ভুল নিবন্ধনে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত ‘ঝুঁকিপূর্ণ’
রাখাইনে মিয়ানমার সেনা বাহিনীর নির্যাতনের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার আশ্রয়ের সঙ্গে তাদের খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করছে। একই সঙ্গে অনুপ্রবেশ করে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের আওতায় এনেছে সরকার। আর এই নিবন্ধনই তাদের ভবিষ্যত জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রোহিঙ্গাদের এক প্রতিনিধি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরতের বিষয়ে এক প্রস্তাবের বিষয়ে ঐক্যমত হয়েছে। এর মধ্যেই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি ও আইটি বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ আইউব। খবর: আনাদুল এজেন্সির।
তিনি বলেন, নিবন্ধনের সময় ব্যক্তিগত তথ্যে কোনো ধরনের ভুল হলে রাখাইনে ফেরত যাওয়ার ক্ষেত্রে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গার জীবনে মারাত্মক দুর্বিপাক ও কৌশলগত বিপর্যয় ডেকে আনবে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে রাখাইনে সেনা নির্যাতনের মুখে নতুন করে ৫ লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের সেনা বাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা রাখাইনে নারী-শিশু ও পুরুষদের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, রাখাইনে ৩ হাজারের মতো রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। মুহাম্মদ আইউব রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, খাদ্যসহ সম্ভাব্য সহায়তা ও অস্থায়ী নিবন্ধনপত্র দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
১৯৯০ সাল থেকেই বাংলাদেশে ৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে রেখে বাংলাদেশ সহায়তা করে আসছে। এরপর নতুন করে রোহিঙ্গা আসা শুরু করলে গত ১১ সেপ্টেম্বর সরকার নিবন্ধনের মাধ্যমে তাদের বায়োমেট্রিক কার্ড দিচ্ছে।
মুহাম্মদ আইউবের আশঙ্কা, এই বায়োমেট্রিক কার্ডই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরতের প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি করবে। তিনি অভিযোগ করেন, রোহিঙ্গাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ এবং সেগুলো অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বেশ কিছু ত্রুটি হচ্ছে।
মুহাম্মদ আইউব বলেন, ‘ঠিকানার যে ফরমেটে রোহিঙ্গাদের ব্যক্তিগত তথ্য নথিভুক্ত করা হচ্ছে, তা মিয়ানমারের উপযোগী নয়। ঠিকানার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সাধারণতঃ নাম, গ্রামের নাম, ডাকঘর, থানা ও জেলা- এই ফরমেট ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, মিয়ানমার ব্যবহার করে এভাবে- নাম, গ্রাম/ওয়ার্ডের নাম, গ্রামের সড়ক নং, পৌরসভা, জেলা।
তার মতে, সঠিক ব্যক্তিগত বিস্তারিত তথ্য নিবন্ধন কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় এসব তথ্য পালিয়ে আসা লাখো রোহিঙ্গার একমাত্র নথি। বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় মিয়ানমার সরকারের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, তারা শুধুমাত্র ‘ভেরিফাইড’ রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরার অনুমতি দিবেন। যদিও ভেরিফিকেশন এবং ফেরতের প্রক্রিয়া ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনের মধ্যে বড় ধরনের আলোচনায় বিষয় হিসেবে ঝুলন্ত রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের যে নিবন্ধন কার্ড দিয়েছে, তাতে দেওয়া পরিচয় তাদের প্রকৃত ঠিকানার সঙ্গে মিল নেই।
রোহিঙ্গাদের এই প্রতিনিধির ভাষ্যে, এটি হচ্ছে কারণ, যেসব স্বেচ্ছাসেবক নিবন্ধন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তারা বাঙালি এবং মিয়ানমারের অফিশিয়াল পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তিনি এও বলেন, ‘ব্যক্তিগত তথ্যে এই ধরনের ভুলভাল বর্ণনা অহেতুক হয়রানি, বিলম্ব এবং ফেরতের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করবে।
মুহাম্মদ আইউব বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ অজুহাত দাঁড় করানোর সুযোগ পাবে। তারা বলবে, এসব লোক যদি সত্যিই মিয়ানমারের বাসিন্দা হতেন, তাহলে ঠিকানার ক্ষেত্রে নিজ দেশের কাঠামো অনুসরণ করে তথ্য দিতেন। তারা তো আগে কখনও এর ব্যতয় ঘটাননি।
তবে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এক বাংলাদেশি কর্মকর্তা এটিকে ‘ছোট ভুল’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এও দাবি করেন, সর্বোচ্চ সতর্ক দিয়েই তারা নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন।
উল্লেখ্য, গত ২৪ আগস্ট মধ্যরাতের পর রাখাইনের অন্তত ৩০টি পুলিশ চৌকি ও একটি সেনা ক্যাম্পে আরসা’র যোদ্ধারা প্রবেশের চেষ্টা করে। পরে জঙ্গি দমনের নামে নতুন করে অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সেনা অভিযান শুরুর পর এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ জানিয়েছে, ৫ লাখ ১৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ অভিযানে ৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নিহতের খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। যদিও মিয়ানমার সরকারের দাবি, নিহতের এ সংখ্যা ৪শ’।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘ। একই সঙ্গে সংস্থাটি রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী বলে উল্লেখ করেছে।
মূলত ২০১২ সাল থেকে রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনা বাহিনীর নির্যাতন বেড়েছে। গত বছরের অক্টোবরে রাখাইনের মংডুতে এমনই এক সেনা অভিযান ও স্থানীয় উগ্র বৌদ্ধদের হাতে ৪০০ রোহিঙ্গা নিহত হন।
এরপর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ঘটনার তদন্ত করে গত ২৩ আগস্ট প্রতিবেদন জমা দেয়। এর পরপরই ফের হত্যাযজ্ঞ শুরু করে মিয়ানমারের সেনা বাহিনী।