্পর্কে  ধর্মীয়, জাতিগত, রাজনৈতিক এবং মতাদর্শিক সংখ্যালঘুদের মতামত।

প্রিয়া সাহা ‘ট্র্যাপ’ থেকে দল হিসাবে আওয়ামী লীগ আপাতত মুক্তি পেলেও সবরকমের সংখ্যালঘুরা ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন না,যতদিন পর্যন্ত  না মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শকে ধারণ করে, বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের ভিত্তিতে, সেক্যুলার রাষ্ট্র  এবং উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যাবে। আর তা না হওয়া পর্যন্ত সংখ্যালঘুরা নয়; বরং সংখ্যাগুরুরাই বলে যাবেন যে, সংখ্যালঘুরা  “ভালো আছেন”।