প্রিয় এএসএম দেলওয়ার হোসেন স্যার
অদ্ভুত এক চাপা কষ্ট নিয়ে নৈঃশব্দের ভেতর বসে আছি। মন খারাপ হলে আমি নদীর কাছে যাই। যথারীতি খুব সকালে নদীর কাছে গিয়ে বসেছি। চারদিকে বসন্ত হাওয়া। বড়স্টেশনের বটগাছটির অসংখ্য পাতা উড়ছে যেন। কিছুক্ষণ পরপর বাতাস এসে গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। অথচ মন ভালো হলো না। স্পষ্ট টের পাচ্ছি আমার ভেতরে কেউ কাঁদছে। কোনোভাবেই স্থির হতে পারি না। ডানা ঝাপটাই। এ কেমন বিদায়ের সুর চারদিকে!
দুই.
ড. এএসএম দেলওয়ার হোসেন। তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। গত ১ মার্চ তিনি চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন। একবার ভেবেছি স্যারের বিদায়ের দিনটিতে কলেজে যাই। তাঁর কাছে দাঁড়াই। যথারীতি নিশ্চয়ই কিছু গল্প হবে। লেখালেখির গল্প, কলেজের গল্প। কিন্তু কীভাবে যাবো? খুব বাজে এক অভ্যেস আমার। প্রিয় কারো বিদায়ের দিন যাই না। আমি যেতে পারি না। চোখ ভারি হয়ে আসে। কথা আটকে যায়। হাঁসফাঁস করি। দেলওয়ার স্যারের বিদায়ের দিন গেলে নিশ্চয়ই এমনই হতো। আমি যাইনি। যতবার ফেসবুক খুলি স্যারের ছবি দেখি। কেউ না কেউ পোস্ট করেছে। স্যারকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। শূন্যতা বোধ করি। এ শহরে বারবার খুব অল্প ক’জন মানুষের ¯েœহে আপ্লুত হয়েছি। ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছি। দেলওয়ার স্যার তাঁদেরই একজন। তাঁর ¯েœহ, সান্নিধ্য আর আন্তরিকতা কার কাছে পাবো?
তিন.
দেলওয়ার স্যারের সাথে পরিচয় প্রায় ৮ বছর আগে। আমি অনার্সে পড়ি। ২০১২ সাল। স্যার তখন কলেজের উপাধ্যক্ষ। স্যারের পড়াশোনাও বাংলা নিয়ে। তাঁর সাথে প্রথম পরিচয়ের সূত্র কী আজ ঠিক মনে নেই। হঠাৎ কোনো একদিন টের পেলাম স্যারের ¯েœহ পাচ্ছি। নিয়মিত তাঁর কাছে যাচ্ছি। দরকারে-অদরকারে যাচ্ছি। স্যারও ডাকছেন, গল্প করছেন। আমি অল্পস্বল্প লিখি, স্যার জানেন। কথা বেশি হয় লেখালেখি নিয়েই। স্যার আগ্রহ নিয়ে আমার লেখার কথা জানতে চান। কোথায়, কোন্ পত্রিকায় কী কী প্রকাশিত হলো স্যারকে জানাই। স্যার লেখা পড়েন, মতামত জানান। ২০১৪ সালে কালের কণ্ঠে ‘হেঁটে হেঁটে বাড়ি’ শিরোনামে একটি ফিচার প্রকাশিত হয়। আমার এ লেখাটি পড়ে স্যার খুব খুশি হয়েছিলেন। এরপর মাঝে মাঝেই বলতেন, ওই লেখাটি খুব ভালো হয়েছে। তোমার হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরা আমার চোখে যেন ভাসে। একসময় জানতে পারি, স্যারও কবিতা লিখেন। তাঁর গানও রয়েছে। স্যার নিজের লেখালেখির বিষয় কথা বলতে দ্বিধা করতেন। বেশি জোরাজুরি না করলে বলতে চাইতেন না। একসময় স্যার তাঁর প্রকাশিত একটি বই দেখালেন। কবিতার বই! আমি তো অবাক! এতদিন পরে জানলাম তাঁর কবিতার বইও আছে! এভাবেই সময় কেটেছে। সাহিত্য, পড়াশোনা বিষয়ক আলাপনে।
চার.
কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ মিহির স্যার অবসরে গেলেন। দেলওয়ার স্যার অধ্যক্ষ হিসেবে পদোন্নতি পেলেন। এবং চাঁদপুর কলেজেই তাঁর কর্মস্থল রইলো। তাঁর অধ্যক্ষ হওয়াতে সে কী আনন্দ আমাদের! স্যারের সাথে কত রকম স্মৃতি আমার। কয়েকটি বলতেই চাচ্ছি। একবার রোটারি ক্লাবে একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। স্যার প্রধান অতিথি। আমি গিয়েছি। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌঁছলে আমি বের হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে এসেছি। তখন বিকেল। এমন সময়ই দেখি দেলওয়ার স্যার কল দিয়েছেন। রিসিভ করি। বললেন, তুমি কি অবসর? বললাম, জি। স্যার বললেন, তাহলে চলো একটু নদী দেখি, নৌকায় চড়ি। আবার রোটারি ক্লাবে গেলাম। স্যারসহ চলে এলাম প্রেসক্লাব ঘাটে। ডাকাতিয়া নদী। নৌকা ভাড়া করে উঠি। নৌকা কিছু দূর যেতেই প্রসঙ্গক্রমে গানের কথা ওঠে। স্যার মৃদুস্বরে একটি গান ধরেন। কিন্তু বেশিক্ষণ গাইতে পারলেন না। তার আগেই দূরের আরেকটি নৌকা থেকে অনেক তরুণ স্যারকে সালাম জানালো। গান থেমে গেলো। কিন্তু আড্ডা চললো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ঘাটে ফিরেছি। দেখলাম, নৌকার তরুণরা স্যারের জন্যে অপেক্ষা করছে। স্যার যে সবার প্রিয়। সবাই স্যারের সাথে অনেক ছবি তুললো। তারপর ফিরলাম। আহা স্মৃতি, আহা দিন!
পাঁচ.
আরেকদিনের কথা। বাংলা বিভাগের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমরা উপভোগ করছি। যথারীতি দেলওয়ার স্যার অতিথি হিসেবে আছেন। অনুষ্ঠানে গণ্যমান্যরা উপস্থিত। বক্তৃতায়, গানে, কবিতায় অনুষ্ঠান শেষ হলো। আমি কলেজ থেকে বাসায় ফিরবো বলে হাঁটছি। হঠাৎ পেছন থেকে স্যারের ডাক। স্যারের কাছে গেলে অন্য অতিথি, আমার শিক্ষকদের সামনেই বললেন, তোমার সাথে ছবি তুলতে চাই। সবাইকে বললেন, ও বিখ্যাত হলে তখন তো ছবি তোলার সুযোগ পাবো না। আগেই তুলে রাখি। আমি বিস্ময়ে মাটির সাথে মিশে যেতে থাকি। ছবি তোলা হয়। আমি কথা খুঁজতে থাকি। কিন্তু খুঁজে পাই না। আমি অতি সামান্য একজন, তাঁর এমন অপরিসীম ¯েœহে, বিনয়ে আমি কী বলতে পারি!
ছয়.
তখন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুস সবুর ম-ল। তিনি আমাদের এক গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন। জেলা ব্র্যান্ডিং ম্যাগাজিন ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ প্রকাশিত হবে। দেলওয়ার স্যার প্রধান সম্পাদক। আমাদের কাজী শাহাদাত স্যার, রতন স্যার, পীযূষ দাসহ অনেকেই সম্পাদনা পরিষদে আছেন। আমিও আছি। তবে আমি সবার কনিষ্ঠ সদস্য। এ কাজে আমাদের প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। মনে আছে সরকারি কলেজে দুদিন সম্পাদনার কাজ করেছি। সবাই মিলে পুরোরাত নির্ঘুম ছিলাম। রাতে কলেজে খেয়েছি। কারণ কাজটা দ্রুত শেষ করতে হবে। ওই দুদিন যখন কলেজ থেকে বের হয়েছি, তখন ভোর! স্যারসহ সবাই ভোরে বাসায় ফিরেছি। আনন্দের বিষয় হলো, পরবর্তীতে স্যার জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের জন্যে সরকারি কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ পুরস্কার পিএএ সম্মানে ভূষিত হন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন।
সাত.
আগে প্রায়ই বিকেলে কলেজে হাঁটতে যেতাম। এমনি একদিন হাঁটতে গিয়েছি। দেখি স্যারের রুম খোলা। গেলাম। স্যার বসে আছেন। কলেজে পিয়ন ছাড়া আর কেউ আছে বলে মনে হয়নি। স্যারকে বললাম, স্যার বাসায় যাবেন না? স্যার বললেন, একজন শিক্ষার্থী এসেছে শাহরাস্তি থেকে। তাঁর ছবি সত্যায়িত করতে হবে। কলেজে অন্য কেউ নেই। ছবি সত্যায়িত না করলে শিক্ষার্থীটিকে আবার কাল শাহরাস্তি থেকে আসতে হবে। তার যাতে আর আসা না লাগে সেজন্যে তিনি অপেক্ষা করছেন। বললাম, ওই শিক্ষার্থী কোথায়? স্যার বললেন, ছবি কম এনেছে। নতুন করে ছবি প্রিন্ট করতে গেছে। সে এলে ছবি সত্যায়িত করে বাসায় ফিরবো!
শিক্ষার্থীর প্রতি এমন আন্তরিকতা দেলওয়ার স্যার বলেই হয়তো সম্ভব।
আট.
সাধারণত কলেজ অধ্যক্ষ ক্লাস নেন না। কলেজের দেখভাল করেই তাঁদের সময় কাটে। আমাদের সৌভাগ্য দেলওয়ার স্যার কয়েকদিন আমাদের ক্লাস নিয়েছেন। স্যার ‘যাত্রাশিল্প’-এর ওপর পিএইচ.ডি করেছিলেন। তিনি আগ্রহ নিয়ে ক্লাসে আসতেন। আর তিনি ক্লাসে এলেই দেখা যেত অভূতপূর্ব এক দৃশ্য। স্যারের ক্লাসে আমাদের বিভাগের শিক্ষকরাও ছাত্রদের পাশে বসে পড়তেন। তারাও স্যারের ক্লাস উপভোগ করতেন। স্যারের পড়ানোর ঢংও ছিল মনোমুগ্ধকর।
নয়.
ব্যক্তিগত অনেক গল্প বলা হলো। স্যারের সম্পর্কে দু কথা বলি। আমি ২৭ বসন্ত পার করেছি। এতসব দিনে তাঁর মতো বিনয়ী মানুষ একজনও দেখিনি। তিনি বিনয়ী এবং একই সাথে অমায়িক, হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। তাঁর আন্তরিকতার কথা সরকারি কলেজের ছাত্র-শিক্ষক সবাই জানেন। খুব আস্তে কথা বলেন। প্রচারবিমুখ তিনি। আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন। লেখালেখির বিষয়ে ভীষণ খুঁতখুঁতে। বারবার প্রুফ দেখা ছাড়া লেখা কোথাও দেন না। স্যারের জন্মস্থান মানিকগঞ্জে। তাঁর জেলার গল্প বলতে তিনি বিশেষ পছন্দ করেন। স্যার সাতবছরের বেশি সময় চাঁদপুর জেলার সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চাঁদপুর সরকারি কলেজের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে একবারের জন্যেও কোনো অনিয়ম, অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেনি। অর্থাৎ শতভাগ সততার মাধ্যমে তিনি কলেজ পরিচালনা করেছেন। চাঁদপুর সরকারি কলেজের জন্যে তিনি নিঃসন্দেহে বিশেষ একজন অধ্যক্ষ। এ কলেজে স্যারের কর্মকাল ৭ বছর ৭ মাস ৭ দিন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাত মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস, স্বাধীনতা দিবস এবং মুজিববর্ষের সূচনামাসে স্যার চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন। আমি মনে করি, এটি স্যারের জন্যে খুবই সুন্দর মুহূর্ত।
দশ.
স্যারের আনুষ্ঠানিক বিদায়ের দিনে আমি যাইনি। যতদূর জানি, স্যার এ মাস চাঁদপুরে থাকবেন। আরো আট-দশদিন পার হলে স্যারের কাছে যাবো। একটি কাজ বাকি রয়ে গেছে। বহুদিন আগের মতো স্যার এবং আমি ডাকাতিয়ায় নৌকা নিয়ে ঘুরবো। তারপর কথায় কথায় স্যারকে অনুরোধ জানাবো, তিনি যেন তাঁর লেখা একটি গান গুনগুন করে গেয়ে শোনান। নৌকা চলবে, নদীতে ছড়িয়ে পড়বে অপার মগ্নতা। আমি জলের স্পর্শে স্মৃতিকে সতেজ করবো। হয়তো তখন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এসে মনে ভিড় করবেন। জানাবেন, চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়, বিচ্ছেদ নয়...।
প্রিয় স্যার, আমি আপনাকে বিদায় জানাতে চাই না। আপনার সাথে আমার যোগাযোগ থাকবে আমৃত্যু।
লেখক : কবি ও গল্পকার এবং বার্তা সম্পাদক, চাঁদপুর পোস্ট।