ধর্মের কাছে ধরাশায়ী যখন বাম আদর্শ
প্রখ্যাত গণশিল্পী ফকির আলমগীর একসময় ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। এবছর তিনি পবিত্র হজ পালন করতে গেছেন। তার এ হজ পালন করা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল চলছে। এর আগে, এই বছরের গোড়ার দিকে এককালের বাম রাজনীতি করা কবি আল মাহমুদের মৃত্যুতে একই রকম উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আল মাহমুদ শেষ বয়সে শুধু পুরোদস্তুর মুসলিমই হয়ে ওঠেননি, তিনি মওদুদী মতবাদের কাছে নিজেকে সমর্পন করেন এবং কুখ্যাত রাজাকার গোলাম আজমের আত্মজীবনী লেখাসহ জামায়াত ইসলামের স্বার্থরক্ষা করে গেছেন তার লেখা দিয়ে।
প্রতিবছর হজের সময় এলেই কোন না কোন বাম নেতা বা কর্মীকে হজ পালন করতে দেখা যায়। সেসব নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় মাতম ওঠে। মানুষজন ব্যঙ্গ করে নতুন হাজীদের লাল সালাম জানায়। কিন্তু দলে দলে বাম আদর্শের মানুষগুলো হঠাৎ কেন ধর্মের দিকে ঝোঁকে সেটা নিয়ে ভাবনার যথেষ্ট অবকাশ আছে। দিনশেষে নাড়া যদি ধর্মেই বাঁধতে হয়, তবে যৌবনে সাম্যবাদের হাঁকডাক কি শুধুই বোঝার ভুল বা নিছক রোমান্টিসিজম? নাকি কিছু একটা ব্যতিক্রম করে বাহবা কুড়ানোর তৃষ্ণা?
সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম স্পষ্টতই ধর্ম পালনকে নিরুৎসাহিত করে। মার্কস বা লেলিন কখনই ধর্ম পালনকে সমর্থন করেন নাই। মাও সে তুংও ধর্মবিরোধী ছিলেন। ধর্ম পালন ভালো নাকি খারাপ, এটা একটা আলাদা বিতর্ক। তবে ধর্ম পালন বাম আদর্শের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। কার্ল মার্কস মনে করতেন, ধর্ম হচ্ছে ‘ক্লাস ডিভাইডেড সোসাইটি’ বা শ্রেণি বিভক্ত সমাজের একটি চেহারা। মার্কস ধর্মকে কর্তৃত্ববাদী শ্রেণির ‘আইডিয়োলজিক্যাল ওয়েপন’ বা ‘মতাদর্শগত অস্ত্র’ বলে থাকেন। ধর্ম গরিব-দুঃখী ও শোষিতদের ভুল পথে পরিচালিত করে। ধর্ম তাদের বিশ্বাস করতে শেখায় যে, ইহকালের দুর্ভোগ হচ্ছে নিয়তি এবং এর উত্তম প্রতিদান তারা পরকালে পাবে। নির্যাতিতদের এমন মনোভাব কর্তৃত্ববাদীদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করে দেয়।
লেনিন তো সরাসরিই বলেছেন, “Atheism is a natural and inseparable part of Marxism, of the theory and practice of scientific socialism.”
‘লেনিন অন রেলিজিয়ন’ বইয়ের ‘Socialism and Religion’ নামের নিবন্ধে লেনিন বলেছেন, “যারা সারা জীবন খেটে মরে তবু অভাবে নিমজ্জিত থাকে, ধর্ম এ পৃথিবীতে তাদের নম্রতা ও সহিষ্ণুতার শিক্ষাদান করে স্বর্গীয় পুরস্কারের সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু যারা অন্যের শ্রমশোষক, ধর্ম তাদের পার্থিব জীবনে বদান্যতা অনুশীলনের নির্দেশ দেয়। এভাবেই শোষক হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য ধর্ম খুবই সস্তা সুযোগ তৈরি করে ও পরিমিত মূল্যের টিকিটে স্বর্গবাসে তাদের স্বাচ্ছন্দ্যবিধানের ব্যবস্থা করে। ধর্ম জনগণের পক্ষে আফিমস্বরূপ। ধর্ম এক প্রকার আধ্যাত্মিক সুরাবিশেষ এবং এরই মধ্যে পুঁজিদাসদের মনুষ্য-ভাবমূর্তি এবং অল্পবিস্তর মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার দাবি নিমজ্জিত।”
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়ায় সব ধর্ম ও ধর্মীয় কর্ম নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ধর্মীয় উপসনালয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো হয় ভেঙ্গে ফেলা হয় নয়তো অফিস বা গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৫৯ সালে চীন প্রতিষ্ঠার পর চীনের কমিউনিস্ট সরকারও একই নীতি অনুসরণ করে। মাও সে তুং এর মৃত্যুর পর অবশ্য পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে যায় চীনের সংবিধানে ‘ধর্ম পালনের স্বাধীনতা’ যুক্ত করার মাধ্যমে।
এবার বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা দেখি, উত্তাল তারুণ্যে তুখোর বাম নেতা পরিণত বয়সে এসে একজন ধর্মভীরু ‘মুসুল্লি’-তে পরিণত হয়। নিয়মিত নামাজ পড়ে কপালে দাগ ফেলে দেয়, রোজা রাখে, হজ করে, হিজাবে পেঁচিয়ে রাখে নিজেকে। কেউ কেউ আবার এককাঠি সরেস হয়ে মৌলবাদী মতাদর্শের ধারক বাহক হয়ে ওঠে। চারদিকে উদাহরণের অভাব নাই।
এইতো কয়েক বছর আগে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নেতা হাসানুল হক ইনু ও বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননকে একসঙ্গে হজ পালনে যেতে দেখেছি আমরা। এরপর ওমরাহ হজ পালন করতে যান প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা মনজুরুল আহসান খান। এমন বিখ্যাত নেতারা ছাড়াও অখ্যাত অসংখ্য বাম নেতা কর্মীকে প্রতিনিয়ত আমরা ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখি। আমার নিজের পরিচিত গণ্ডির মাঝেই এমন অনেকে আছেন।
শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় আমার দুজন সহকর্মী ছিলেন, যারা ছাত্রবয়সে বাম রাজনীতি করতেন। একজন ছাত্র ফ্রন্টের নেতা ছিলেন, আরেকজন ছাত্র ইউনিয়নের। ফ্রন্ট করা সহকর্মী শুধু নিজের লেবাস পরিবর্তন করেই ক্ষান্ত হননি, নিজের একমাত্র মেয়েকে হিজাব পরিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সবার দোয়া চাইতেন। আর ছাত্র ইউনিয়নের সেই সহকর্মী নিয়মিত নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন এবং কেউ রোজা না রাখলে মেজাজ দেখাতেন। এইতো গত বছর তিনিও হজ পালন করেছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি জাহানারা হলে থাকতাম। সেই হলের ছাত্রফ্রন্টের এক নেত্রী এখন পুরোদস্তুর হিজাবী। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। আমার ব্যাচের দুইজন তুখোর ছাত্রফ্রন্ট নেতা একসাথে সংসার করছে এখন। ছেলেটা ব্যাংকে চাকরি করে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, মুখভর্তি দাড়ি, মাথায় টুপি। মেয়েটাও হিজাব করে। আরো একটা জুটি, ছাত্র ইউনিয়নের। মেয়েটা আমার ব্যাচের, ছেলেটা সিনিয়র, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তারাও হজ করেছেন। মেয়েটা এখন হিজাব করে। এরকম আরো ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে, যারা ধর্মপালন ছাড়াও পুরোদমে বুর্জোয়া জীবন যাপন করে।
এসব দেখে স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, এই দেশে বাম আদর্শের গলদটা কোথায়? তারুণ্যে শেখা আদর্শ বুদ্ধি পাকলে এভাবে কেন ধরাশায়ী হয়? আরো প্রশ্ন জাগে, আজ যেসব বাম আদর্শের নেতা কর্মীরা ধর্মের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফাটিয়ে ফেলছেন, তারা কতদিন নিজের আদর্শে টিকে থাকবেন বা আদৌ থাকবেন কিনা?
কার্ল মার্কস কিংবা লেনিন কিংবা মাও সে তুং এর আদর্শের অনুসারী হয়ে কেউ সত্যিই হজ পালন করতে পারেন কি- যেখানে তারা ধর্মকে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার মনে করতেন?
হজের অর্থনৈতিক মুনাফার কথা বাদও যদি দেই, যদি কেবল বাংলাদেশের প্রলেতারিয়েতদের দিকেই তাকাই, তাতেও শোষিতের অধিকারের বুলি আওরানো বামদের হজ পালন দৃষ্টিকটূ হয়। এই দেশের বিপুল সংখ্যক গরীব মানুষের হজের মতো ব্যয়বহুল ধর্মীয় রীতি পালনের সামর্থ্য নাই। আপনি যদি সমবন্টন আর সমতার আদর্শে বিশ্বাস করেন, তবে ধর্মপালনের এইসব বিলাসিতা কী করে করতে পারেন? আর যদি ধর্মকেই বেছে নেন, তবে সম্পদের সমবন্টন, শ্রেণিবৈষম্য ইত্যাদি ইত্যাদি কী করে সমর্থন করেন? ব্যাপারটা সোনার পাথরবাটির মতো হয়ে গেল না?