সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আর বেঁচে নেই
ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে ৬৮ বছর বয়সেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে হার মানলেন কিংবদন্তীতুল্য আদর্শবান এই রাজনীতিবিদ। শপথ নিতে সময় চেয়েছিলেন সৈয়দ আশরাফ। ব্যাংককের হাসপাতালে কয়েকমাস চিকিৎসাধীন থাকার পর গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না...রাজিউন)।
দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী বর্ষিয়ান এ নেতার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদও। একইভাবে শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও চাঁদপুর-৩ আসনে সংসদ সদস্য ডাঃ দীপু মনিসহ সকল নেতা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ জনপ্রশাসন মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
হাসপাতালে থেকেই তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি সৈয়দ আশরাফ। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ বিষয়ে জানিয়েছিলেন, শপথের জন্যে সময় চেয়ে আবেদন করেছেন নবনির্বাচিত এই সংসদ সদস্য।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গতকাল রাত পৌনে ১০টায় সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়। এ খবর পেয়ে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীও সঙ্গে সঙ্গে শোক জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন।
হেফাজতের আন্দোলন শক্ত হাতে দমনের জন্যে নেতা-কর্মীদের কাছে প্রশংসিত ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা স্বয়ং আশরাফের জন্যে ভোট চেয়েছিলেন কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে। তিনি জেলার নেতাদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেছিলেন, যেহেতু এখানে সৈয়দ আশরাফ সাহেব অসুস্থ, সবাই মিলে তার জন্যে কাজ করে যাবেন, যেনো তিনি নির্বাচনে জয়ী হন। সুস্থ হয়ে তিনি যেনো আমাদের মাঝে ফিরে আসেন এই দোয়া করছি।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে আশরাফ ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থার মধ্যে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হওয়ার পর দলের হাল ধরেন। ওই বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসেবে পরে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন তিনি। দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর ২০১৬ সালের কাউন্সিলে তাঁকে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীতে নিয়ে যান শেখ হাসিনা। ২০০৯ সাল থেকে নানা ঘটনা এবং ২০১৪ সালে বিএনপির বর্জনের মধ্যে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার পাশাপাশি আশরাফের ভূমিকার কথা গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করেন দলটির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা।
২০১৬ সালের কাউন্সিলের আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সৈয়দ আশরাফকে সরিয়ে দেয়ার পর নানা গুঞ্জন ছড়ালেও কাউন্সিলে শেখ হাসিনার সঙ্গে আশরাফের ছবি তা নাকচ করে দিয়েছিল।
আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে বরাবরই শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, তার প্রতিদানও তিনি পেয়েছেন।
২০১৭ সালে স্ত্রী শীলা আহমেদের মৃত্যুর পর থেকে নিজেও অসুস্থ ছিলেন আশরাফ। মন্ত্রিসভার কাজেও অনিয়মিত ছিলেন তিনি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সংসদ থেকেও ৯০ দিনের জন্যে ছুটি নিয়েছিলেন তিনি।
ব্যাংককের হাসপাতালে থেকেই করা ওই আবেদনে আশরাফ বলেছিলেন, তিনি ‘ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন ইউনিটে’ ভর্তি রয়েছেন। তার চিকিৎসায় আরও অনেকদিন সময় লাগবে। তার চার মাসের মধ্যে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন এই রাজনীতিক।
সাবেক রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফের রাজনীতির হাতেখড়ি ছাত্রলীগের মাধ্যমে। ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন তিনি, ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও। ১৯৭৫-এর আগস্ট ট্র্যাজেডির পর যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত জীবনেও আওয়ামী লীগকে সক্রিয় রাখতে ভূমিকা রেখেছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের এই ছেলে।
১৯৭৫ সালের আগস্ট ট্র্যাজেডির পর নভেম্বরে কারাগারে সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর বিরূপ পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন আশরাফ। লন্ডনে নির্বাসিত জীবনে থেকেও আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন সৈয়দ নজরুলের বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফ।
দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফ। এরপর ধারাবাহিকভাবে ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এবার আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন দেয়ার সময় আশরাফের আসনে কাকে প্রার্থী করা হবে তা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। শেষপর্যন্ত তাঁর উপরই আস্থা রাখে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এবার নিয়ে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
সূত্র : বিডিনিউজ ২৪ ডট কম।