• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

মানহাকে আর কোনোদিন স্কুলে নিয়ে যাবে না বাবা তমাল ॥ এ সপ্তাহে বাড়ি আসার কথা ছিলো

প্রকাশ:  ৩০ মার্চ ২০১৯, ১১:২৬
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

বৃহস্পতিবার ঢাকার বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের সময় আগুন যখন বাড়তে থাকে, সে সময় পরিবারের সকলের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন আব্দুল্লাহ আল ফারুক তমাল (৩২)। বড় ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন তুহিন ফোন করে তমালকে দ্রুত ভবনের ছাদে উঠে যেতে বলেন। পরে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে তমাল জবাব দেন, ‘নো স্কোপ।’ শেষ পর্যন্ত অগ্নিকা-ের হাত থেকে আর বেঁচে ফিরতে পারেননি ইইউআর সার্ভিস বিডি লিমিটেডের সেলস্ ম্যানেজার আব্দুল্লাহ আল ফারুক তমাল।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৫নং গুপ্টি ইউনিয়নের শ্রীকালিয়া গ্রামের মুন্সি বাড়ির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মকবুল আহমেদ ও জান্নাতুল ফেরদৌস দম্পতির তিন ছেলের মধ্যে তমাল দ্বিতীয়।
তমালের ছোট ভাই তুষার জানান, ১৯৮৮ সালের ১ জানুয়ারি (আইডি কার্ড অনুযায়ী) তমালের জন্ম। ২০০৫ সালে তিনি ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ২০০৬-০৭ ব্যাচের ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে ২০১১ সালে পাস করেন। সর্বশেষ চাকুরি হিসেবে  তিনি ইইউআর সার্ভিস বিডি লিমিটেডের সেলস্ ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তমালের দুটি সন্তান রয়েছে। পাঁচ বছরের মেয়ে সোহাইলী তেহরীন মানহা ও দেড় বছরের সন্তান আব্দুল্লাহ আল আইমান। প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবারও মেয়ে সোহাইলী তেহরীন মানহাকে স্কুলে দিয়ে অফিসে যান তমাল। বাচ্চা স্কুুল থেকে ফিরেছে কি-না জানতে প্রতিদিন কয়েকবার ফোন দিতেন স্ত্রী সানজীদা অভিকে।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে স্ত্রীকে ফোন দিয়ে তমাল বলেন, ‘অভি (স্ত্রীর ডাকনাম) আমাদের ভবনে আগুন লেগেছে। দোয়া করো।’ এ সময় তমাল দুই সন্তান সোহাইলী তেহরীন মানহা ও দেড় বছরের সন্তান আব্দুল্লাহ আল আইমানের দিকে খেয়াল রাখার জন্যে বারবার স্ত্রীকে বলেন।
পরে টেলিভিশনে তমালের মৃত্যুর সংবাদ জানতে পারে তার পরিবার। এরপরই তারা ছুটে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভাইয়ের দগ্ধ মরদেহ দেখে বুক চাপড়িয়ে আর্তনাদ করতে থাকেন বড় ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন তুহিন।
আগুন লাগার পর পরিবারের সকলের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন তমাল। বলছিলেন, ধোঁয়ায় নিঃশ^াস নিতে কষ্ট হচ্ছে, সেফ জোনে আছেন বলেও জানান। সেই সেফ জোনটা যে আজীবনের জন্যে হবে, তা বুঝতে পারেনি কেউ।
ছোট ভাই তুষার ও পরিবারের সদস্যরা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা তমালের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
ছোট ভাই তুষার জানান, ‘অফিসিয়ালি কিছু কাজ শেষ করে দিবাগত রাত ১২টায় ভাই তমালের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গতকাল শুক্রবার বাদ জুমা তমালের জানাজা শেষে ডেমরার সারুলিয়ায় তার লাশ দাফন সম্পন্ন হওয়ার কথা।
তমালের বাবা ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আল্লাহ তুমি একি করলা। আমি এত বড় কষ্ট হজম করব কীভাবে? আমার তমালকে এত তাড়াতাড়ি তুমি নিয়ে গেলা কেন? আমার দুই নাতির কী হবে? আমার তমাল বাঁচার জন্য আড়াই ঘণ্টা ভবনে লড়াই করেছে। কিন্তু বের হওয়ার সুযোগ পায়নি। তাই জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে। সরকার কি আমার তমালকে বের করতে পারত না? আমার সবই শেষ। পিতা হয়ে আমি কীভাবে ছেলের লাশ বহন করব?’
এর মধ্যে তমালের মৃত্যুর সংবাদে হাসপাতালে ছুটে যান তার অফিসের সহকর্মী, বন্ধুবান্ধবসহ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থী ও আত্মীয়-স্বজন।
তমালের সহকর্মী রবিউল জানান, আগুন লাগার বিষয়ে প্রথমে অফিসের সবাইকে জানিয়েছিলো তমাল। এরপর সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু আগুনের ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় তমাল নীচে নামতে পারেননি বলে ধারণা।
তমালের স্ত্রী সানজিদা অভির দুই বোন নুসরাত জাহান মীম ও তাসমীমা দুজনই ঢামেকের সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
শ্যালিকা তাসমীমা বলেন, তমাল ভাইয়ের মতো এত ভাল মানুষ হয় না। তার সন্তান দুটি জানে না বাবা আর কখনো তাদের আদর করবে না। মেয়ে মানহাকে স্কুল থেকে না নিয়ে গেলে বাসায় না যাওয়ার বায়না ধরত সে। এখন তাকে কে স্কুলে নেবে। আমার বোনটা এত কষ্ট কীভাবে সামলাবে?’
তমালের স্ত্রীর আরেক বোন নুসরাত জাহান মীম বলেন, ‘বোনের বিয়ে হয়েছে ২০১২ সালে। বিয়ের মাত্র সাত বছরের মাথায় এত তাড়াতাড়ি তমাল ভাই চলে যাবে, এটা কীভাবে মেনে নেব।’
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার কয়েক ঘণ্টা পর আরো অনেকের সঙ্গে তমালকেও উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। বিকেলে ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তমালকে মৃত ঘোষণা করেন।
বন্ধু রাজু বলেন, ‘ও আমার খুব ভালো বন্ধু। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। পড়ালেখা শেষে দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পর সর্বশেষ ইইউআর সার্ভিস বিডি লিমিটেডে সেলস্ ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত  ছিলেন তমাল। এফআর টাওয়ারেই ছিল তার অফিস।’
তমালের বন্ধু মোস্তফা কামাল জানান, যখন আগুন লাগে, তখন তমাল ছিলেন ১১ তলায়। সর্বশেষ তার সঙ্গে বিকেল সাড়ে ৩টায় ফোনে কথা হয়। তখন তিনি ১২তলায় ছিলেন। তারপর থেকে ফোনে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পরে তারা জানতে পারেন তমাল মারা গেছেন।
গতকাল শুক্রবার সকালে একদল সংবাদকর্মী হাজির হয় গুপ্টি পূর্ব ইউনিয়নের শ্রীকালিয়া গ্রামের মুন্সী বাড়িতে। বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চারিদিকে শুনশান নীরবতা। অযতেœ পড়ে আছে একটি ভাঙ্গাচুড়া ঘর। স্থানীয়রা জানান, তারা পরিবারবর্গ ঢাকায় থাকেন। তবে এ সপ্তাহেই বাড়িতে আসার কথা ছিল। হয়তো সেটা আজ শুক্রবারই হতে পারতো সে দিনটি! কিন্তু যে মানুষটির আজ বাড়ি আসার কথা ছিল, তিনি কি আর কখনো বাড়িতে ফিরবেন? না, সেটা কোনো দিনও সম্ভব নয়। কারণ, সে মানুষটি চলে গেছেন পরপারে।
তমালের চাচী অহিদা বেগম জানালেন, ‘তমাল আমার ভাসুরের ছেলে। আজকে সে বাড়ি আসার কথা ছিল। সে আসতে পারে নি। দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। আমি এক সন্তানহারা মা, আমি জানি সন্তান হারানোর বেদনা কতটা কঠিন।’
তমালের বড় জেঠা বদি আহমেদ মুন্সি ভাতিজার মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ! আস্তে আস্তে বলেন, ‘ছেলেটা আইজই বাইত আওয়ইনা আছিলো। অনুষ্ঠান আছিলো বাড়িত। কিন্তু দুর্ঘটনায় হেয় আসে নাই। আর কোনদিন আইবো না!’ বলেই কাঁদছিলেন তিনি।
আরেক চাচা মনির হোসেন জানান, তমালের মৃত্যুতে আমরা খুবই শোকাহত। তমালের এমন অনাকাঙ্খিত মৃত্যু কখনোই কাম্য ছিল না। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুক। আর যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, এটাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা।
তমালের ফেসবুক ঘুরে দেখা গেছে, তমালের পরিবারের বিভিন্নজনের সাথে ছবি রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ছবি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর মধ্যে মা জান্নাতুল ফেরদৌসীর সাথে তমালের যৌথ ছবি। অন্য একটি ছবিতে  সাগর পাড়ে দুই সন্তান ও স্ত্রী অভির সাথে তমালের একটি গ্রুপ ছবি । যা এখন স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। (তথ্যসূত্র : এনটিভি ও টিবিটি)

 

 

সর্বাধিক পঠিত