সাদাকালো অতীত
জেলা শহরের দুরন্ত ছেলে আবুল লেইছ শ্যামল অনেকটা খেয়ালের বশে ক্যামেরা হাতে নিয়েছিলেন। কিশোর শ্যামল সাদাকালোর জীবনে রঙের স্বপ্নও দেখেননি সেদিন। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বের প্রাক যৌবনের কৌতূহল থেকেই ক্যামেরা হাতে ছুটে চলা। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেখেন ছবি ওঠানো ছাড়া জীবনে আর কিছুই করেননি। সিলেটের সুরমাপারে শুরু করা জীবন এসে ঠেকেছে আমেরিকার সেইন্ট ক্লেয়ার লেকের পাড়ে। মিশিগানের হ্যামট্রামিক নগরে বসে ছবির কারিগর আবুল লেইছ শ্যামল গর্বভরে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান। মুক্তিযুদ্ধে অবরুদ্ধ স্বদেশের ছবি ধারণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা ভাসানী, ওয়ালী খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, আলী আজগর খানসহ অনেক ঐতিহাসিক নেতার জনসভায় ছবি উঠিয়েছেন। কাজের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি কোথাও পাননি, তবে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন।
অভিবাসনের চক্রে সিলেটের আবুল লেইছ শ্যামল এখন আমেরিকা প্রবাসী। থাকেন ছেলের সঙ্গে মিশিগানের হ্যামট্রামিকে। সিলেটের লন্ডন ফটো স্টুডিওর শ্যামল বলে এক ডাকে ছিল যাঁর পরিচিতি, তিনি আজ স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান। নিজের বয়স ৬৫ হয়েছে জানালেও স্মৃতি তাঁকে প্রতারণা করে। দিন, তারিখ সবকিছু আর মনে করতে পারেন না। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সঙ্গে কথা বলার সময় জানালেন, শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না আজকাল।
১৯৬২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেই খেয়ালের বশে ফটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন শ্যামল। তখন সিলেটের বিখ্যাত লন্ডন ফটো স্টুডিও ছিল জিন্দাবাজার এলাকায়। যাতায়াত শুরু করেন। লন্ডন যাত্রীদের পাসপোর্টের জন্য ছবি তুলতে শুরু করেন। স্মরণ করলেন, তখন সিলেটের নামকরা বর্মণ ফটো স্টুডিও, পিরামিড ফটো স্টুডিওতে ছিল নিয়মিত যাতায়াত। ১৯৬৪ সালে লন্ডন ফটো স্টুডিওতে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজে যোগ দিলেন। স্মৃতি হাতড়ে বলতে থাকেন, ব্রিটেন প্রবাসী ব্যারিস্টার নুরুল ইসলামের চাচা আলাউদ্দিন সাহেবের মালিকানাধীন ছিল লন্ডন ফটো স্টুডিও। পাকিস্তান আমলেই লন্ডন ফটো স্টুডিও সুরমা মার্কেটে স্থানান্তর হয়। ১৯৬৭ সালে ব্যবস্থাপক হিসেবে স্থায়ী নিয়োগ পান শ্যামল।
সিলেট নগরীর প্রবেশপথে কিন ব্রিজ দিয়ে নামলেই মোড়ে লন্ডন ফটো স্টুডিও। সোনালি ফ্রেমের কালো চশমা পরে বসে থাকতেন সুদর্শন আবুল লেইছ শ্যামল। কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে মোটরসাইকেলে শহরময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, জনসভার মঞ্চে পুরোনো দিনের সব ক্যামেরা নিয়ে ফটো তুলছেন—এমন দিনের কথা স্মরণ করে গর্বের নিশ্বাস ছাড়েন শ্যামল।
মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ঘটনা দেখেছেন মাঠে থেকে। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে জুতা ছুড়ে মারার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন কাছে থেকে। তাঁর এখনো মনে আছে, যেসব ছাত্রনেতা সেদিন কিন ব্রিজ থেকে জুতা ছোড়ার নেতৃত্ব দিয়েছেন। অনেকেই আজ বেঁচে নেই। শ্যামল জানালেন, এখনো চোখে ভাসছে রামু দিঘিরপাড়ের বারী মিয়ার ছেলে হুমায়ুন ছিলেন জুতা ছোড়ার দলে। দেশে তখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছে। শ্যামল ঘুরছেন নেতাদের পেছনে পেছনে। অন্যান্য নামের সঙ্গে ছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী, রূপবান সিরাজ খ্যাত সিরাজ উদ্দিন আহমদ।
উত্তাল সেই সব দিনের গল্প করতে গিয়ে জানালেন ছবি ওঠাতে গিয়ে ন্যাপ সভাপতি ওয়ালী খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, আসগর খান, মাওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল বক, আতাউর রহমানসহ অনেকের সংস্পর্শে আসার গল্প। সিলেটের বর্তমান কোর্ট মসজিদ প্রাঙ্গণে ফাতেমা জিন্নাহর সভায় তরুণ শ্যামল উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় হয়। সিলেটজুড়ে সেদিন লাঠিমিছিল হয়েছিল। মানুষ গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে লাঠি হাতে এসে মিছিলে যোগ দিচ্ছে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের গগনবিদারী গণচিৎকার। আবুল লেইছ শ্যামল ঐতিহাসিক সেই লাঠিমিছিলের একজন ছিলেন। ছবি উঠিয়েছেন মিছিলের।
একাত্তর সালের ২৫ মার্চের কালো রাত পোহালেই ২৬ মার্চ জিন্দাবাজার চৌরাস্তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গাড়ি দেখেছেন শ্যামল। ক্যামেরা হাতে নয়, জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে দৌড়াচ্ছেন। জল্লারপাড়ে দুটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেও ছবি ওঠাতে পারেননি। জিন্দাবাজারের বর্তমান সোনালী ব্যাংকের ভেতরে ৫-৬ জন প্রহরীর মৃতদেহ এবং বারান্দা পর্যন্ত রক্তের ফোয়ারা দেখেছেন।
১৯৭১ সালের মার্চে হাসপাতালের ভেতরে হত্যাযজ্ঞের পরদিন তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ তোলা হয়। জল্লারপাড় থেকে আম্বরখানায় সাইকেলে যাওয়ার সময় দেখলেন, মহিলা কলেজের সামনে মেশিনগান নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী বসা। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দরজা তখনো খোলা। ভেতরে ডা. শামছুদ্দিন, ডা. লালাসহ আরও কয়েকজনের মৃতদেহ নিজে দেখেছেন। বারান্দায় কাক ও কুকুরের ঘোরাফেরার দৃশ্য, আজও এ দৃশ্য তাঁকে তাড়া করে। ক্যামেরাম্যান শ্যামল অস্ফুটে উচ্চারণ করেন, ‘আমাদের দেশটা অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া!’
নয় মাসের অবরুদ্ধ সিলেটে ছিলেন আবুল লেইছ শ্যামল। সার্কিট হাউসে তাঁর ডাক পড়ত ক্যামেরা নিয়ে যাওয়ার জন্য। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের হুকুমে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হতো সার্কিট হাউসে। সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর আজমল আলী, নাজমুল হেসেন তারা মিয়া, ফুকড়া মজিদের দৌরাত্ম্য দেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর কুশপুত্তলিকা দাহ করেছিল দালাল চক্র। বুকে জ্বালা নিয়ে ছবি ওঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন শ্যামল। সেই ছবি তখন দৈনিক পূর্বদেশ-এ ছাপা হয়েছিল। সিলেটে রাজাকারদের হাতি মিছিল, স্বাধীনতার পর রাজাকারদের কান কাটার দৃশ্যের ছবি উঠিয়েছিলেন শ্যামল।
মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম সিলেট সফর, মাজার জিয়ারতের ছবি খুব কাছে থেকে উঠিয়েছেন শ্যামল। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে ভালো মেজাজের হাস্যোজ্জ্বল ছবিটি তাঁর তোলা বলে দাবি করলেন অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে। ঠিক ফটোসাংবাদিকতা করা হয়নি শ্যামলের। তবে সম্পাদক, সাংবাদিক আমীনুর রশীদ চৌধুরী, ডা. দেলোয়ার হোসেন, মাহবুবুর রহমান, নুরুল ইসলাম, তবারক হোসেনের নাম নিলেন। জানালেন, সাংবাদিকেরা তখন তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত ফটো সংগ্রহ করতেন।
ফটো ওঠানো, ক্যামেরা—সবকিছুতে কতটা বদল হয়েছে, তা নিয়ে বিকারহীন আবুল লেইছ শ্যামল। জানালেন, লেখাপড়া করেছেন। তখনকার সময়ে বাণিজ্যে স্নাতক করে ভালো সব চাকরির সুযোগ ছিল। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পর অন্য কোনো পেশায় জড়িয়ে পড়ার চিন্তাও করেননি। ভালোবাসার অনেক সাদাকালো নেগেটিভ এখনো আগলে রেখেছেন, নিয়ে এসেছেন দূরের দেশ আমেরিকায়। জানতে চাইলেন, এগুলো থেকে ছবি প্রিন্ট করা যায় কেমনে? করা গেলে অনেক ইতিহাসের অনেক স্থিরচিত্র পাওয়া যাবে—স্বগোক্তি করলেন আবুল লেইছ শ্যামল।
সূত্র: প্রথম আলো