ফরিদগঞ্জে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় হামলা ॥ সাবেক এমপির গাড়ি ভাংচুর ॥ আহত ৩০
বর্ধিত সভায় হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ : জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক


ফরিদগঞ্জে উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর চালিয়েছে দলের অপর একটি গ্রুপ। এতে উভয় গ্রুপে সংঘর্ষে এবং পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়েছে। এ সময় স্থানীয় সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়ার গাড়ি ভাংচুর করা হয়। সংঘর্ষের সময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৯০ রাউন্ড শর্টগানের গুলি ছোড়ে। সংঘর্ষে এবং হামলায় বর্ধিত সভাস্থল উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি চত্ত্বর ভাংচুরের শিকার হয়।
গুরুতর আহতরা ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টার পর থেকে ১টা পর্যন্ত উপজেলা বিআরডিবি কার্যালয় সম্মুখে দফায় দফায় এ সংঘর্ষ চলে।
সংঘর্ষকালে পুলিশের গুলিতে আহতরা হচ্ছেন : উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহবুব আলম সোহাগ, জেলা পরিষদের সদস্য সাইফুল ইসলাম রিপন, সাবেক জেলা ছাত্রলীগ নেতা অ্যাডঃ মাহবুবুল আলম, ছাত্রলীগ নেতা রিপন, নিবিড় আহমেদ, শরিফসহ ৩০ জন। গুলিবিদ্ধ আহতদের ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে হামলার শিকার ফরিদগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহবুব আলম সোহাগ জানান, সকালে বিআরডিবি কার্যালয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা শুরু হয়। সভায় উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ও সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া, সভাপতি আবুল খায়ের পাটওয়ারী, সাধারণ সম্পাদক আবু সাহেদ সরকার, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডঃ জাহিদুল ইসলাম রোমানসহ উপজেলা নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভার শেষ পর্যায়ে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাহিদুল ইসলাম রোমান বক্তব্য দিচ্ছিলেন। এ সময় স্থানীয় বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুর রহমানের সমর্থকরা একটি মিছিল নিয়ে বর্ধিত সভায় প্রবেশ করে সবাইকে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। একপর্যায়ে বর্ধিত সভা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ সময় সাবেক এমপি শামছুল হক ভূঁইয়ার গাড়িসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুর রহমানের সমর্থকরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বর্তমান সংসদ সদস্য সাংবাদিক শফিকুর রহমানের একজন সমর্থক জানান, বর্ধিত সভায় চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সাংবাদিক শফিকুর রহমানকে দাওয়াত না দেয়ায় তাঁর সমর্থকরা বর্ধিত সভায় বাধা প্রদান করেন। এতে সাবেক সংসদ সদস্য ড. শামছুল হক ভূঁইয়ার কর্মী-সমর্থকরা তাদের উপর হামলা করে।
ঘটনা সম্পর্কে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল খায়ের পাটোয়ারী বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করতে আজ (গতকাল) বর্ধিত সভা করি। কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়ম মেনে তৃণমূলের নেতাদের নিয়ে আমরা বর্ধিত সভা করছিলাম। সভাও সুন্দর মতো শেষ হচ্ছিলো। এমতাবস্থায় বেশকিছু সন্ত্রাসী পুলিশের সামনে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে সভায় হামলা চালায়। সভার শুরুর দিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সাহেদ সরকার সভায় উপস্থিত থাকলেও হামলার সময় রহস্যজনক কারণে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। আমি মনে করি এ হামলা সুপরিকল্পিত এবং ন্যাক্কারজনক। তিনি আরো জানান, এ সভায় আমাদের স্থানীয় সংসদ সদস্য জনাব মুহম্মদ শফিকুর রহমান উপস্থিত থাকতে তাঁকে দাওয়াত দেয়ার জন্যে আমি এবং আমার সেক্রেটারী একাধিকবার ফোন করলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবু সাহেদ সরকার বলেন, বর্ধিত সভায় আমাদের স্থানীয় এমপি মহোদয়কে দাওয়াত দেয়ার জন্যে আমার সভাপতিকে বলা হলে তিনি নিষেধ করেন। এরপর আমরা ২৮ জানুয়ারি রাতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম দুলাল পাটওয়ারীর বাসায় গিয়ে তাঁকে বর্ধিত সভার দাওয়াত দেই। তিনি আমাদের কাছে জানতে চান, স্থানীয় এমপিকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে কি না। যখন তিনি জানালেন এমপিকে দাওয়াত দেয়া হয়নি, তখন তিনি বর্ধিত সভায় যেতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। তিনি এও বললেন, স্থানীয় এমপিকে দাওয়াত দিয়ে প্রয়োজনবোধে ৩০ জানুয়ারি বর্ধিত সভা করতে। কিন্তু আমার সভাপতি আবুল খায়ের পাটওয়ারী সে পরামর্শ রাখেননি। এদিকে নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সংসদ সদস্য সাংবাদিক মুহম্মদ শফিকুর রহমানকে বর্ধিত সভার বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাওয়াত দেয়া হলেও তিনি আসতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো পদ-পদবিতে না থাকায় তাঁর এ অপারগতা।
অন্যদিকে ফরিদগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহফুজুল হক বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বর্ধিত সভার আয়োজন করা হয়েছে। তাতে সভায় বিশৃঙ্খলা হয়েছে। সংঘর্ষের পরই বর্ধিত সভা প- হয়ে যায়।
অপরদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল বলেন, বর্ধিত সভা স্থগিত বা জেলা আওয়ামী লীগ থেকে নিষেধ করার কথাটি সঠিক নয়। উপজেলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়ম মেনেই বর্ধিত সভা করছিলো। কিন্তু সভায় কারা হামলা করলো তা অবশ্যই তদন্ত করে বের করতে হবে প্রশাসনকে। আমরা জেলা আওয়ামী লীগ এ হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। হামলাকারীদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডঃ জাহিদুল ইসলাম রোমান জানান, আমি আমন্ত্রিত হয়েই সভায় যোগ দিয়েছি। কিন্তু যে ঘটনা ঘটলো তা খুবই দুঃখজনক। কতিপয় দুষ্কৃতকারীর এই ন্যাক্কারজনক হামলার উদ্দেশ্য কী? বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী উপজেলা আওয়ামী লীগ এই বর্ধিত সভা করে। এ সভায় দুষ্কৃতকারীরা কাদের ছত্রছায়ায় এ ধৃষ্টতা দেখালো তা অবশ্যই প্রশাসনকে তদন্ত করে বের করতে হবে।
সাবেক এমপি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া বলেন, যে ঘটনাটি ঘটেছে তা আওয়ামী লীগের জন্যে লজ্জাজনক ব্যাপার। এর চাইতে বেশি কিছু আমি বলতে পারবো না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে এই বর্ধিত সভা আহ্বান করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল খায়ের পাটওয়ারী ও সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আবু সাহেদ সরকার।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আসাদুজ্জামান জুয়েল জানান, হাসপাতালে ১০ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এদের শরীরের বিভিন্নস্থানে জখমের চিহ্ন রয়েছে।
ফরিদগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ হারুনুর রশীদ চৌধুরী জানান, উভয় পক্ষের সংঘর্ষ থামাতে ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশের সঙ্গে জেলা গোয়েন্দা ও দাঙ্গা পুলিশ অংশ নেয়। এ সময় পুলিশ ৯০ রাউন্ড শর্টগানের গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় সহকারী উপ-পরিদর্শক রবিউলসহ ৩ পুলিশ সদস্য আহত হন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ও চাঁদপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান জানান, কী কারণে এবং কেনো এই সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের পুলিশ সুপার মোঃ জিহাদুল কবির পিপিএম বলেন, ফরিদগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা চলছিলো। সভায় বর্তমান সংসদ সদস্য জনাব শফিকুর রহমানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সে কারণে তাঁর সমর্থকরা সভাস্থলে গিয়ে মারামারিতে লিপ্ত হয়। পুলিশ উভয় পক্ষকে নিয়ন্ত্রণে আনতে শর্টগানের গুলি ছোড়ে। বর্তমানে অবস্থা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।