• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

মুজিববর্ষ এবং আমাদের ভাবনা

প্রকাশ:  ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:৫৩
রতন কুমার মজুমদার
প্রিন্ট

‘সে ছিলো দীঘল পুরুষ, হাত বাড়ালেই ধরে ফেলতো
পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল, সাড়ে সাত কোটি হৃদয়’
পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনচরিত নিয়েই ইতিহাস রচিত হয়। কিন্তু সহ¯্র বছরের বাঙালির ইতিহাস রচনার জন্যেই  জন্মেছিলেন বঙ্গবন্ধু মুজিব। যে নেতার জন্ম না হলে বাঙালি তাঁর স্বাধিকার পেতো না, যে নেতার জন্ম না হলে বাঙালি পেতো না বাংলাদেশ নামের ভূখ-, যে নেতার জন্ম না হলে বাঙালির স্বাধীন বাংলাদেশের লালিত স্বপ্ন যুগ যুগ ধরে অপূর্ণই থেকে যেতো। তাই তিনি বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতির জনক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশের স্থপতি।
বাঙালির অবিসংবাদিত এ নেতা বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির ইতিহাসে একজন কিংবদন্তী। ইতিহাসের বিজয়মালা গলায় পরিয়ে বরণ করা হয়েছে এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে, তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু অন্যতম।
‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা’ এ আত্মপরিচয়টুকু যিনি আমাদের দিয়ে গেছেন তিনি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বীজের আত্মবিকাশের জন্যে যেমন কর্ষিত উর্বর ভূমির প্রয়োজন হয়, আর সেই উর্বর ভূমিতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার বীজ বপন করে এনে দিয়েছেন বাঙালির হাজার বছরের কাক্সিক্ষত ফসল ‘স্বাধীনতা’।
মুজিবের রাজনীতি কোনো প্রাসাদ ষড়যন্ত্র হতে সৃষ্টি হয়নি। ক্ষমতার প্রলোভন তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর রাজনীতির পত্তন ঘটেছে শোষিত-বঞ্চিত বাংলার দুঃখী মানুষের পর্ণকুটিরে। জনগণের ইচ্ছা এবং সমর্থন ছিলো মুজিব রাজনীতির মূলমন্ত্র, জনগণকে জাগিয়ে তোলা ছিলো তাঁর মূল উদ্দেশ্য। তাই মুজিব রাজনীতির অপর নাম ‘ভালোবাসা’। নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অমৃতধারায় সঞ্জীবিত এ রাজনীতি। বাংলার মাটি, বাংলার আলো বাতাস, জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের অমৃতরসে পুষ্ট ছিলো তাঁর রাজনীতি। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হৃদয়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা মুজিব নেতৃত্বের অজেয় দুর্গ। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত ছিলো তাঁর জীবন।
বাঙালির মুক্তির জন্যে তিনি সুদীর্ঘ এক যুগ কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। মুজিবের তেজোদ্দীপ্ত মনোভাবের কাছে স্বৈরাচার গোষ্ঠী বারবার প্রতিহত হয়েছে। অবর্ণনীয় নিগ্রহের পরও তিনি বাঙালি জাতিকে আত্মপ্রতিষ্ঠার ব্রত থেকে বিচ্যুত হননি। তাঁর জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হয়েছে নির্জন বন্দীশালায়। নির্যাতন, নিষ্পেষণ যতো বেড়েছে ততোই বলিষ্ঠ হয়েছেন সংগ্রামের মহিমায়। নিজেকে অগ্নিপুরুষ ‘মুজিব’ হিসেবে শাসকদের কাছে প্রমাণ করেছেন। গোটা বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন। মানুষের মুক্তির ইতিহাসে এমন ত্যাগের দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। সমগ্র বিশ্বে আমাদের একটিই পরিচয় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। হিমালয়ের চূড়া থেকে নামিয়ে এনে বঙ্গবন্ধু যেনো বাংলার ইতিহাস রচনা করেছেন। একদিন যাঁর বজ্রকণ্ঠে ফুঁসে উঠেছিলো গোটা দেশের মানুষ, যাঁর তর্জনী হেলনে গর্জে উঠেছিলো আসমুদ্রহিমাচল। তিনি ইতিহাসের মহানায়ক। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে ইতিহাস তিনি সৃষ্টি করে গেছেন তার দৃষ্টান্ত বিরল।
বাঙালি জাতির জীবনে বঙ্গবন্ধু একটি বিপ্লব আর সে বিপ্লবের ফলস্বরূপ আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাঙালির ইতিহাসের কোন্ অধ্যায়ে তিনি নেই? যাঁর আবির্ভাব হয়েছিলো বাঙালির মুক্তির জন্য, তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন একটি ভূখ-, দিয়ে গেছেন স্বাধীনতা।
২০২০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০-২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছেন বঙ্গবন্ধু তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২০ সালে পূর্ণ হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সাল হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এ উপলক্ষেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হবে বলে ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। ইতিমধ্যে ইউনেস্কো যৌথসভায় মুজিববর্ষের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট দেশ ও জাতির জন্যে দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছিলো। এরপর অবৈধ ক্ষমতা দখল। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদে দেশকে নিমজ্জিত করা, উন্নয়ন স্তব্ধ করে দেয়া এ সবকিছু পেছনে ফেলে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি নিয়ে এখন উন্নতির পথে কাজ চলছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। বাংলাদেশের স্যাটেলাইট আজ মহাকাশে।
কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন আমাদের জাতির পিতা। মুজিববর্ষ পালনের প্রাক্কালে এ জাতির উপলব্ধিÑবাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু অভিন্ন। সকল অর্থেই তিনিই বাংলাদেশ। সেটাই আজ মুজিববর্ষে আমাদের ভাবনা। যে নেতা তাঁর জীবনের স্বর্ণ যুগ কাটিয়েছেন বাঙালির জন্যে তাঁর সে আকাক্সক্ষা যদি আমরা পূর্ণ করতে পারি তবেই তাঁর প্রতি আমাদের সম্মান জানানো হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “আমরা আর ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে চলতে চাই না। আমরা সবসময় চেয়েছি কারো কাছে হাত পেতে নয়, নিজেদের সম্পদ ব্যবহার করে দেশকে এগিয়ে নেবো, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো। এ লক্ষ্য নিয়ে আমরা চলেছি। আধুনিক জ্ঞানসস্মত জাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে চাই।”
মুজিববর্ষ পালন করার এ সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনা সরকারের অভিনব দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ। জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী পালনের এ মাহেন্দ্রক্ষণেই তাঁর জীবনী নতুন করে চর্চা করার সময় এসেছে। ইতিহাসের সেই উজ্জ্বল মহিমা থেকে শিক্ষা নেয়ার সময় এসেছে নতুন প্রজন্মের।
দেশের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ হতে চাওয়া যে কোনো মানুষের জন্যে জাতির পিতার আদর্শ ধারণ করা প্রয়োজন। প্রাচীন বাঙালি সভ্যতার আধুনিক স্থপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে হৃদয়ে ধারণ করা প্রতিটি বাঙালির দায়িত্ব। সমাজতন্ত্রের পক্ষ সমর্থনকারী হিসেবে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি একসময় ছয় দফা  প্রস্তাব করেন। তাঁর আদর্শকে ধারণ করে আমরা চাই একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা।
১৯৭৪ সালে সমালোচকদের উদ্দেশ্যে মুজিব তাঁর স্বভাবসুলভভাবে বলেছিলেন, ‘ভুলে যেওনা আমি মাত্র তিনবছর সময় পেয়েছি। এই সময়ের মধ্যে তোমরা কোনো দৈব পরিবর্তন আশা করতে পারো না’। সন্দেহাতীতভাবেই মুজিবের উদ্দেশ্য ছিলো তাঁর দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ঘটানো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুজিব একটা সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন, যে সোনার বাংলার উপমা তিনি পেয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে, ভালোবেসে মুজিব সেই সোনার বাংলার স্বপ্নকে তার দেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচন করেছিলেন। আজ শেখ মুজিবের সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তাঁকে হারাবার পর প্রায় ৪৪ বছর পেরিয়ে গেছে। তবু আজও তিনি তাঁর কন্যাদের এবং আমাদেরকে চেতনার জায়গা থেকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছেন। নিরন্তর সাহস ও অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন আমাদের বিস্ময়কর উন্নয়ন অভিযাত্রায়। সমাজের নিচের দিকের মানুষও এখন খেয়ে-পরে ভালোভাবেই বেঁচে আছেন। দারিদ্র্য বিমোচনে আমাদের অনুসরণীয় সাফল্যের কল্যাণে সারাদেশের মানুষ তিনবেলা পেট ভরে খাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধুর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন দর্শন ও অনুশীলনের কিছু দিক আলোচনার দাবি রাখে। এ আলোচনার মূল মনোযোগের জায়গায় হলো বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় শিল্পায়ন ও শিল্পখাতের টেকসই বিকাশ। ‘সোনার বাংলা’ তাঁর কাছে নিছক রাজনৈতিক কোনো ‘বুলি’ ছিলো না। এ ভূখ-ের অতীত গৌরবের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই এ আকাক্সক্ষা তাঁর মধ্যে তৈরি হয়েছিলো। তিনি জানতেন মাত্র কয়েক শতাব্দী আগেই বাংলা ছিলো সম্পদে ভরপুর সমৃদ্ধ এক ভূখ-। অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ, উর্বর জমি এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য নদ-নদীর কল্যাণে ব্যাপক কৃষি উৎপাদনের কারণে আমাদের এ ভূখ-টি ছিলো বিশ্বখ্যাত।
দারিদ্র্র্য, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্যের অভাব, জনসম্পদের দক্ষতার ঘাটতির মতো কিছু চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও আমরা আশাবাদী যে, একটি গতিশীল ও বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশ হিসেবেই আমরা অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে পারবো। আমাদের সমাজ এবং অর্থনীতিকে আমরা একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পেরেছি। এ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনের যে স্বপ্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেখিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করতে পারবো বলে আশা রাখি। তবে এজন্যে অবশ্যই সামাজিক-রাজনৈতিক এবং আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। এ মহা স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কেবলমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই। বঙ্গবন্ধুকন্যা জাতির জনকের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েই তাঁর ভাবনাগুলো সাজিয়েছেন যা আজ সতের কোটি মানুষের ভাবনা।
স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বাংলাদেশকে যিনি এরই মধ্যে নিয়ে এসেছেন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। ২০২১ সালের মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে বাংলাদেশ পরিণত হবে উন্নত দেশে। সেই পথে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পা রেখেছে উন্নয়নের মহাসড়কে ডিজিটাল দেশের কাতারে। সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধির বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে ডাবল ডিজিট গ্রোথের দিকে। দারিদ্র্য নেমে এসেছে মাত্র ১৮ শতাংশে। মাথাপিছু আয় বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে।
হাত বাড়ালেই যে নেতা ধরে ফেলতেন বাঙালির আশা, বাঙালির ভাষা আর বাঙালির কষ্ট। সারাটা জীবন তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন বাঙালির অহঙ্কার। বাঙালির দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, স্বপ্ন, সাহস নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন। আর তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এক বিরাট স্বপ্ন-কী করে বাঙালির ভাষা ও স্বপ্নকে এক সুতোয় গাঁথা যায়। তিনি বাঙালির অন্তরের গহীনে থাকা দুঃখ, বঞ্চনা, অপমান, স্বপ্ন, সাধ, সংগ্রাম নিমিষেই বুঝে ফেলতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলা এখন আর স্বপ্ন নয়। বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরেই এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। সোনার বাংলা এখন অনেকাংশে দৃশ্যমান বাস্তবতা। তাই মুজিববর্ষের প্রাক্কালে চাঁদপুরে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলার উদ্বোধনী দিনে জাতির জনকের প্রতি বাঙালি জাতির অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
লেখক : অধ্যক্ষ, পুরাণবাজার ডিগ্রি কলেজ, চাঁদপুর।

 

সর্বাধিক পঠিত