গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব
গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডের নির্বাচনে ক্ষমতা কমছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব হলেও গ্রামীণ ব্যাংকের নিজস্ব ক্ষমতা বাড়ছে। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনে গ্রামীণ ব্যাংক (পরিচালক নির্বাচন) বিধিমালায় বেশ কিছু সংশোধনের প্রস্তাব করা হয় গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে একটি সংশোধনের খসড়া তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
বিদ্যমান বিধিমালায় অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকবেন। এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক নির্বাচনে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশ ব্যাংক থাকলেও নতুন নীতিমালায় এসব দায়িত্ব গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও নির্বাচনে বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করলেও সংশোধনীতে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকতা জানান, গ্রামীণ ব্যাংকে সর্বশেষ পরিচালক নির্বাচন হয়েছিল ২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি। তাদের মেয়াদ ছিল তিন বছর, যা ২০১৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়। তবে ২০১৪ সালে জারি করা বিধিমালায় পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি; বরং আড়াই বছর ধরে আনুষ্ঠানিক বোর্ড সভা হয়নি গ্রামীণ ব্যাংকে।
কর্মকর্তা জানান, এসবের পরিপ্রেক্ষিতে গত মাসের প্রথম দিকে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বাসায় একটি বৈঠক করেন প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন ও আর্থিক বিভাগের কর্মকর্তারা। তখন গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থমন্ত্রীর কাছে আইনের কিছু সংশোধনী চেয়ে একটি প্রস্তাবনা পেশ করেন। তাদের প্রস্তাবনার পরিপ্রেক্ষিতেই গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি খসড়া তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। খুব শিগগির মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে খসড়াটি চূড়ান্ত করবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
গ্রামীণ ব্যাংক (পরিচালক নির্বাচন) বিধিমালা-২০১৪ সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পরিচালক নির্বাচনের জন্য যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে, তাতে সরকার কর্তৃক রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে (ডিএমডি) প্রধান নির্বাচন কমিশনার, মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) একজন পরিচালক ও চেয়ারম্যান মনোনীত গ্রামীণ ব্যাংকের একজন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করবেন।
বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের এক ডিএমডি ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) একজন ডিএমডিকে কমিশনার করার কথা রয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক চেয়ারম্যানের প্রস্তাব হলো, গ্রামীণ ব্যাংকের একজন জিএম প্রধান নির্বাচন কমিশনার হবেন। আর একজন ডিজিএম কমিশনারের দায়িত্ব পালন করবেন।
বিধিমালা সংশোধন অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে আঞ্চলিক প্রতিনিধি নির্বাচন ও পরিচালক নির্বাচন পদ্ধতি সংশোধনের কথা বলা নেই। ফলে বিধিমালায় সংশোধন আনা হলেও সদস্যদের সরাসরি ভোটেই পরিচালক নির্বাচন হবে। বিদ্যমান বিধিমালায় পরিচালক নির্বাচনসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব ও এখতিয়ার নিশ্চিত করা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রস্তাবনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওইসব এখতিয়ার বিলুপ্ত করার কথা বলা হয়। আর তাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, বিধিমালা সংশোধন করে এসব বিষয়ে গ্রামীণ ব্যাংককে ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়। সেসব প্রস্তাব গ্রহণ করে বিধিমালা সংশোধনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
বিধিমালার ৭ (১) ধারায় বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তাদের পরিচালক নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগের বিধান রয়েছে। এখন গ্রামীণ ব্যাংক কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগের বিধান প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। ৭ (২) ধারা অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন ওই এলাকা বা প্রয়োজনে কাছের কোনো এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন তফসিলভুক্ত ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করবে। এ ব্যবস্থায় সংশোধন এনে বলা হচ্ছে, ‘নির্বাচন কাজে সহায়তা করিবার জন্য নির্বাচন কমিশন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্য হইতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করিবেন।’ অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারাই সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন।
বিদ্যমান বিধিমালার ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘রিটার্নিং অফিসার নিজ নিজ এখতিয়ারাধীন প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন তফসিল ব্যাংকের কর্মকর্তাগণের মধ্য হইতে একজন কর্মকর্তাকে প্রিজাইডিং অফিসার এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ করিবেন।’ খসড়ায় সংশোধনের প্রস্তাবে এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘রিটার্নিং অফিসার নিজ নিজ এখতিয়ারাধীন প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন পরিচালনার জন্য ব্যাংকের কর্মকর্তাগণের মধ্য হইতে একজন করিয়া কর্মকর্তাকে প্রিজাইডিং অফিসার এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ করিবেন।’
গ্রামীণ ব্যাংক (পরিচালক নির্বাচন) বিধিমালার ৩০ ধারায় ‘অসুবিধা দূরীকরণে’ বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বাতিল করে গ্রামীণ ব্যাংককে দেওয়া হচ্ছে সংশোধনের মাধ্যমে। বিদ্যমান বিধিমালায় বলা হয়েছে, ‘এই বিধির বিধানাবলী কার্যকর করিবার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে অবহিত রেখে উক্ত অসুবিধা দূরীকরণার্থে, প্রকাশিত আদেশ/প্রজ্ঞাপন দ্বারা, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।’ এই ধারায় সংশোধনের খসড়া থেকে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ বাদ দিয়ে শুধু ‘ব্যাংক’ শব্দটি যুক্ত করা হচ্ছে। এর ফলে পরিচালক নির্বাচন বিধিমালা কার্যকরে কোনো অসুবিধা হলে গ্রামীণ ব্যাংক নিজেই সরকারকে অবহিত করে তা দূর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।