টিকে থাকতে কী প্রয়োজন জিদানের?
‘মর্নিং শোজ দা ডে’—বাংলায় বললে, সকাল দেখেই বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে। আবহাওয়ার ক্ষেত্রে অসংখ্যবার এ কথার খেলাপ হলেও আবেদন কমেনি একটুও। তবে খেলাধুলায় কিন্তু শুরু দেখে অনেক কিছুই বোঝা যায়। রিয়াল মাদ্রিদের কথাই ধরুন। তাদের প্রাক মৌসুম ও মৌসুমের প্রথম তিন ম্যাচ দেখে বোঝা যায়, গতবারের তুলনায় এবার খুব একটা উন্নতি হয়নি ‘লস ব্লাঙ্কোস’দের। জিনেদিন জিদানের জন্য এ মৌসুমটা গত মৌসুমের চেয়েও কঠিন হতে চলেছে।
রিয়ালে জিদানের প্রত্যাবর্তন ছিল নায়কোচিত। ঘোর অমানিশা কাটাতে তাঁকে ডাগ-আউটে নিয়ে আসে স্প্যানিশ ক্লাবটি। ঝুলিতে কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা বলতে ছিল রিয়াল ‘কাস্তিয়া’ (বি দল) আর কার্লো আনচেলত্তির অধীনে কাজ করা। খেলোয়াড়ি জীবনে মাঠে সোনা ফলানো অভিজ্ঞতা তো ছিলই। তবে মাঠের অনেক কিংবদন্তিরাও ডাগ আউটে সুবিধা করতে পারেননি। ভয়টা তাই ছিল। অথচ ডাগ-আউটে দাঁড়িয়ে জিদান রেকর্ড ভাঙলেন মুড়ি মুড়কির মতো!
আড়াই বছর, হ্যাঁ মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে টানা তিন চ্যাম্পিয়নস লিগ, লা লিগা, সুপার কাপ জিতেছেন জিদান। এ যেন জুলিয়াস সিজারের ভিনি, ভিডি, ভিসি—এলাম, দেখলাম, জয় করলাম! জিদান এরপর বিদায়ও বললেন। রিয়াল ছাড়লেন হঠাৎ করেই। কিছুদিন পর গেলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোও। রিয়ালও তখন চাঁদের হাট থেকে ভাঙা হাট হওয়ার পথে।
তবে রিয়াল থেকে জিদান বেশি দিন দূরে থাকতে পারেননি। ফিরেছেন আট মাসের মাথায়। কিন্তু এবারের অবস্থা গত মেয়াদের চেয়েও শোচনীয়। যোগ দেওয়ার আগেই সব শিরোপা লড়াই থেকে বাদ। জিদান দল গঠনের জন্য বেশ সময় পেলেও শুধু হতাশাই উপহার দিয়েছেন শিষ্যরা। দলকে তাই এ মৌসুমে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা ছিল তাঁর। তাতেও বিশেষ লাভ হয়নি। তিন ম্যাচে মাত্র এক জয়।
আগেরবার কোচের দায়িত্বে থাকতে জিদানকে ‘ক্রাইসিস পিরিয়ড’ পার করতে হয়নি। কিন্তু এবার তাঁকে সবই পার করতে হবে। একদিকে পারফরম্যান্সের দিক থেকে ক্রমশ ভঙ্গুর দল, বয়সও বাড়ছে খেলোয়াড়দের আর সমর্থকদের প্রত্যাশার চাপ। সব মিলিয়ে জিদানের সামনে অগ্নিপরীক্ষা। কিংবদন্তি পাশ করতে পারবেন তো?
একসময়ের সেরারাই হয়ে উঠছেন বোঝা। ছবি: রয়টার্সবাঘা বাঘা কোচদের ক্যারিয়ারে অগ্নিপরীক্ষা নতুন না। ইয়ুপ হেইঙ্কেস, আরিগো সাচ্চি, লুই ফন গালদের এসব সামলাতে হয়েছে। আফসোসের ব্যাপার, দায়িত্ব ছেড়ে আবার ফেরার পর কারও বিদায়ই সুখকর হয়নি। ফিরে এসে প্রথমবারের মতো সাফল্য পাননি কেউ-ই। কারণটা সম্পূর্ণ মানসিক। কোচের দায়িত্বে আসা মাঠের কিংবদন্তিরা সব সময়ই খেলোয়াড়দের প্রেরণার উৎস। তাঁরা দায়িত্ব নেওয়ার শুরুতে অসাধারণ খেলতে শুরু করে খেলোয়াড়েরা। ধরা দেয় মুঠো মুঠো সাফল্য। এক সময় সব জয় করা হয়ে যায়। কিন্তু তারপর?
আবার নতুন করে জয়ের ধারায় ফিরতে প্রয়োজন হয় নতুন এক স্পৃহার। নতুন এক আগুনের। সে জন্য নতুন করে সাজাতে হয় কাঠ-লাকড়ির। পুরোনো চাল ভাত বাড়লেও বয়সের ভারে খেলাটা কিন্তু দিন দিন কমে, বাড়ে না। রিয়ালের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। (জিদানের অধীনে) টানা তিন মৌসুম প্রায় সর্বজয়ী দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে জয়ের সেই স্পৃহা আর নেই। টানা জিততে জিততে ক্লান্ত শিষ্যদের যেন আর বেশি কিছু চাওয়ারও নেই।
জিদানের বর্তমান শিষ্যদের অবস্থাও অনেকটা এ রকমই। সবার ভেতর থেকে জয়ের নেশাটা হারিয়ে গেছে। হবে না কেন? দলের সব খেলোয়াড়ের ঝুলিতেই কমবেশি সাফল্য আছে। এতে নতুন করে জয়ের নেশা জাগতে সময় লাগে।
কিন্তু জিদানের জন্য জাগানোর সময়টা এখনই। সামলে নিতে হবে পূর্বের সাফল্যে জাবর কাটা খেলোয়াড়দের। দানি কারবাহল, রাফায়েল ভারানে, টনি ক্রুস—এদের দক্ষতার কমতি নেই তবে জেতার আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন আছে। ঘাটতিটুকু খেলা দেখলেই বোঝা যায়। মেরেকেটে ক্রুসকে এখান থেকে সরানো গেলেও বাকি দুজনের ক্ষেত্রে কথাটা নির্জলা সত্য।
পেরেজের ভরসা ধরে রাখতে পারবেন তো জিদান? ছবি: রিয়াল মাদ্রিদ ওয়েবসাইটএরপর আছে বয়স। রিয়াল মাদ্রিদের তিন বছরের অসাধারণ সাফল্যের মূল তিন কারিগরের একজন এখন জুভেন্টাসে—রোনালদো। কিন্তু মার্সেলো আর লুকা মদরিচ নিজেদের সেরাটা দিতে চাইলেও বয়স তাতে বড় বাধা। আর যাই হোক বয়সকে তো আটকে রাখা যায় না। মার্সেলোকে আগের মতো ওভারল্যাপ করে ওপরে উঠে দ্রুত রক্ষণে ফিরতে পারেন না, আর ডিফেন্সচেরা পাসে কালেভদ্রে দেখা মেলে মদরিচের। জিদানের রিয়ালের সাফল্যের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভূমিকা রাখা দু-তিনজন অবশ্য এখনো নিজের সেরাটা দিয়ে যাচ্ছেন। অধিনায়ক সার্জিও রামোস এ কাসেমিরো। মাঝ মধ্যে করিম বেনজেমাকেও জ্বলে উঠতে দেখা যায়।
জিদান কিন্তু এসব জানেন। আর জেনেবুঝেই দল গড়তে ৩০০ মিলিয়ন ইউরো জায়গামতোই খরচ করেছেন জিদান। আগামী ২২ দিনের মধ্যে রিয়ালকে মুখোমুখি হতে হবে সাত ম্যাচে। এর মধ্যে সেভিয়া, পিএসজির মতো প্রতিপক্ষ এমনকি ‘মাদ্রিদ ডার্বি’ও আছে। জিদানকে তাই এখন নিতে হবে কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত। জয়ের খিদে নেই এমন খেলোয়াড়দের রাখতে হবে দলের বাইরে। টিকে থাকতে এমন কিছু সিদ্ধান্তই নিতে হবে ফরাসি কিংবদন্তিকে।
আর তার কারণ হলো জিদান ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের সোনার ডিম পাড়া হাঁস। প্রয়োজনের যে সোনায় মুড়িয়ে দিয়েছে রিয়ালকে। পেরেজ তাই নিশ্চিতভাবেই অপেক্ষা করবেন। হাঁসের পেট থেকে আবারও সোনার ডিম পেতে এই পেরেজ অপেক্ষা করতে জানেন। ওদিকে জিদানও নিশ্চয়ই প্রস্তুত? আবারও সোনার ডিম না পূর্বসূরিদের ভাগ্য বরণ—তা সময়ই বলে দেবে। তবে জিদানকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বুঝে শুনে। কারণ তাঁর এখনকার সিদ্ধান্তের কালিতেই হবে আগামীর ভাগ্য লিখন।