নজরুল ইসলাম বাবুকে মনে রাখেনি রাষ্ট্র!
নজরুল ইসলাম বাবু (জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই, মৃত্যু ১৯৯০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর)। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকেগানটা আসছিল না কিছুতেই। অথচ কিছুদিন পর রেকর্ডিং, নাটকে গানটি ব্যবহার করা হবে। আশির দশকের গোড়ার দিকের কথা। পবিত্র কোরবানির ঈদের পরদিন। সকালে চালের রুটি ও মাংস দিয়ে নাশতা করে রিকশায় বের হয়েছিলেন দুই বন্ধু। মালিবাগ রেলক্রসিংয়ে হঠাৎ ট্রেন এল। রিকশা থামল। ঝিকঝিক আওয়াজে ট্রেন যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখমুখ বড় হয়ে গেল নজরুল ইসলাম বাবুর। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সব কটি সিগারেট ফেলে দিলেন। প্যাকেটর সাদা কাগজে লিখলেন, ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল/ রেললাইন বহে সমান্তরাল বহে সমান্তরাল...। রিকশায় বসে পুরো গান লেখা হয়ে গেল।
গল্পটা সুরকার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজের কাছ থেকে শোনা। গল্পের নায়ক নজরুল ইসলাম বাবু এমনই সৃষ্টিশীল গানানুরাগী ছিলেন, যাঁর আত্মার সঙ্গে যেন গান মিশে ছিল। স্বাধীনতাস্তম্ভ বাংলা গানের ভুবনে যিনি ফুল হয়ে ফুটেছিলেন, নাইট কুইনের মতো, দ্রুতই ঘ্রাণ ছড়িয়ে ঝরে গেলেন অকালে।
১৭ জুলাই ক্ষণজন্মা এই গুণী মানুষের জন্মদিন ছিল। ১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জের চরনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল ইসলাম বাবু। বেঁচে থাকলে তিনি ৭০ ছুঁতেন।
না, বাবুর ৭০ পূর্ণ হয়নি। তিনি ফিরে গেছেন অজানায়, ১৯৯০ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। তখন মাত্র ৪১ বছর বয়স ছিল তাঁর। মহাকাল তাঁকে বেশি দূর যেতে দেয়নি ঠিকই, কিন্তু নজরুল ইসলাম বাবু সেই মানবসন্তান, যিনি হয়ে উঠেছেন কালোত্তীর্ণ। এই বাংলায় তিনি প্রতিদিন ফিরে আসেন, সকাল-সন্ধ্যায়। ফিরে আসেন গানের চরণে, শব্দে। কেননা, তাঁর লেখা গান ও স্মৃতি আজও শ্রোতাদের মননে স্থায়ী হয়ে আছে।শেখ সাদী খান আর নজরুল ইসলাম বাবু মিলে অনেক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
এমন অনেক গানের আড্ডা কিংবা গান বিষয়ে আলোচনায় সংশ্লিষ্টদের বলতে শুনেছি, নজরুল ইসলাম বাবু অকালে চলে যাওয়া দেশের সংগীতভুবনে জন্য বড় ক্ষতি। এ ক্ষতি অপূরণীয়। যদিও জন্মদিন এবং পরের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও বাবুকে আনুষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ স্মরণ করতে দেখিনি। তাঁর নাম নিতে শোনা যায়নি এফডিসিতে, শিল্পকলায় বা সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানে।
স্ত্রীর সঙ্গে বাবু। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকেফ্রেমে বাঁধা ছবিতে বাবু
অনেক কষ্টে মিলল পরিবারের সদস্যদের নম্বর। ১৭ জুলাই নজরুল ইসলাম বাবুর জন্মদিনেই কথা হয় তাঁর স্ত্রী শাহীন আক্তারের সঙ্গে। ১৯৮৪ সালের ২৩ নভেম্বর তাঁদের বিয়ে হয়। কেউ মনে না রাখলেও তাঁরা ঠিকই মনে রেখেছেন প্রিয় মানুষটির জন্মদিন। পারিবারিকভাবে ছোট পরিসরে কেক কেটে পালন করেছেন দিনটি। বাসাবোতে মেয়ে-নাতনিকে নিয়ে থাকেন তিনি। সেখানে গিয়ে বাসায় গিয়ে দেখা গেল ড্রয়িংরুমে ছবিতে বাবুর নানা রঙের উপস্থিতি। শোকেসে পাশাপাশি রাখা বেশ কিছু পদক। সব পরিপাটি করে সাজানো। নেই শুধু সেই মানুষটি। পারিবারিক অ্যালবামে তাঁর বেশ কিছু ছবি দেখি। পরিবারের সদস্য আর পরিচিতজনদের কাছ থেকে গল্প শুনি।
বাবা বজলুল কাদের ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মা রেজিয়া বেগম গৃহিণী। বাবা বজলুল কাদেরের সংগীতের প্রতি অনুরাগ ছোটবেলা থেকেই বড় সন্তান নজরুল ইসলাম বাবুকে প্রভাবিত করে। চার ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বাবু ছিলেন সবার বড়। স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে মামার কর্মস্থল বরিশালে চলে যান। বরিশাল বি এম স্কুল অ্যান্ড কলেজে মাধ্যমিক এবং পরে জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও বিএসসি ডিগ্রি নেন।সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে বাবু।
বরাবরই অন্যদের চেয়ে একটু আলাদাই ছিলেন। যখন স্কুল-কলেজে বিদ্যুতের সংযোগ পৌঁছায়নি, বিজলিবাতি জ্বলেনি, তখনো কলেজের হোস্টেলে মধ্যরাত অবধি জেগে হারিকেন জ্বালিয়ে সাহিত্যের আড্ডা জমাতেন বাবুরা। আশেক মাহমুদ কলেজের অধ্যাপক মো. মজিবর রহমান স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘বাবুর নামটা শুনলেই চেহারাটা জীবন্ত ভেসে ওঠে। মাঝারি আকৃতির তরুণ। ওষ্ঠে গোঁফ, মুখটা কিন্তু কচি। চোখ ডাগর নয়, মায়াবী আবেশে পরিপূর্ণ। দেখলে মনটা কেমন আহ্লাদে ভরে যায়।’ ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে যান তিনি। জড়িয়ে যান রাজনীতিতে।
অস্ত্র ধরেছিলেন দেশের জন্য
তখন ২১ বছরের টগবগে তরুণ নজরুল ইসলাম বাবু। দেশে তখন মুক্তির লড়াইয়ের প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আন্দোলন চলছে। সে সময়, অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে সালে তৎকালীন সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্রনেতা হিসেবে বেশ নামডাক তাঁর। কলেজশিক্ষক অধ্যাপক দুর্গাদাস ঘোষ স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘উনসত্তর সত্তরের সেই দিনগুলোতে তার লেখায় কেমন যেন অস্থিরতা পাওয়া যেত। এমনিতে সে ছিল স্বভাবকবি। স্বদেশভাবনা তার কাব্যচেতনায় মুক্তির আন্দোলনের সময় যথেষ্ট প্রগাঢ়তা পেয়েছিল।’একদিন চলচ্চিত্রের গানের রেকর্ডিংয়ে মনতাজুর রহমান আকবর, নজরুল ইসলাম বাবু,অ্যান্ড্রু কিশোর এবং শেখ সাদী খান
একদিন তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে তৎকালীন সামরিক জান্তা। একসময় তিনি আত্মগোপন করেন। চলে যান ভারতে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ক্যাম্পে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরে তুরার পাহাড়ে বসে যুদ্ধপ্রশিক্ষণের অবসর মুহূর্তে গান লিখতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যাম্পের ভয়ংকর এবং কঠোর জীবন নজরুল ইসলাম বাবুকে পরবর্তী সময়ে সম্পূর্ণ কবি করে তোলে। ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মসি ও অসি দুটোই সমান চালানোয় দারুণ দক্ষ ছিলেন বাবু। তাঁর অন্যতম দায়িত্ব ছিল বিস্ফোরক দিয়ে ভারী ও মজবুত পুল বা ব্রিজ ধ্বংস করে হানাদারদের যোগাযোগবিচ্ছিন্ন করা। দেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার লেখাপড়া, সাহিত্য ও সংগীতচর্চা শুরু করেন।
কবি হতে এসেছিলেন ঢাকায়
যুদ্ধ শেষে আবার লেখাপড়ায় ফিরে গিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। চলে আসেন ঢাকায়। এসেছিলেন কবি হতে। একদিন শাহবাগের বেতার ভবনে পরিচয় সেখানকার কর্মকর্তা শেখ সাদী খানের সঙ্গে। আবুল মিয়ার ক্যানটিনে। পকেট থেকে বের করে একটা গান দিলেন শেখ সাদীকে—‘আলো আর এমনি আলো হাজার দুয়ার খুলে গেল।’ খুব পছন্দ হলো শেখ সাদী খানের। পরের রোববার আসার পরামর্শ দিলেন। বাবু শিল্পী সুখেন্দু চক্রবর্তীর জন্য লিখলেন, ‘না দেখাই ছিল বুঝি ভালো’ গানটি। প্রথম গানটি সফল। ব্যস, জুটি হয়ে গেল সুরকার শেখ সাদী খান আর গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবুর।পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাবু
দুজন মিলে গান করতে থাকেন। শাহবাগের বেতারে, রমনা পার্কে, মহিলা সমিতির পাশে ব্যাংকের সিঁড়িতে। একে একে সৃষ্টি হয় সুবীর নন্দীর ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, শাম্মী আকতারের কণ্ঠে ‘মনে হয় হাজার ধরে দেখি না তোমায়’, আশা ভোসলে ও বেবী নাজনীনের ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপনেরও রাত’, কুমার শানুর কণ্ঠে ‘আমার মনের আকাশে আজ জ্বলে শুকতারা’, হৈমন্তী শুক্লার কণ্ঠে ‘ডাকে পাখি খোল আঁখি’—এমন জনপ্রিয় সব গান। সেসব স্মৃতিচারণা করে শেখ সাদী খান বলেন, ‘স্বাধীনতার পরে যেকজন গীতিকার বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন, নজরুল ইসলাম বাবু ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর অকালে চলে যাওয়া আমাদের সংগীতাঙ্গন যে বিশাল ক্ষতি হয়েছে, তা বলে প্রকাশ করা যাবে না।’
স্বল্প জীবনকালে নজরুল ইসলাম বাবু সবচেয়ে বেশি গান করেছেন সুরকার শেখ সাদীর সঙ্গে। মূলত, আধুনিক গানগুলোই তাঁর সঙ্গে করা। ওই সময়ে নজরুল ইসলাম বাবু ও শেখ সাদী খান এবং আলাউদ্দিন আলী ও মনিরুজ্জামান দুটি জনপ্রিয় জুটি হয়েছিল দেশের সংগীতাঙ্গনে।জীবনকালে পাওয়া পুরস্কারগুলো এখন ড্রয়িং রুমের শোকেসে সাজানো।
এক হাতে তিনি লিখেছেন ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল’, ‘কথা বলব না বলেছি, শুনব না শুনেছি’, ‘কাঠ পুড়লে কয়লা হয় আর কয়লা পুড়লে ছাই’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, সে কথা তুমি যদি জানতে’, ‘আমার মন কান্দে ও আমার প্রাণ কান্দে’সহ অনেক গান। তাঁর গান গেয়েছেন বশীর আহমেদ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, আশা ভোসলে, সুবীর নন্দী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, শাম্মী আখতার, দিলরুবা খান, বেবী নাজনীন, সুখেন্দু চক্রবর্তী, অ্যান্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, শুভ্র দেব, কুমার শানুসহ অনেকেই।
বাবুর হাতের লেখা ‘একটি বাংলাদেশ’ গানটি। পুরোনো ডায়েরি থেকেএকসময় চলচ্চিত্রে গান লিখতে শুরু করেন। ‘আঁখি মিলন’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘মহানায়ক’, ‘প্রতিরোধ’, ‘উসিলা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’,‘ প্রেমের প্রতিদান’-এর মতো দারুণ সব চলচ্চিত্রের দারুণ দারুণ গান রচনা করেছেন বাবু। ১৯৯১ সালে ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র ও বাংলাদেশ প্রযোজক সমিতির পুরস্কারে পুরস্কৃত হন। ১৯৮৬ সালে যৌথ প্রযোজনায় সমষ্টি চলচ্চিত্রের ব্যানারে একটি চলচ্চিত্র তৈরিতে হাত দেন। তিনি এ ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান লিখেছেন তিনি।
দেশের গানে অতুলনীয় বাবু
স্বেচ্ছায় বা ফরমাশে, প্রায় প্রতিদিনই লিখতেন বাবু। যত্রতত্র লিখতেন। হাতের কাছে যেকোনো কাগজ পেলে লিখতেন, সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে সে কাগজে লিখতেন। আড্ডা দিতে দিতে দিতে, চা খেতে খেতে, গল্প করতে করতে লিখতেন।
তবে যে কথাটি না বললেই নয়, তা হলো দেশের গানে অতুলনীয় নজরুল ইসলাম বাবু। বলা যায়, যেহেতু নিজে মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, সেই মমত্ববোধের ছাপ পাওয়া যায় তাঁর গানে গানে। যেমন ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না, আমি গাইব বিজয়ের গান, ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’, কিংবা ‘ও আমার আট কোটি ফুল দেইখো গো মালি’ শুনলে বোঝা যায় তাঁর ভেতরে কতটা গভীর দেশপ্রেম ছিল। দেশের গানগুলো বেশির ভাগই করেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে জুটি হয়ে।
লেখালেখির জন্য অল্প সময়ে পেয়েছিলেন। আশ্চর্যর বিষয়, কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তিনি স্পর্শ করেছিলেন জনপ্রিয়তার শিখর। তাঁর শব্দ ব্যবহার এবং প্রকাশভঙ্গির ঋজুতা, বাক্যের বিদ্যুৎগতিময়তাকে বিশিষ্ট করেছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘মায়ের মাথার সিঁথির মতো লম্বা সাদা পথ’, ‘হৃদয়ের চেয়ে ভালো কোনো ফুলদানি নেই’; লিখেছিলেন ‘ওই কালো কেশ তুমি ছড়ালে যখন মেঘেরা পেল যেন লজ্জা’, এমন সুন্দর সব শব্দ নিয়ে বাক্যগঠন।সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্র ছিলেন।
একরোখা স্বভাবের ছিলেন নজরুল ইসলাম বাবু। স্মৃতিচারণা করে গীতিকার রফিকুজ্জামান বলেন, অসম্ভব প্রতিভাশালী গীতিকার ছিলেন বাবু। সত্যিকার কবিপ্রতিভা নিয়ে জন্ম নিলেও নজরুল ইসলাম বাবু আধুনিক কবিতার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে নিবিষ্ট হয়েছিলেন গানের কবিতায়। ওঁর বিষয়চয়ন ছিল খুব সুন্দর, অদ্ভুত সব আইডিয়া নিয়ে আসতেন গানে। ‘উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব ঘুরে এক ব্রহ্মচারী’ গানটির উদাহরণ দিয়ে রফিকুজ্জামান বলেন, ‘ওর মধ্যে একটা পাগলামি ছিল। নিজে যেটা লিখে ফেলত, সেটির ছন্দ বা অন্য কোনো ভুল থাকলে তা সংশোধন করতে চাইত না। বলত, যা লিখেছি, লিখে ফেলেছি আর চেঞ্জ করব না।’
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের এক স্মৃতিচারণায় এটি আরও স্পষ্ট। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলসহ চারজন মিলে গীত, সুর ও বাদ্যযন্ত্রের একটি শুদ্ধ দল গঠন করেছিলেন। আরও ছিলেন শেখ ইসতিয়াক, নজরুল ইসলাম বাবু ও মকসুদ জামিল মিন্টু। ১৯৮০ সালের দলটির মূলমন্ত্র ছিল শুদ্ধ সংগীত মানে দেশাত্মবোধক গান। শেখ ইশতিয়াক গিটার বাজাবেন, বুলবুল হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুর করবেন, নজরুল লিখবেন। মিন্টু স্বরলিপি রচনা করবেন। এই স্মৃতিচারণা করে বুলবুল নিজে বলেছিলেন, ‘আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম, সাধনা ছাড়া শিল্পী হওয়া যায় না। তবে একবার “সব কটা জানালা খুলে দাও না” গানে বাবুর সঙ্গে “জানালা” শব্দটি নিয়ে বেশ অভিমান। বাবু “জানালা” শব্দটির পক্ষে ছিলেন না। সেখানে লিখেছিলেন “দরজা”। সত্যি সত্যি এ “জানালা” শব্দটির জন্য অদৃশ্য দেয়াল গড়ে ওঠে।’ স্মৃতিচারণায় লিখেছেন বুলবুল।চলচ্চিত্রের প্রযোজনা শুরু করেছিলেন।
তাই বলে গুরুগম্ভীর বা রাগী মানুষ ছিলেন তা নয়। খুব আড্ডাপ্রিয় মানুষ ছিলেন। সংগীতশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী স্মৃতিচারণা করে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে একজন বন্ধুবৎসল নিরাসক্ত এবং অমায়িক সহজসরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।
১৯৯০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর চলে গেছেন না-ফেরার দেশেআজও মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
নজরুল ইসলাম বাবু নেই। একহাতে তিনি দিয়ে গেছেন একটার পর একটা জনপ্রিয় গান। বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গন সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর কাব্যিক গানের কথায়। সমৃদ্ধ করেছেন চলচ্চিত্রশিল্পকে। অথচ গেল এক সপ্তাহেও কোনো চলচ্চিত্র বা সংগীতবিষয়ক কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন আনুষ্ঠানিক কোনো আয়োজনে স্মরণ করেনি এ গুণীকে। তাঁকে যথাযথ মূল্যায়ন করেনি কেউ। না মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, না গীতিকবি হিসেবে।
বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন আফসোস করে বলেন, ‘আসলে বাবুর মূল্যায়ন সেভাবে হয়নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর সম্মান পাওয়া উচিত ছিল।’
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বাংলার শিক্ষক আবৃত্তিকার ইসমাইল সাদী বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো তাঁর গানগুলো ছাড়া পূর্ণতা পায় না। কিন্তু ভাবতে খুব কষ্ট হয়, তাঁর মতো প্রতিভাধর ও কালজয়ী গীতিকবির কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি আজও। অথচ তাঁকে পুরস্কৃত করলে সম্মানিত হবে কর্তৃপক্ষ।
১৭ জুলাই ক্ষণজন্মা এই গুণী মানুষের জন্মদিন ছিলনজরুল ইসলাম বাবুর সহধর্মিণী শাহীন আক্তার জানালেন, পারিবারিকভাবে ৭০তম জন্মবার্ষকী পালন করেছেন। বাইরের কেউ ছিল না, মনে রাখেনি দিনটি। শাহীন আক্তার বলেন, ‘এখনো মানুষের মুখে মুখে তাঁর লেখা গান শুনি। এটাই আমার বড় পাওয়া। আমার দুই মেয়ে নাজিয়া ও নাফিয়া বাবাকে নিয়ে এভাবেই গর্ব করে। তারপরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে একজন সৃজনশীল মানুষের কাজের মূল্যায়ন বিশেষ সম্মানের। “সব কটা জানালা খুলে দাও না” গানের সুরকার ও শিল্পীকে একুশে পদক প্রদান করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে যাঁর সৃষ্ট পঙ্ক্তিমালা দিয়ে গানটি রচিত, তাঁকেও মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।’
স্কুলটিও অবহেলিত
১৯৯৬ সালে জামালপুরের পোড়াবাড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে। সে প্রতিষ্ঠান আজ অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। এমনও অবস্থা হয়েছিল, স্কুলের শ্রেণিকক্ষের দরজা–জানালাও নষ্ট হয়ে যায়। পরে বাবুর স্ত্রী শাহীন আক্তার স্বামীর মুক্তিযুদ্ধের সম্মানীর টাকা তুলে স্কুলের জন্য পাঁচটি দরজা মেরামত করে দেন। বারবার আবেদন করেও স্কুলটি এমপিওভুক্ত করা যায়নি। বর্তমানে স্কুলটিও অবস্থা বেশ নাজুক।
নজরুল ইসলাম বাবু এখন সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। সব কটা জানালা বাবু নিজেই খুলে রেখে গেছেন, সুতরাং তাঁর আসা–যাওয়া নিত্যই আমাদের হৃদয়ে অব্যাহত রয়ে গেল এবং তা চুপিসারে নয়, আলোকোজ্জ্বল প্রকাশ্যে। সেটা কতজনেরই–বা ভাগ্যে ঘটে!