• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

মহাপ্রাণ মহেশ ভট্টাচার্য

হাসান আলী

প্রকাশ:  ৩০ জুন ২০১৯, ০৮:৫৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ১২৬৫ সনের ১৭ অগ্রহায়ণ বুধবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিটঘর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ঈশ^র দাস তর্কসিদ্ধান্ত খ্যাতিমান প-িত ছিলেন। মাতা রামমালা দেবী ছিলেন সত্যনিষ্ঠ মহীয়সী নারী। ছয় বছর বয়সে যখন বাবা মারা যায় তখন থেকে দরিদ্রদশা আরম্ভ হয়। পাঁচ বছর বয়সে হাতেখড়ি হলেও নয়-দশ বছর পর্যন্ত তাঁর লেখাপড়া হয়নি। টোলে পড়া তাঁর মনঃপুত হয়নি, তাই স্কুলে পড়ার জন্যে আকুল হয়ে উঠলেন। দুঃখ-দুর্দশাকে উপেক্ষা করে কুমিল্লা জেলা স্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। সে সময় অর্থোপার্জনের তীব্র বাসনা তাঁকে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করে। বিশ বছর বয়সে একাকী নিঃসহায় অবস্থায় ভাগ্যান্বষণে কোলকাতায় উপস্থিত হলেন। সেখানে একটি দোকানে সর্বনিম্ন কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছেন। ঘর ঝাড় দেয়া থেকে শুরু করে মালিকের তামাক পর্যন্ত সাজিয়েছেন। মহেশ চন্দ্র একেবারে নিঃস্ব অবস্থা থেকে কঠোর পরিশ্রম করে ওষুধ ব্যবসায় প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন। অর্জিত মুনাফা ভোগ-বিলাসের পরিবর্তে গরীব মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেন। সুলভ মূল্যে হোমিওপ্যাথি ওষুধ ভারত বর্ষের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাত্রাবাস, ছাত্রী নিবাস, গ্রন্থাগার, দাতব্য চিকিৎসালয়, ধর্মশালা নির্মাণ করেন। জনগণের ভোগান্তি কমানোর জন্যে রাস্তাঘাট নির্মাণ, লোহার পুল তৈরি, পুকুর-দিঘি খনন করেন। তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার গরীব ও অবিবাহিত ছাত্রদিগকে বৃত্তি ও ছাত্রঋণ দিয়েছেন। কিন্তু অন্যান্য জেলার কেউ আবেদন করলে দিতেন না। মহেশ চন্দ্রের মতো অনেকেই শূন্য হাতে নেমে পরবর্তীকালে কোটিপতি হয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কেন প্রবীণ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক সেটাই আলোচনা করছি।
মহেশ চন্দ্র ছিয়াশি বছর বয়স পর্যন্ত মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। বয়সের অজুহাতে বসে থাকেন নি। তিনি প্রাণ ও প্রকৃতি কে ভালোবাসতেন। মানুষের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-কষ্টকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। রামমালা ছাত্রবাসের পুকুরে অনেক মাছ পুষতেন। এসব মাছ খাওয়া নিষেধ ছিল। তিনি নিজের হাতে এঁদের খাবার দিতেন। ছাত্রাবাস এলাকায় প্রত্যেক দিন কাক, শালিক, পায়রাগুলোকে পর্যাপ্ত খাবার দিতেন। তিনি প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছেন, কিন্তু বিলাসী জীবনযাপন করেন নি। সাধারণ কাপড় চোপড় পরতেন এবং সাধারণ বিছানায় ঘুমাতেন। ছাত্রাবাসে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক পরিশ্রম কে অনেক গুরুত্ব দিয়ে দেখা হতো।  ছাত্র-ছাত্রীরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, রান্না বান্না, দৈনন্দিন কাজ কর্ম নিজের হাতে করতো। ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে বলেন, পিতামাতার মত নিয়ে দেশের কাজ করা ভাল কথা। অভাবগ্রস্ত পিতামাতার ভরণ পোষণ না করে তাঁদের অবাধ্য হয়ে দেশের উপকার করা ন্যায় কাজ হতে পারে না। ছাত্ররা ছাত্রাবস্থাতেই দেশের ভাবনা ভাবতে শিখুক, দেশের প্রকৃত অবস্থা জানুক এবং নিজের জীবন কে দেশ সেবার উপযোগী করে গঠন করুক এই উদ্দেশ্যে রামমালা ছাত্রাবাস গড়ে তোলেন। কিভাবে নেতাকে প্রকৃত সম্মান করতে হয় সে বিষয়ে তিনি লেখেন, যাঁরা রাত তিনটের সময় জেগে দু মাইল হেঁটে স্টেশনে যেয়ে মহাত্মা গান্ধীকে দর্শন করেন, তাঁদের অপেক্ষা যাঁরা ঘরে বসে তাঁর উপদেশ অনুসারে কাজ করেন তাঁরাই অধিক সম্মানীয়। তবে আন্তরিক শ্রদ্ধা বলতে মহাপুরুষ বা ঈশ্বরের বিশেষ বিকাশ জ্ঞানে যারা দেখতে যান তাঁদের কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা খুব কম। মহেশ চন্দ্র 'সাধিয়া সোহাগ, যাচিয়া মান'কে ঘৃণা করতেন। বলতেন, স্বার্থ না থাকলে বড় লোকের সাথে যত কম দেখা করা যায় ততই ভাল। মহেশ চন্দ্র নিজের আয়ের অর্ধেক অংশ কয়েক লক্ষ টাকা নিয়মিতভাবে বছরের পর বছর দান করে গেছেন। তিনি দান কার্য খুবই গোপনীয়তার সাথে করতেন। একবার পত্রিকায় দানের সংবাদ প্রকাশ পেলে তিনি খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন।  তাঁর লেখা 'দান বিধি'বইতে লেখেন, দান করে প্রশংসাপত্র বা উপাধি নিলে বা যশ-আকাক্সক্ষা করলে পুণ্যফল কতক পরিমাণ নষ্ট হয়। কারণ দানের বিনিময়ে এটা নেয়া হয় অর্থাৎ দানকার্যটি প্রশংসাপত্র বা উপাধি নিয়ে বিক্রি করা হয়। সুতরাং বিক্রিত দ্রব্যের উপর দাতার স্বামীত্ব থাকে না। তখন দাতা বিক্রেতা হয়ে পড়েন । কেউ সাক্ষাতে প্রশংসা করলে তা নিজে আগ্রহের সাথে  শুনলে তাতে পুণ্য কমে যায়। কাজেই প্রশংসাকারীকে চাটুকারী ও শত্রুর ন্যায় মনে করতে হয়। গুপ্ত দানং মহা পুণ্যম। ব্যবসায় যতই নাম প্রচার করা হয় ততই গ্রাহক বৃদ্ধি হয়। কিন্তু সাধু কার্যে যতই নাম প্রচার হয় ততই পুণ্য কমতে থাকে, কারণ অহংকার জন্মে। মহেশ চন্দ্র মৃত্যুর দশ-এগারো বছর পূর্বে কসবা বাজারের নিকটবর্তী বিজনি নদীর উপর অনেক টাকা খরচ করে লোহার পুল তৈরি করে দেন। পূর্বে এখানে গুদারা ছিল, লোকজনের যাতায়াতে অনেক অসুবিধা হতো। শেষবার যখন তিনি নিজ গ্রাম বিট ঘরে আসেন তখন এক ব্যক্তি প্রস্তাব করেন যে, বিজনি পুল কে করেছেন তা অনেকেই জানেন না। একখানা মার্বেল পাথরে নাম খোদাই করে পুল স্থাপন করলে সর্বসাধারণ অবগত হতে পারবে। মহেশ চন্দ্র বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘দেখ  এখানে সবাই তো পড়তে জানে না সুতরাং পাথরে নাম খোদাই করে বসালে কী হবে? তার চাইতে  কয়েক জন ঢুলি রাখলেই হবে, দিবা রাত্রি ঢোল বাজিয়ে সকলকে জানিয়ে দিবে মহেশ চন্দ্র এই পুলটা করেছেন,মহেশ চন্দ্র এই পুলটা নির্মাণ করেছেন ইত্যাদি। কী বল?’
মহেশ ভট্টাচার্য জগতে সর্বদাই দাতার আসনে ছিলেন। ভালবাসা, সাহায্য, সেবা যা কিছু দেবার ছিল নিঃশেষে দিয়েছেন। বিনিময়ে কারো নিকট থেকে নিজের জন্যে কিছু চান নি। তিনি মৃত্যুর দুই বছর পূর্বে  প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের পরিচালককে নিম্নলিখিত নির্দেশ দেন, ‘‘আমার কোনো প্রতিষ্ঠানে বা আমার কোনো বাড়িতে বা আমার প্রতিষ্ঠানের বা বাড়ির কোনো লোক দ্বারা  বাইরে অন্যত্র কোথায়ও আমার মৃত্যুর পর আমার জন্যে যেন কোনো শোকসভা না করা হয়। তবে যাঁরা আমার সদগতির জন্য নীরবে প্রার্থনা করেন-এই আমার আকাক্সক্ষা। এই বিষয়ে আপনাদের জানিয়ে রাখলাম।" মহেশ চন্দ্র অতি প্রবীণ হয়েও সর্বদা মানুষের সেবা করেছেন, কল্যাণ করেছেন। ১৩৫০ সনের ২৭ পৌষ ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবনী থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
লেখক : প্রবীণ বিশেষজ্ঞ ও লেখক।

 

সর্বাধিক পঠিত