ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে
পাভেল হেরেছেন, পাভেল জিতেছেন!
অর্থ নেই, সম্পদ নেই, নেই রাজনৈতিক কোনো নেতার ছত্রছায়া। তবুও তিনি হয়েছিলেন ফরিদগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। তৃণমূলের হাজারো কর্মীর ভালোবাসা ছিলো যার প্রধান পুঁজি। যিনি নিজে সম্পদশালী না হয়েও অন্যের বিপদে নিজ উপার্জিত সীমিত সম্পদ ব্যয় করতে কার্পণ্য করেননি একবিন্দুও। সেই মানুষটির নাম মোঃ পাভেল হোসেন পাটওয়ারী। ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হতদরিদ্র এই যুবনেতা হতে চেয়েছিলেন ফরিদগঞ্জের ৫ লক্ষাধিক মানুষের অভিভাবক। নির্বাচনে যার প্রতীক ছিলো উড়োজাহাজ।
ক্ষমতা, সম্পদ, রাজনৈতিক প্রটোকল সবকিছুতে বাকি দশ-বারোজন প্রার্থীর চেয়ে তার অবস্থান পেছনেই। তবুও সকলকে পেছনে ফেলে প্রচার-প্রচারণায় পাভেল পাটওয়ারীর উড়োজাহাজ নির্বাচনের পূর্বদিন পর্যন্ত ছিলো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ফরিদগঞ্জের পথে প্রান্তরে, চায়ের আড্ডায়, বাজারে, লোকালয়ে পাভেল সমর্থকদের মধ্যে ছিলো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। জনমনে ছিলো সাধারণ প্রশ্ন ‘পাভেল পারবে তো?’
পাভেলের ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা সাধারণ কোনো মানুষের মতো নয়। জীবনসংগ্রামে বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ছোট্ট অসহায় পাভেল আজকের যুবনেতা পাভেলে পরিণত হয়েছেন। পাভেল পাটওয়ারী যখন পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখেননি তখনই তার পিতৃবিয়োগ ঘটে। সেই থেকে পাভেল পাটওয়ারীর মা তাকে বড় করেছেন বহু কষ্টে। ফরিদগঞ্জ রূপসা ইউনিয়নের গাব্দেরগাঁও গ্রামের বিলের মধ্যে ছোট্ট একটি ঘরে বেড়ে ওঠা পাভেল পাটওয়ারী ¯্রােতের প্রতিকূলে বেড়ে উঠলেও মূল্যবোধসম্পন্ন একজন মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন সর্বমহলে। দারিদ্র্যকে যিনি জয় করতে পেরেছেন তিনিইতো বুঝেন দারিদ্র্যের ব্যথা কত কষ্টের। তাই রাজনীতিতে আসার পর থেকে যেখানেই কাউকে কষ্টে কাতরাতে দেখেছেন সেখানেই ছুটে গিয়েছেন অকৃত্রিম বন্ধুর ন্যায়। প্রথমে ছাত্রলীগ নেতা, পরে যুবলীগ নেতা হয়ে চষে বেড়িয়েছেন ফরিদগঞ্জের প্রতিটি ইউনিয়ন। পুরো উপজেলার এমন কোনো গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে পাভেল পাটওয়ারীর কর্মী নেই। রাজনৈতিক পদ নেই, পদবী নেই তবুও হাজারো কর্মীর নেতা ২৬ বছরের এই যুবক।
নির্বাচন মানেই লাখ টাকার খেলা হলেও পাভেল পাটওয়ারী প্রমাণ করেছেন অর্থ ছাড়াও একটি নির্বাচন সম্পন্ন করা যায়। জানা যায়, উপজেলার ১১৮টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে যতোজন এজেন্ট ছিলো উড়োজাহাজের পক্ষে, একজন এজেন্টও কোনো পারিশ্রমিক নেয়নি পাভেল পাটওয়ারীর কাছ থেকে। দুপুরের খাবার পর্যন্ত নির্বাচনী এজেন্ট, কর্মী-সমর্থকরা খেয়ে নিয়েছেন নিজ অর্থে। নির্বাচনের পূর্বদিন পর্যন্ত যতটি শোডাউন হয়েছে প্রতিটি শোডাউনে যতোটি পিকআপ ভ্যান এসেছে একটি পিকআপ ভ্যানের চালকও ভাড়া নেয়নি পাভেল পাটওয়ারীর কাছ থেকে! তৃণমূলের কর্মীরা নিজেরাই নিজ দায়িত্বে ছাপিয়েছেন অধিকাংশ পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন। সকলের দাবি ছিলো একটাই ‘পাভেল ভাই এতো বছর আমাদের জন্যে করেছেন এবার আমাদের করার পালা।’ তাই ২৪ মার্চ দিনটি মোটেও পাভেল পাটওয়ারীর জন্যে পরীক্ষার দিন ছিলো না। পরীক্ষার দিন ছিলো পাভেল পাটওয়ারীর কর্মীদের। যাদের জন্যে এতোটি বছর নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তিনি।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার রাজনৈতিক অবিভাবক বলা যায় যাঁদের তাঁদের সকলের দোয়া নিয়ে পাভেল পাটওয়ারী নেমেছেন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। ভাইস চেয়ারম্যান হয়ে এলাকার মানুষের সেবা করার একটি প্লাটফর্ম পাওয়ার আকাক্সক্ষা ছিলো তার। প্রতীক বরাদ্দের পর হজার হাজার কর্মীর সমর্থন হয়তো কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তার জন্যে। তাই নির্বাচনের ফল গণনার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সকলের দৃষ্টি ছিলো পাভেলের উড়োজাহাজের দিকে। উড়োজাহাজ কি ফরিদগঞ্জের আকাশে আগামী ৫ বছরের জন্যে উড়বে, নাকি বিধ্বস্ত হবে নির্বাচনের দিনই নাটকীয় সেই মুহূর্ত দেখার প্রতীক্ষায় ছিলো উৎসুক জনতা। নির্বাচনের দিন সকল কেন্দ্রে গুঞ্জন ছিলো পাভেল পাটওয়ারীর অবস্থা সুবিধাজনক। প্রতিটি কেন্দ্র থেকে যখন ফলাফল আসছিলো তখনও খবর ভেসে আসছিলো বিভিন্ন কেন্দ্রে পাভেল পাটওয়ারী এগিয়ে আছেন বিপুল ভোটে। অনেকে তার ছবি দিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় আগাম অভিনন্দন বার্তাও জানিয়েছেন। কিন্তু সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে যখন খবর আসে পাভেল পাটওয়ারী ফলাফল ঘোষিত ২৫ কেন্দ্রের মধ্যে ৭ হাজার ভোটে পিছিয়ে আছেন তখনই হাহাকার দেখা যায় কর্মীদের মধ্যে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে পিকআপ ভ্যান, অটোরিক্সায় কিংবা পায়ে হেঁটে যে যেভাবে পেরেছে জড়ো হয়েছে ফরিদগঞ্জ উপজেলা চত্বরে। এ সময় নেতা-কর্মীরা শ্লোগান দিতে থাকে পাভেল পাটওয়ারীর পক্ষে। উড়োজাহাজের বহু কর্মী-সমর্থককে উপজেলা পরিষদ মসজিদের পাশে বসে কান্না করতে দেখা গেছে। রাত সাড়ে ৯টায় যখন ৫৫ কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করা হয় তখন বাকি সকল প্রার্থীকে পেছনে ফেলে পাভেল পাটওয়ারী ১ হাজার ভোট সামনে চলে যায়। বড় পর্দায় এ ফলাফল ঘোষণার সাথে সাথে উড়োজাহাজের কর্মী-সমর্থকরা আনন্দে মেতে উঠেন। পুরো উপজেলা চত্বর তখন ‘উড়োজাহাজ’ আর ‘পাভেল ভাই’ শ্লোগানে মুখরিত। রাত ১০টায় যখন ১০৫টি কেন্দ্রের ফলাফল চলে আসে তখন পাভেল পাটওয়ারী পিছিয়ে পড়েন ২ হাজার ভোটে। উপজেলা চত্বরে জড়ো হওয়া হাজারো কর্মী তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন। সবশেষে ১১৮ কেন্দ্রের ফলাফলে যখন মোঃ তসলিম আহমেদ বই প্রতীক নিয়ে বেসরকারিভাবে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত তখন উড়োজাহাজ প্রতীকে পাভেল পাটওয়ারীর অবস্থান তৃতীয়।
রাত ১১টা থেকে পাভেল পাটওয়ারীকে সান্ত¡না দিয়ে তার পক্ষে স্ট্যাটাসের ঝড় উঠে সোস্যাল মিডিয়ায়। সকলে দেখেছে এই যুবনেতার কারিশমা। বড় কোনো পদে না থেকেও, অর্থ বিত্তের মালিক না হয়েও শুধু মানুষের ভালোবাসায় একজন প্রার্থী যে একটি নির্বাচনে এতোটা আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে তা দেখিয়েছেন পাভেল হোসেন পাটওয়ারী। তাই নির্বাচনের ফলাফলের সমীকরণে পাভেল পাটওয়ারী হারলেও তিনি জিতেছেন মানুষের ভালোবাসায়। মাত্র ২৬ বছরের একজন যুবক হাজারো মানুষের ভালোবাসায় এতোটা সিক্ত হতে পারে তা হয়তো ধারণা ছিলো না সাধারণ মানুষের। তাইতো সোস্যাল মিডিয়ার প্রতিটি স্ট্যাটাসের মূল সারমর্ম ছিলো একটাইÑ‘ভোটের মাঠে হারলেও পাভেল পাটওয়ারী আমাদের হাজারো নেতা-কর্মীর কাছে জননেতা হয়েই থাকবেন।’ গতকাল সারাদিন ফরিদগঞ্জের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো ‘পাভেল হেরেছেন, পাভেল জিতেছেন!’