• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন মেডিকেল গ্রেডে, ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা

প্রকাশ:  ১১ জুন ২০২০, ১১:১৩
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

দুই মাস আগেও ১২ হাজার টাকায় ১৪০০ লিটারের একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার মিটারসহ পাওয়া যেত। কিন্তু চট্টগ্রামে এখন সেসব সিলিন্ডার ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকায়ও মিলছে না। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, অসহায় ক্রেতাদের উচ্চমূল্যে কেনা এসব সিলিন্ডারে বেশির ভাগই ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেন, যা ক্রসফিলিংয়ের মাধ্যমে রি-ফুয়েল করা হচ্ছে।

গত দুদিন নগরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানের পর আজ বুধবার (১০ জুন) বাংলাদেশের বৃহৎ অক্সিজেন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘লিন্ডে বাংলাদেশ’ এর কারখানায় অনুসন্ধান চালায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। তবে সেখানে যে তথ্য মিলেছে, তা যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতোই।

 

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আজ বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চট্টগ্রামের সাগরিকায় লিন্ডে বাংলাদেশের প্রধান অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রয় ও বিতরণকেন্দ্র পরিদর্শন করি। সেখান থেকে জানা যায়, ১.৪ কিউবিক লিটার মেডিকেল গ্রেড অক্সিজেন সিলিন্ডারের (৯৯.৯% ঘনত্বের) রিফিলিং মূল্য মাত্র ১২২ টাকা। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লা এবং সদরঘাট এলাকায় বিভিন্ন পাইকারি দোকানিরা রিফিলিংয়ের ক্ষেত্রে দাম রাখছেন ১০০০ টাকা বা তারও বেশি।

লিন্ডে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের বরাতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল জানান, চট্টগ্রামে গত দুইদিন জেলা প্রশাসন চট্টগ্রামের পক্ষ থেকে যেসব প্রতিষ্ঠানকে মাত্রাতিরিক্ত দামে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি এবং রিফিলিংয়ের জন্য জরিমানা করা হয়েছে তারা লিন্ডে বাংলাদেশের কোনো বৈধ প্রতিনিধি নয়।

চট্টগ্রামে এমন অসাধু প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- হাসান ট্রেডার্স, ব্রাদার্স প্রকৌশলী ওয়ার্কস, বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ ও জিলানী অক্সিজেন লিমিটেড।

অক্সিজেন কালোবাজারির নেতৃত্বে বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে মেডিকেল গ্রেড (৯৯.৯%) পিওরিটির অক্সিজেন প্রস্তুত করে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র তিনটি। সেগুলো হলো- চট্টগ্রামের সাগরিকায় সরকারি-বেসরকারি যৌথ মালিকানার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশ, কালুরঘাট এলাকার এস্পেকট্রাম অক্সিজেন লিমিটেড ও নারায়ণগঞ্জের ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড।

এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটর নেই। তারা হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন প্লান্ট প্রস্তুত করে দেয়। পরবর্তীতে সে প্লান্টে অক্সিজেন গ্যাস সাপ্লাই করে। এছাড়া হাসপাতালের ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের ভিত্তিতে ব্যক্তিপর্যায়ে বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে রোগীদের জন্য ১.৪ কিউবিক লিটার (১৪০০ লিটার অক্সিজেন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন) সিলিন্ডার বিক্রয় করে। যেগুলো যথাযথভাবে পরীক্ষাকৃত এবং নির্দিষ্ট মেয়াদে ব্যবহারযোগ্য সিলিন্ডার।

কিন্তু অসাধু বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ লিন্ডে বাংলাদেশসহ বাকি দুই প্রতিষ্ঠানের নকল প্যাডে লিন্ডে বাংলাদেশের নাম লিখে খুচরা বাজারে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি ও বিতরণ করছে। গতকাল এভাবে লাইসেন্সবিহীন এবং মাত্রাতিরিক্ত দামে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রির দায়ে বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজকে চার লাখ টাকা জরিমানা করেন ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক।

জানা গেছে, একসময় লিন্ডে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ কাজ করত। তবে ২০১৬ সালে লিন্ডে বাংলাদেশ যেসব হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার সাপ্লাই করে সেসব প্রতিষ্ঠান ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেন গ্যাস সিলিন্ডার রিফিলিং এবং সিলিন্ডার সরবরাহের সময় টেম্পারিং করায় বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন বিক্রি হচ্ছে মেডিকেল গ্রেডে!

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামে বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেন প্রস্তুত করে। সেগুলো হলো- সীমা এন্টারপ্রাইজ, এয়ার গ্যাস, মদিনা এন্টারপ্রাইজ, গোল্ডেন অক্সিজেন ইন্ডাস্ট্রিজ, জিডি সুবেদার ইন্ডাস্ট্রিজ।

কিন্তু সম্প্রতি মেডিকেল গ্রেডের অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা বেশি থাকায় বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে অক্সিজেন নিয়ে ক্রসফিলিং ও টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে মেডিকেল গ্রেডের সিলিন্ডারে অক্সিজেন ভরে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করছে।

এ বিষয়টির ওপর নজর রাখছেন জেলা প্রশাসনের এমন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীর কোনো কাজে তো আসবেই না, বরং ক্রসফিলিং বা টেম্পারিং করা এসব সিলিন্ডার বাসায় মজুত করলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে।

লিন্ডে বাংলাদেশের বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের পর্যাপ্ত মেডিকেল গ্রেড অক্সিজেন রয়েছে। অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা বেশি থাকায় জরুরি ভিত্তিতে লিন্ডে বাংলাদেশ মেডিকেল গ্রেডের অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রস্তুত করছে। আগামী ২০ জুন থেকে মেডিকেল গ্রেডের সরবরাহ আরও বাড়বে। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রায় চার হাজারের মতো মেডিকেল গ্রেড সিলিন্ডার সাপ্লাই চেইনে যুক্ত হবে।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের বাইরে মেডিকেল গ্রেড অক্সিজেন যথাযথভাবে প্রস্তুত করে সরবরাহ হচ্ছে কিনা সেটি জেলা প্রশাসন চট্টগ্রামের পক্ষ থেকে সরেজমিনে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে খতিয়ে দেখা হবে।

উল্লেখ্য, করোনা চিকিৎসায় অক্সিজেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য এ সময় অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। আর এ সুযোগে দামও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকটে পড়েছেন সবাই, প্রায় পাঁচগুণ দাম বেড়ে মাঝারি মানের একটি অক্সিজেনের সিলিন্ডার ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম বিক্রি হচ্ছে ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। অথচ তিন মাস আগেও অক্সিজেন সিলিন্ডারের এই সেট পাওয়া যেত পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকায়। আর এ সময় সুযোগ নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

সাধারণ রোগীর শরীরে অক্সিজেনের উপস্থিতি ৯০ শতাংশের নিচে নামতে শুরু করলেই অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে। পালস অক্সিমিটার নামে একটি সহজ ডিভাইসের মাধ্যমে অক্সিজেনের শতকরা উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া যায়। অক্সিজেন যদি ৮০ শতাংশ বা এর আশপাশে থাকে তখন বাসায় রেখে অক্সিজেন দিয়েও সংকট মোকাবিলা করা হয়। আর এর চেয়েও কমে গেলে তখন হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজন হবে।

একদিকে যাদের প্রয়োজন তারা অক্সিজেন পাচ্ছে না। অন্যদিকে অনেকেই সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় অক্সিজেন কিনে মজুত করছেন। এতে হাসপাতালগুলো পড়ছে অক্সিজেন সংকটে। এ অবস্থায় অপ্রয়োজনে অক্সিজেন মজুত না করার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।

মঙ্গলবার (৯ জুন) দুপুরে করোনাভাইরাস বিষয়ক নিয়মিত হেলথ বুলেটিনে তিনি বলেন, ‘করোনা চিকিৎসায় অক্সিজেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে, অনেকেই বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে মজুত করছেন করোনা চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য। যা ঠিক নয়। কারণ অক্সিজেন থেরাপি একটি কারিগরি বিষয়। দক্ষ চিকিৎসক ব্যতীত অন্য কেউ অক্সিজেন রোগীকে প্রয়োগ করলে তা রোগীর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।’

সর্বাধিক পঠিত