দৃপ্তকণ্ঠে বলিষ্ঠ চিত্তে কবি শুনিয়েছিলেন ৭ মার্চের ভাষণ
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
ইউসুফ পাটোয়ারী লিংকন
৭ মার্চ ভাষা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, ছয়দফার উপস্থাপক, গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক, শৃঙ্খলিত জাতির মুক্তিদূত, জনগণমননন্দিত রাজনীতিবিদ, বঞ্চিত বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্দু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধ
আমরা যদি বিস্তারিতভাবে বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ একটু বিশ্লেষণ করি, তবে দেখব, স্বাধীনতার ঘোষণা কত দৃপ্তকণ্ঠে বলিষ্ঠ চিত্তে শুনিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে বললেন, আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। এমনটি করে হৃদয় দিয়ে, খুব কাছে থেকে বাংলার মানুষকে আর কেউ কোনোদিন চিনতে পেরেছিলেন কিনা আমাদের জানা নেই। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতির আকাক্সক্ষাকে আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করে একটি অভীষ্ট লক্ষ্যে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বললেন, বাংলার মানুষ ‘মুক্তি চায়’ ‘বাঁচতে চায়’ ‘অধিকার চায়’। ‘মুক্তি-বাচা-অধিকার’ এ তিনটি শব্দের ভেতরে পরোক্ষভাবে লুকিয়ে আছে স্বাধীনতার অতৃপ্ত আকাক্সক্ষা। বস্তুত তিনি আমাদের অতৃপ্ত আকাক্সক্ষাকে বজ্রকন্ঠে শাসকের রাজ্যে নির্ভয়ে সেদিন লক্ষ লক্ষ বাঙালির সামনে ঘোষণা করেন।
আরো বললেন, “আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে”। এখানে ‘আমার’ শব্দটির ব্যবহার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ‘আমাদের’ শব্দটিও ব্যবহার করেন নাই। ‘আমাদের’ শব্দটি ব্যবহার করলে হয়ত বুঝা যেত তিনি প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু না, সন্তানতুল্য মনে করে ভাবলে, বুঝলে এবং ভালবাসলেই কেবল ‘আমার’ শব্দটি দিয়ে সম্বোধন করা সম্ভব হয়। ‘একনেতা একদেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ এই শ্লোগানটি যথার্থ ছিল বলে এমন সম্বোধন হতে পারে।
“আমি বললাম, অ্যাসেম্বলীর মধ্যে আলোচনা করবো, এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি হয় তাঁর ন্যায্য কথা আমরা মেন নেব”। অনংড়ষঁঃব সধলড়ৎরঃু-এর গর্বে তিনি মোটেও গর্বিত ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু বিরোধী দলের একজনের ন্যায্য কথাও মেনে নেয়ার অঙ্গীকার করছিলেন।
“আমি বললাম শান্তিপূর্ণ ভাবে হরতাল পালন করুন” এ বক্তব্যের পর হরতাল যদি সেদিন শান্তিপূর্ণভাবে না করতে পারতেন, তবে সামরিক সরকার ঘটনাকে অন্যখাতে ঠেলে দিতেন। আন্দোলন শান্তিপূর্র্ণ হলেই কেবল অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে, এ দীক্ষা তিনি সেদিন জাতিকে শুনিয়েছিলেন।
“আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমি এ দেশের মানুষের অধিকার চাই” বক্তব্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী বলে সম্বোধন করার পরেও, পুলকিত হয়ে বাংলার জনগণের অধিকারকে উপেক্ষা করতে পারেননি। পারেননি আপসের চিন্তা করতে। পরবর্তীকালে ২৫ মার্চের পর বেতার ভাষণে জেনারেল ইয়হিয়া খান তাঁকে জেলে ঢুকিয়ে বললেন, “আমি তাঁকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী বলে সম্বোধন করার পরেও তাঁর মাঝে কোনো উৎসাহ দেখিনি, তিনি বাঙালিদের নেতা হতেই বেশি পছন্দ করতেন”। এমন লোভ-প্রলোভন বহুবার বঙ্গবন্ধুর জীবনে এসেছিল। তিনি আপস করেননি। আগরতলা মামলায় যখন তাঁকে প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব আসে তিনি সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এদেশের মানুষের অধিকারের চেয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব তাঁর কাছে কোনো সময়ই বড় ছিল না।
“আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল” এমন বক্তব্যে অনুমিত হয়, বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত ভাবে জানতেন খুব শীঘ্রই ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করা হতে পারে। তাই তিনি ‘রইল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ তিনি যে আর আমদের মাঝে থাকতে পারবেন না কিংবা শত্রুরা তাঁকে থাকতে দিবে না তা’ তিনি নিশ্চিতভাবে অনুমান করেছিলেন। তাই অনুরোধটি ‘রেখে’ যেতে চাইলেন। তাঁর এ অনুমান পরবর্তীতে অক্ষরে অক্ষরে যে সত্য হয়েছিল তা আমরা সকলেই জানি।
“তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে”। এই বক্তব্যে তাঁর নিরস্ত্র মানুষগুলি আক্রান্ত হলে, ওরা কী ভাবে শত্রুকে মোকাবেলা করবে তাঁর সুস্পষ্ট নির্দেশ এখানে আছে। বঙ্গবন্ধু যদি নাও থাকেন, তাহলে বাংলার মানুষ কী করবে তাঁর সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা এখানে রয়েছে। আজ তথাকথিত অনেক ভুঁইফোঁড় বুদ্ধিজীবী বলে থাকেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের কোনো দিক নির্দেশনা না দিয়েই তিনি পাকিস্তানীদের হাতে আত্মসমর্পণ করেন। তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই তারা কত নির্বোধ এবং অজ্ঞ। ইচ্ছে করেই সত্যকে লুকিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকেন।
“সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না”। এখানে তিনি শত্রু পক্ষকে উদ্দেশ্য করে জাতিকে আত্মপ্রত্যয়ে আরো বলীয়ান করার মানসে এমনটি বলেছিলেন। যে জাতি চিরকাল গোলামীর শৃঙ্খলে বন্দী ছিল, সেই ভীতু জাতিকে তিনি তিলে তিলে জাগিয়ে তোলেন। আন্দোলন শেখান, সংগ্রাম শেখান, ত্যাগ শেখান, তারপর শেখান আত্মত্যাগ। শেখান কী করে বুকের রক্ত ঢেলে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। যখন দেখলেন তাঁর সন্তানেরা আত্মপ্রত্যয়ে জীবন দেয়ার জন্য প্রস্তুত, তখনই লক্ষ জনতার সামনে ঘোষণা করলেন ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না’। তিনি নিশ্চিত ছিলেন তিনি জয়ী হবেন।
“মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-ননবাঙালি যারা আছেন তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়”। তাঁর এমন অসাম্প্রদায়িক আদর্শ আজ আওয়ামীলীগ লালন করে চলছে। পাক জান্তারা জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে আমাদেরকে যেন লক্ষ্য অর্জনে বিচ্যুত করতে না পারে তাতেই ছিল তাঁর সতর্ক আহ্বান। সংগ্রামের পথে বাধা হতে পারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, তাই এ দুর্বলদিকটি তিনি তুলে ধরে আমাদেরকে হুঁশিয়ার করে দেন। আর এটাই হলো যোগ্য নেতার সঠিক নির্দেশ।
“কিন্তু যদি এদেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন”। এখানে আবারো জাতিকে তিনি নির্দেশ দিলেন কী করে তাদের উপযুক্ত সময়ে সঠিক পন্থা বেছে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী প্রমাণ করে আজীবন অন্তরালে পুরে রাখার অনেক কৌশল তৎকালীন সামরিক জান্তারা করেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে বিদ্রোহের ডাক দিলে তাঁকে দেশদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করা হতে পারে। তাই অত্যন্ত কৌশলে বাঙালিকে বিদ্রোহের সময়টুকু পর্যন্ত বলে দেলেন। যদি কেউ হত্যাযজ্ঞ চালায়, তবে যেন বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করে, অর্থাৎ অস্ত্র হাতে তুলে নেয়।
“প্রত্যেক গ্রামে প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল”। আন্দোলন- সংগ্রামের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে, তার সুস্পষ্ট নির্দেশ তিনি তার এ ভাষণে দিয়ে রেখেছেন। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজনীতা স্বীকার করে নিয়ে নেতৃত্ব আওয়ামীলীগের হাতে রেখে সংগ্রাম পরিচালনা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাতে নেতৃত্ব সঠিক স্থানে থাকবে, আন্দোলন সঠিক পথে থাকবে। কেউ ভুল পথে ঠেলে দিতে পারবে না।
“এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক”। মুক্তিযুদ্ধের জন্য জাতি (সাধারণ জনতা) কিভাবে প্রস্তুত থাকবে তার নির্দেশ তিনি এখানে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন তার বাঙালি জাতির কী আছে আর কখন কী পাইতে পারে। তিনি জানতেন বাঙালির যা আছে তাই নিয়ে যখন ঝাঁপিয়ে পড়বে, তখন তার পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিশ্রুত বন্ধুরা এগিয়ে আসবে। এমনটিই ছিল বোঝাপড়া। তাই বন্দী হবার আগেই তিনি তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ৩২ নম্বর থেকে পাঠিয়ে দেন। আর তিনি সাধারণ মানুষকে ‘যা কিছু আছে’ তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বললেন, আর বললেন ‘বাঙালিরা যেন বুঝেসুঝে কাজ করে’। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত তীক্ষè বুদ্ধি দিয়ে জাতিকে সকল নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন।
“রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দিবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্”। এখানে তিনি জাতিকে আশ^স্ত করেছেন, ভরসা দিয়েছেন। সামনে একটি যুদ্ধ, হয়ত আরো ত্যাগের প্রয়োজন হবে, আরো অনেককে শহীদ হতে হবে। জাতিকে সে ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে বল্লেন। এখানে নেতাজী সুভাস চন্দ্রের একটি কথা না বললেই নয়, নেতাজী বলেছিলেন “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদেরকে স্বাধীনতা দেব”। শহীদের রক্ত যে বৃথা যাবে না তা তিনি জাতিকে আবারো স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা”। তার এই ঐতিহাসিক ভাষণের এটাই মূল কথা। ৭ মার্চে তিনি লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
সংক্ষিপ্তভাবে এ ভাষণের সকল দিক তুলে ধরা সম্ভব নয়। তার এক একটি কথা মুক্তিযুদ্ধের এক একটি প্রেক্ষাপট, এক একটি অধ্যায়। এমন কোনো নির্দেশনা বাকি ছিল না, যা তিনি তার এ ভাষণে দিয়ে যান নি। তাই যারা আজ নানা স্থানে বলে বেড়ায়, ‘বঙ্গবন্ধু কোন নির্দেশনা না দিয়েই কারাবরণ করলেন’ তারা মূর্খ। তাদের বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তারা বুঝতে পারে না। অথচ একটি সংগ্রামের এমন কোনো দিক নেই, যা তিনি তার এই ভাষণে সরাসরি কিংবা আকার ইঙ্গিতে চবৎসরংংরনষব ধিু-তে উল্লেখ না করেছেন। তার এ ভাষণ স্বাধীনতা যুদ্ধকে তার নেতৃত্বে চালিয়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল, আর ছিল প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অনুপ্রেরণা ও দিকনিদর্শন। জাতির ইতিহাসের এ এক অবিস্মরণীয় দলিল।
আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গের ভাষণ, মার্টিন লুথার কিংয়ের (জুনিয়র) ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ শীর্ষক ঐতিহাসিক ভাষণের চেয়ে ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব বেশি বলে আখ্যা দিয়েছে ইউনেস্কো। মার্টিন লুথার কিংয়ের সেদিনকার কণ্ঠের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নেলসন ম্যান্ডেলার ভাষণ এবং তাঁর জীবনের সঙ্গেও শেখ মুজিবের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়া ম্যালকম এঙ, মহাত্মাগান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চে গুয়েভারা, কর্নেল নাসের এসব মানব দরদী ও জাতীয়তাবাদী নেতার বিভিন্ন পর্যায়ে প্রদত্ত বিভিন্ন ভাষণের সাথে ৭ মার্চের ভাষণের সামঞ্জস্য রয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁদেরই মতো বিশ্ব পর্যায়ের নেতা।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ দিবাগত রাতে ভারতীয় ১০১ বাহিনীর অধিনায়ক মেজর জেনারেল নাগরা ও কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান আবদুল কাদের সিদ্দিকী মীরপুরের আমিন বাজারের ব্রিজের ওধারে অবস্থান গ্রহণ করেন। আর পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর প্রধান আমির আবদুল্লাহ নিয়াজীর উপর মানসিক চাপ সৃষ্টির জন্য ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ’র পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানান। আকাশ বাণী বেতার কেন্দ্র থেকে জেনারেল মানেকশ’র আহ্বান বার বার প্রচারিত হয়।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ অবশেষে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণে রাজি হলেন। পাকিস্তান ৩৬ ইনফ্যাট্রি ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মহাম্মদ জামসে তাদের ঢাকা নগরীতে অভ্যর্থনা জানিয়ে জীপে চড়ে চললেন পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারের দিকে। অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে নিয়াজির পক্ষ থেকে পাকিস্তান ইস্টার্ন আর্মির চীফ স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকের সবাইকে অভ্যর্থনা জানিয়ে একটা সাজানো কক্ষে বসতে অনুরোধ করলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে লেঃ জেনারেল নিয়াজী ‘আন্ডার গ্রাউন্ড’ টেকনিক্যাল হেড কোয়ার্টার থেকে নিজস্ব অফিসে হাজির হলেন। মেজর জেনারেল নাগরা, আবদুল কাদের সিদ্দিকীকে সাথে করে নিয়ে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জামসেদ ও লেঃ জেনারেল নিয়াজীর ঘরে প্রবেশ করনে। জেনারেল নিয়াজী মেজর জেনারেল নাগরার সাথে করমর্দন করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। নাগরার কাঁধে মুখ রেখে নিয়াজী একেবারে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললেন, “পি-ির হেড কোয়ার্টারের বেজন্মারা আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী”। নিয়াজীর কান্না থামিয়ে একটু ঠা-া হতেই মেজর জেনারেল নাগরা তাঁর সহকর্মীদের সাথে একে একে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে মেজর জেনারেল নাগরা বললেন, “ইনিই এখন মুক্তিবাহিনীর একমাত্র প্রতিনিধি। ইনিই তোমার পরম বন্ধু সেই বিখ্যাত কাদের সিদ্দিকী”।
কাদের সিদ্দিকীর নাম শুনে লেঃ জেনারেল নিয়াজী চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় বার সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানালেন এবং করমর্দন করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। সবাইকে হতবাক করে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা তাঁর হাত সরিয়ে নিয়ে ইংরেজিতে বললেন, “যার হাত নারী ও শিশু হত্যা করেছে, আমাদের মা বোনের ইজ্জত লুটেছে, তার হাতের সাথে করমর্দন করতে পারলাম না বলে আমি দুঃখিত। আমি আল্লাহর কাছে জবাবদিহিকারী হতে চাই না”। কিন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিচক্ষণ জেনারেল নাগরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কাদের সিদ্দিকীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আপনি কী করছেন? হাত মিলান। আপনার সামনে পরাজিত সেনাপতি। পরাজিতের সাথে হাত না মেলানো বীরত্বের অবমাননা”। জেনারেল নাগরার কথা অনুসারে আবদুল কাদের সিদ্দিকী করমর্দন করলেন। লেঃ জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর সাথে প্রয়োজনীয় আলাপ আলোচনার পর স্থির হলো : রেসকোর্স ময়দান (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) বিকেল চারটায় মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেঃ জেনারেল জগৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ মুজিব নগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিমান বাহিনীর প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকারকে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে পাঠান।
মাত্র ৯ মাস ৯ দিন আগে যেই রেসকোর্স ময়দানে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাঙালি জাতির নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”। ১৬ ডিসেম্বর ঠিক সেই বিশাল ময়দানে প্রায় দশ লক্ষ জনতা আর শতাধিক দেশী বিদেশী সাংবাদিক পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর সৈন্যদের বাঙালি জাতির সামনে মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণ করার অনুষ্ঠান নিজের চোখে দেখলেন।
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বংলার স্বাধীনতার যে সূর্য অস্ত গিয়েছিলো, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সেই লাল সূর্য আবার স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশে উদিত হলো। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিশে^র মানচিত্রে স্থান লাভ করলো একটা দেশ যার নাম বাংলাদেশ।
বিশ্লেষক ও লেখক পরিচিতি : ইউসুফ পাটোয়ারী লিঙ্কন, প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক