বিশ্বজিৎ হত্যার ৭ বছর আজ: দণ্ডিতরা সবাই প্রকাশ্যে , কিন্তু কাউকেই খুঁজে পায় না পুলিশ!
সময়ের কণ্ঠস্বর ডেস্ক- আলোচিত পুরান ঢাকার দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাসের বেশিরভাগ খুনি ধরা পড়েনি দীর্ঘ সাত বছরেও। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দুজনের একজন এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ড পাওয়া ১৫ জনের মধ্যে ১২ জনের কোনো খবর নেই। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলেও পুলিশ আসামিদের কাউকে চিনতেই পারেননি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রাজন তালুকদার বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি। তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা রয়েছে। কিন্তু তিনি এই পরোয়ানার ‘পরোয়া’ করেন না। প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান, স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। কেউ তাকে ধরে না।
একই মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া অন্তত ১১ আসামিও প্রকাশ্যে। তাদের কেউ ব্যবসা করেন, কেউ চাকরি করেন, কেউ কেউ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয়। যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া এক আসামি বিদেশ পালিয়ে গেলেও সম্প্রতি দেশে এসে বিয়ে করেছেন। কিন্তু পরোয়ানাভুক্ত ওই ১২ আসামিকে খুঁজে পায় না পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মৃত্যুদণ্ড আর যাবজ্জীবনের এই আসামিদের দীর্ঘদিনে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও কান্না থামছে না বিশ্বজিতের পরিবারের। রায়ের পর তারা স্বস্তি পেলেও দীর্ঘ কয়েক বছরে তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছে পরিবারটি।
আজ সোমবার (০৯ ডিসেম্বর) জাতীয় দৈনিক সমকালের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপির ডাকা সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ চলাকালে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে প্রতিপক্ষ ভেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একদল কর্মী বিশ্বজিতের ওপর নৃশংস হামলা চালায়। ওই ঘটনায় সূত্রাপুর থানায় মামলা হলে পরে সেটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। পরের বছর ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আট আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়ে রায় দেন। তবে উচ্চ আদালতে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানির রায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে দু’জন খালাস পান, চার আসামির মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল করা দু’জন খালাস পান।
আদালত ও কারা সূত্র জানায়, বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার চার আসামি কারাগারে থাকলেও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক রাজন তালুকদার, যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া মীর নূরে আলম লিমন, খন্দকার ইউনুস আলী, ওবায়দুর কাদের তাহসিন, আলাউদ্দিন, ইমরান হোসেন ইমরান, কামরুল হাসান, আজিজুর রহমান আজিজ, আল-আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল ও মোশারফ হোসেন ঘটনার পর থেকেই পলাতক। তারা সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন কর্মী ছিলেন।
পলাতক এই আসামিদের মধ্যে অন্তত সাতজন প্রকাশ্যে রয়েছেন বলে তাদের সহপাঠী ও বন্ধুদের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত চার মাসের বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে তাদের রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রাজন তালুকদার বছরের বেশির ভাগ সময় কলকাতা থাকলেও মাঝেমধ্যে দেশে এসে শাহবাগ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখা গেছে।
হত্যাকাণ্ডের পর যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া ওবায়দুর কাদের তাহসিন দুবাই হয়ে কাতার চলে গিয়েছিলেন। তার বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়। তাহসিনের ঘনিষ্ঠ সূত্র নিশ্চিত করেছে, চলতি বছরই তিনি দেশে এসে বিয়ে করেছেন। ইউনুসকে এখন যুবলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা যায়। তিনি গ্রামের বাড়ি মাগুরাতেও রাজনীতিতে সক্রিয়।
নূরে আলম লিমন কুড়িগ্রামে গ্রামের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করলেও ঢাকার আশপাশে কোনো তৈরি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন। ইমরান পুরান ঢাকায় নিয়মিত আড্ডা দেন। সর্বশেষ মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সম্মেলন ঘিরে তাকে ওই এলাকায় সক্রিয় দেখা গেছে বলে তার একাধিক বন্ধু জানিয়েছেন।
আজিজুর রহমান গ্রামের বাড়ি খুলনায় থাকেন এবং একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কামরুল ইসলাম কক্সবাজারে এখন হোটেল মালিক। তিনি এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় কথিত প্রশ্ন ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা বলে তার এক সময়ের রাজনৈতিক সহকর্মীরা জানিয়েছেন।
তবে পলাতক অন্য পাঁচ আসামি আলাউদ্দিন, আল-আমিন, মোশারফ, রফিকুল ইসলাম ও মনিরুল হক পাভেলের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক তাজুল ইসলাম। তিনি এখন সিলেট জেলা পুলিশে কর্মরত। পরোয়ানাভুক্ত এসব আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘চার্জশিট দেওয়ার সময়েই আসামিদের স্থায়ী ঠিকানায় আদালত থেকে পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে। এখন তাদের গ্রেপ্তারের দায় স্থানীয় থানা পুলিশের। তা ছাড়া যে কেউ পলাতক আসামিদের দেখলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে পারেন।’
অবশ্য বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ূয়া বলেন, ‘এতদিনেও দণ্ডিত এসব আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ার ব্যর্থতা নিশ্চয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। এজন্যই কি তারা গ্রেপ্তার হচ্ছে না, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে দণ্ডিত এসব আসামিকে গ্রেপ্তার করা উচিত।’
নিহত বিশ্বজিতের বড় ভাই উত্তম চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমরা গরিব পরিবারের সন্তান। এজন্য আমাদের পক্ষে কেউ কথা বলে না। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারেও কেউ উদ্যোগ নেয় না। কিন্তু আমরা চাই, বিনা দোষে তার ভাইকে যারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, তাদের বিচারের রায় কার্যকর হোক।’