শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারে নতুন চাপে জামায়াত
দলকে সংগঠিত করতে গোপনে জামায়াতের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করার পর সরকারের টনক নড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এরই মধ্যে দলটির শীর্ষ ৩ নেতাসহ গুরুত্বপূর্ণ ২১ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। এরই মধ্যে আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল গ্রেপ্তার হওয়ার পরদিন মঙ্গলবার নতুন নেতা নিযুক্ত করেছে দলটি। একই সঙ্গে কাল বৃহস্পতিবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালসহ তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী।
জামায়াত-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, দলটির নেতারা মনে করেন, নতুন করে এই গ্রেপ্তার অভিযানের সঙ্গে আগামী নির্বাচনের সম্পর্ক আছে। আগামী নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে জামায়াত গোপনে সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এরই মধ্যে এই ধরপাকড় তাদের জন্য নতুন ধাক্কা। শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাইকে হঠাৎ গ্রেপ্তারের পর জামায়াতের ভেতরে-বাইরে এমন আলোচনাও আছে যে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতকে বাগে আনতে ভেতরে-ভেতরে ভিন্ন চেষ্টাও হতে পারে।
অবশ্য জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তারের পেছনে নির্বাচনের সম্পর্ক থাকার কথা নাকচ করে দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ। তিনি বলেন, গণমাধ্যমে পুলিশের যে বক্তব্য এসেছে, তাতে জামায়াতের নেতারা ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমে ব্যস্ত ছিলেন। সে কারণে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখনো নির্বাচনের তারিখই হয়নি। তা ছাড়া আমরা আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ আশা করি।
সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, জামায়াত যে হঠাৎ সক্রিয় হয়েছে, বিষয়টি কিছুদিন আগে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো টের পায়। এ কারণে সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ অভিযান শুরু করে এবং জামায়াত ও শিবিরের বেশ কজন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে।
সর্বশেষ গত সোমবার রাজধানীর উত্তরা থেকে দলের আমির মকবুল আহমাদ, নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার, সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমানসহ ৯ জন গ্রেপ্তার হন। পুলিশ বলছে, গোপন বৈঠক করছে, এমন খবর পেয়ে উত্তরার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে এসব নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল তাঁদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
গতকাল দলের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুজিবুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত আমির ও সহকারী সেক্রেটারি এ টি এম মাসুমকে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল নিযুক্ত করেছে জামায়াত। দলটির পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দলের গঠনতন্ত্র মোতাবেক এ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নবনিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত আমির গতকালই এক বিবৃতিতে গ্রেপ্তার নেতাদের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা মামলা’ দিয়ে সবাইকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার প্রতিবাদে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তা হলো, বুধবার সারা দেশে বিক্ষোভ, বৃহস্পতিবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ও শুক্রবার নেতাদের মুক্তির জন্য দোয়া।
সোমবার একসঙ্গে শীর্ষস্থানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের উত্তরা বৈঠকে মিলিত হওয়া এবং গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনায় জামায়াতের নেতা-কর্মীদের একটি অংশের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তাঁরা মনে করছেন, এটা নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শিতার পরিচয়। আবার দলের কেউ কেউ সাম্প্রতিক কয়েকটি গ্রেপ্তার অভিযানের ঘটনাকে অভ্যন্তরীণ বিরোধ বলেও সন্দেহ করছেন।
জামায়াতের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন নিয়ে নায়েবে আমির শামসুল ইসলাম ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর মধ্যে বিরোধ ছিল নেতা-কর্মীদের কাছে অনেকটা প্রকাশ্য। এতে কেন্দ্র ও চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের বড় অংশ শামসুল ইসলামের পক্ষে, আর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ও স্থানীয় নেতৃত্ব শাহজাহান চৌধুরীর পক্ষে অবস্থান নেন। এই অবস্থায় কেন্দ্র থেকে শাহজাহান চৌধুরীকে চট্টগ্রাম শহরের একটি আসনে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে তিনি সম্মত হননি। সম্প্রতি ছাত্রশিবিরের সভাপতি ইয়াসীর আরাফাত চট্টগ্রাম গিয়ে শামসুল ইসলামের পক্ষে বক্তব্য দেন। এতে দলে প্রতিক্রিয়া হয়। এ নিয়ে ফেসবুকে দুই পক্ষ সরব হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার ঢাকায় সমঝোতা বৈঠক বসে। সেখান থেকে শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হন।
এদিকে জামায়াতের আমির, সেক্রেটারিসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের যে হারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তা দেশের জন্য শুভ লক্ষণ নয়।
জামায়াতের নয় নেতা রিমান্ডে
জামায়াতের নয়জন নেতাকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নিয়েছে কদমতলী থানার পুলিশ। মঙ্গলবার কদমতলী থানার অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের দুই মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কদমতলী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাজু মিয়া আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে বলেছেন, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে অস্ত্র-বিস্ফোরক ও জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়।
ডিবির উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম বলেন, দলকে চাঙা করার উপায়, সংগঠনকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায় এবং বর্তমান অবস্থায় তাঁদের করণীয় বিষয় নিয়ে সোমবার রাতে তাঁরা গোপন বৈঠকে বসেছিলেন। খবর পেয়ে ডিবি পুলিশের সহায়তা নিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করে।