বাংলা সাহিত্যে নূরন্নেছা খাতুন
আব্দুর রাজ্জাক
‘মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙ্গে ফেল ও শিকল!/যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ, দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ যত আভরণ!’
নারীর প্রতি কবির এ উদাত্ত আহ্বান আর সমাজের নানা কুসংস্কার, শিক্ষার স্বল্পতা থেকে অনুমান করা যায় যে, বাংলার মুসলিম সমাজে নারীর চলার পথ কতোটা অমসৃণ ছিল। মুক্ত বুদ্ধির চর্চা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীর জীবনে এক আতঙ্কের নাম। সেখানে নারীর সাহিত্য চর্চা ছিল কল্পনা ও স্বপ্নবিলাস মাত্র। বাংলার মুসলিম সমাজে উচ্চ শিক্ষিত মানুষ ছিল না এমন কিন্তু নয়Ñযারা ছিলেন তাদের খুব কমই সাহিত্য চর্চা ও সাহিত্যের প্রতি যুক্ত ছিলেন। এমন কঠোর অবরোধ প্রথা ও নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও কোনো কোনো অভিজাত পরিবারের দুই একজন নারী অদম্য সাহস নিয়ে জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে ছিলেন। সমাজকে আলোকিত করে গেছেন নিজ গুণে। বাংলা ভাষার প্রতি অপরিসীম মমত্ববোধ, বাংলা শেখার আগ্রহ ও সমাজব্যবস্থায় নারীর অব¯ান তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে তারা সাহিত্যক্ষেত্রে নিজ নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতেও সক্ষম হয়েছেন। এমন চরম বিদঘুটে অন্ধকার যুগে সাহিত্য জগতে বাংলার মুসলিম সমাজের নারীদের জন্যে নূরন্নেছা খাতুনের আবির্ভাব এক বিস্ময়।
এই মহীয়সী নারী ১৮৯৪ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নূরন্নেছা খাতুন যে সমাজব্যবস্থায় জন্মগ্রহ করেন সে সমাজে এ সকল পরিবারের মেয়েদের স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা, এমন কি ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে থেকেও বাংলা ভাষা চর্চা ও শেখা ছিল নিষিদ্ধ। সেই অন্ধকার থেকে যারা আলো জ্বালিয়ে ছিল, অবরোধ প্রথা যারা ভেঙ্গে নতুন সূর্য এনেছিলো তাদের অধিকাংশ নারীই অবরোধবাসের কাহিনী লেখায় বর্ণনা করেছেন। নূরন্নেছা খাতুন ছিলেন প্রসিদ্ধ খোন্দকার বংশের মেয়ে। এ পরিবারে অবরোধ প্রথা কঠোরভাবে পালন করা হতো। নূরন্নেছা খাতুন তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে শৈশবের এ অবরোধ প্রথার কথা উল্লেখ করেছেন বিশদভাবে। নূরন্নেছা খাতুন ভাইয়ের বা অপরের সহায়তায় নিজে নিজেই বাংলা ভাষা শিখেছেন পরে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। বাংলা ভাষার প্রতি ছিল তাঁর অগাধ টান ও ভালোবাসা।
নূরন্নেছা খাতুনের দাম্পত্য জীবন শুরু হয় বারাসাত মহকুমার আনোয়ারপুর কাজী পাড়ার কাজী গোলাম মোহাম্মদের সঙ্গে। জীবন সঙ্গীর উৎসাহে নূরন্নেছা খাতুন বই পড়া ও সাহিত্য চর্চার আরো সুযোগ লাভ করেন। সাহিত্য চর্চায় তিনি বেশি রকম আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁর লেখা নিয়ে পরিরারে প্রশংসামূলক আলোচনা হতে থাকে। তিনি স্বামীর সাথে হুগলী জেলার শ্রীরামপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। এখানে স্বামীর প্রেরণায় তাঁর সাহিত্যের পরিপূর্ণবিকাশ ঘটে। তিনি প্রথম উপন্যাস লেখায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস, ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’। এ উপন্যাসটি পাঠ করে তাঁর আত্মীয়স্বজন ও সাহিত্য অনুরাগীরা বিস্মিত হয়েছেন।তাঁর স্বামীর প্রেরণা ও উৎসাহে উপন্যাসটি মুদ্রিত হয়। প্রথম উপন্যাসের সাফল্য অর্জনের ফলে তিনি আত্মদান, বিধিলিপি ও নিয়তিÑএরকম কয়টি উপন্যাস লিখেন। নূরন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনীকে আলোর পথ দেখিয়ে আরো উজ্জীবিত এবং তাঁর প্রতিভা বিকাশে ভূমিকা পালন করেন তখনকার মুসলিম সমাজের মননশীল চিন্তার কারিগর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। এক অন্ধকার যুগে একজন নারী ঔপন্যাসিকের চিন্তা চেতনা বিকাশে সওগাত পত্রিকার ভূমিকা যুগযুগ ধরে ইতিহাস বিখ্যাত হয়ে থাকবে।
(১৩৩৬) সালের সওগাতের আষাঢ় সংখ্যায়, ‘নূরন্নেছা গ্রন্থাবলী’র বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। মোট ছয়টি উপন্যাস নিয়ে এ গ্রন্থাবলী : স্বপ্নদ্রষ্টা, জানাকী বাঈ (ভারতে মোসলেম বীরত্ব), আত্মদান, ভাগ্যচক্র, বিধিলিপি ও নিয়তি। এ বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর থেকেই সাহিত্য সংস্কৃতিমনা মানুষ বড় পরিসরে জানতে পারে তাঁর সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। নূরন্নেছা খাতুনের সময় সাহিত্য চর্চা ও পুরুষ ঔপন্যাসিকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা কয়জন সে ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বাংলার মুসলিম সমাজের নারী ঔপন্যাসিকের মধ্যে পরিচিত নাম। তাঁর আগে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য মুসলিম নারী সাহিত্য চর্চায় এগিয়ে আসেনি। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধ উল্লেখ করা হয়Ñ‘এর পূর্বে বাঙালি মুসলমান মহিলাদের কোনো গ্রন্থাবলী প্রকাশিত হয়নি। যে যুগে মুসলমান সমাজে পুরুষ ঔপন্যাসিকের সংখ্যাই নগণ্য ছিল, সেই অরুণোদয় মুহূর্তে নূরন্নেছা খাতুনের যুগান্তকারী অবদান নিয়ে আসেন। তৎকালীন সমাজ ও পরিবার-জীবনের চিত্র গভীর অনুভূতির সাথে তাঁর লেখায় বিধৃত হয়। তাঁর লেখার শৈলী ও কল্পনাশক্তি আলাদা বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভঙ্গিতে সমাজের সমকালীন বিষয়াদি তাঁর উপন্যাসের উপজীব্য করে তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে নূরন্নেছা খাতুন সম্পর্কে ১৩৩৩ সালে সওগাতের ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বঙ্গ সাহিত্যে মুসলমান মহিলা’ শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়, ‘যে কয়জন মুষ্টিমেয় মুসলমান লেখক উপন্যাস রচনা করিয়া প্রসিদ্ধ লাভ করিয়াছেন, নূরন্নেছা খাতুন তাঁহাদের মধ্যে একটা শ্রেষ্ঠ আসন পাইবার যোগ্য। তাঁহার উপন্যাগুলি পাঠ করিলে তাঁহার লিপিচাতুর্য ও কল্পনাশক্তির সুন্দর পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁহার লেখা বেশ সরল, প্রাঞ্জল ও উপন্যাসোচিত। আশা ও আনন্দের বিষয় এই যে, নূরন্নেছা খাতুনের লেখনী এখানেই বিশ্রাম লাভ করে নাই। তিনি আরো গ্রন্থ রচনায় আত্মনিয়োগ করিয়াছেন, ‘নূরন্নেছা খাতুনের উপন্যাস লেখার খবর ছড়িয়ে পড়লে ‘নিখিল ভারত সাহিত্য সঙ্ঘ’ তাঁকে ‘বিদ্যাবিনোদিনী’ ও ‘সাহিত্য সরস্বতী’ উপাধি প্রদান করে যথাযথ সম্মান প্রদান করেন। ১৯৩১ সালে মুন্সীগঞ্জে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের ষোড়শ অধিবেশন হয়, সে অধিবেশনে নূরন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনীর ‘বঙ্গ সাহিত্য মুসলমান’ শীর্ষক প্রবন্ধটি নির্বাচিত প্রবন্ধসমূহের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। সম্মেলনের সভাপতি নাটোরের মহারাজ জগদিন্দ্রনাথ রায় লেখিকার প্রবন্ধ পাঠ করে যে উক্তি করেছিলেন তার মূল বিষয় ছিল সাহিত্যের অগ্রগতি ও সাহিত্যসেবীর মধ্যে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তৈরি আর এ অগ্রযাত্রায় নারীদের এগিয়ে আসা। বাংলার মুসলিম বাঙালি হয়েও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি নারী পুরুষের যে অবহেলা তাতে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন, ‘যদি তারা মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় তবে এর চেয়ে সুখের আর কি থাকে। রাজা আরো বলেন, ‘তিনি বলিয়াছেন, আমাদের মুসলমান ভ্রাতৃত্ব বৃন্দের জননী-জায়া-দুহিতাগণের মনে বঙ্গবাণীর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা-ভক্তি যদি উচ্ছ্বাসিত হইয়া উঠিতে থাকে, তবে তাহা অচিরেই কি কল্যাণকে যে আমাদের করায়ত্ত করিয়া দিবে, তাহা একমুখে বলিয়া শেষ করা যায় না। নূরন্নেছা খাতুন সত্য প্রকাশে ও মুসলিম সমাজে মানুষের অজ্ঞাতার বিচার বিশ্লেষণ করেছেন সঠিক মাপকাঠিতে।
১৩৩৩ সালের সওগাতের মাঘ সংখ্যায় বঙ্গীয় মোসলেম মহিলা সঙ্ঘের বার্ষিক সম্মেলনের সভানেত্রীরূপে নূরন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনীর অভিভাষণ ছাপা হয়। যে যুগে মুসলমান নারীদের স্বাধীনভাবে কিছু করার, কিছু বলার কোনো অধিকার ছিল না সে যুগেও একটি মোসলেম মহিলা সম্মেলনের সভানেত্রীরূপে সাহসিকতাপূর্ণ অভিভাষণ দিয়েছিলেন তা নারীর সামাজিক অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম ধাপ। তাঁর এ অভিভাষণে তখনকার সময়ের অবরোধ প্রথা, সাহিত্য চর্চার অপ্রতুলতা, সাহিত্যে পুরুষদের চেয়ে নারীদের পিছিয়ে থাকা এবং নানা সময়ে পরিবেশ ও পরিস্থিতি, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা যা জীবনের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে সে বাধাগুলো সরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াই প্রধান কাজ বলে তিনি গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ‘এজন্য মনোবল প্রয়োজন যা নিজের মধ্যে থাকতে হয়। জ্ঞান বিজ্ঞানের আলো জ্বেলে নিজের ও সমাজের জন্যে মঙ্গল বয়ে আনতে হবে। নূরন্নেছা খাতুন আরো বলেন, ‘আমরা হচ্ছি পর্দানশীন মোসলেম রমণী। সাহিত্যগত আমাদের পুরুষদেরই একটু দাঁড়াইবার স্থান মেলে না, তা আমরা ত কোন দূরে পড়ে আছি। দূর চিরদিনই দূর থাকে না সাধনায় তা নিকট হয়ে আসেই আসে। পুঙ্গ হয়ে, শুধু বেঁচে থাকলে আমাদের আর চলবে না।’ সে সময় নারী শিক্ষার অভাবে সমাজের সামগ্রিক উন্নীত ব্যাহত হয়েছে যার প্রভাব পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনে চরমভাবে প্রভাবিত করেছে। এ জন্যে বাংলার মুসলিম সমাজের নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। নারীর স্বাধীনতা ও নারীর অধিকার সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে সচেতন করার জন্যে তাঁর মতো এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান। সওগাতের সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বলেন, ‘নূরন্নেছা খাতুনের পূর্বে বাংলার মুসলিম সমাজের আর কোনো লেখিকা মহিলাদের সম্মেলনে সভানেত্রিত্ব করেননি বা ভাষণ দেন নি তাই নারীর স্বাধীনতা বিরোধী পত্রপত্রিকাগুলি এ অভিভাষণটি ছাপেনি কেবল সওগাতে নূরন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী নামে এই ভাষণটি ছাপা হলে তখকার সময়ের আমাদের শিক্ষিত প্রগতিবাদী দল এই মহিলা ও তাঁর রচনা সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেন ‘তখকার সময়ে মুসলিম মেয়েদের ছবি পত্রপত্রিকা ছাপা গুনাহের কাজ বলে প্রচার করা হতো। সওগাতে মেয়েদের ছবি ছাপা হলে সম্পাদকের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রচার করা হয়। এ বিষয় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বলেন, ‘সওগাতে মেয়েদের ছবি ছাপা হয় এজন্যে আমাদের গোঁড়া রক্ষণশীল দল যখন আমার নিন্দা প্রচার করছিলেন, সে সময় আমি সংকল্প গ্রহণ করলামÑকেবলমাত্র মুসলমান মহিলাদের লেখা ও ছবিসহ বিশেষ ‘মহিলা সওগাত’ প্রকাশ করবো। ১৩৩৬ সালের ভাদ্র মাসে প্রথম ‘মহিলা সওগাত’ বের হয় কিন্তু তা প্রকাশ করতে গিয়ে আমি নানা অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। প্রথমত আমাদের মুসলমান লেখিকার সংখ্যা নগণ্য তার উপর সমাজের ভয়ে অনেকই ছবি দিতে দ্বিধাবোধ করছিলেন। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন নূরন্নেছা খাতুনের প্রতিভার পরিচয় আগেই পেয়েছিলেন। সে কারণে মহিলা সংখ্যায় তাঁর লেখা পাবার আশায় কলকাতা থেকে শ্রীরামপুর গিয়ে বাড়িতে হাজির হলেন। সে কালে কোনো অপরিচিত অনাত্মীয় পুরুষের সামনে মেয়েরা আসতেন না। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ভেবেছিলেন নূরন্নেছা খাতুন বাড়ির কোনো লোক মারফতে তাঁর কথার জবাব দিবেন। কিন্তু তিনি সহজ সরলভাবে তাঁর সম্মুখে এসে বসলেন এবং তাঁর আগমনকে অভিনন্দিত করলেন। নারী জাগরণ অভিযানের জন্যে সওগাতের খুব প্রশংসা করলেন। মহিলা সওগাত বের করবো শুনে আনন্দে উল্লাসিত হয়ে উঠলেন এবং বললেন, আপনি তাহলে আমাদের নারী সমাজের এক মহা উপকার সাধন করবেন। আসন্ন সংখ্যার জন্যে তাঁর লেখা চাইলেন নাসিরউদ্দীন। তিনি বললেন, ‘আমি ত উপন্যাস লিখি। গল্প, প্রবন্ধ লিখি না। তবে আপনার এ শুভ প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করবো। একটা প্রবন্ধ লিখে দুই একদিনের মধ্যেই পাঠিয়ে দেব। আমার দুই মেয়ে বদরুন্নেসা আর কামরুন্নেসাও লিখতে আরম্ভ করেছে। তাদের লেখাও ঐ সঙ্গে পাঠিয়ে দেব।’ এরপর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন নূরন্নেছার ছবি দেবার অনুরোধ জানালে তিনি প্রথমত ইতস্তত করলেন। নূরন্নেছা তাঁর অনুরোধ রাখলেন। নিজের এবং দুই মেয়ের ছবি মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে দিয়ে দিলেন। একই পরিবারের তিনজনের ছবি পেয়ে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন আনন্দিত হলেন। নূরন্নেছা খাতুন তাকে যথেষ্ট সমাদর করলেন এবং না খাইয়ে ছাড়লেন না। মহিলা সওগাতের জন্যে প্রতিশ্রুতি মতে তিনি তিনটি লেখাই পাঠিয়ে ছিলেন। তাঁর নিজের লেখা প্রবন্ধ ‘আমাদের কাজ’, বদরুন্নের গল্প, ‘রেখা’, কামরুন্নেছার প্রবন্ধ ‘স্ত্রীর শিক্ষা’ এ কয়টি লেখা ও তাঁদের ছবি প্রথম মহিলা সংখ্যা সওগাতে ছাপা হয়েছিল।’
সমাজব্যবস্থার উন্নতি সাধনে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ভাষার চর্চা একান্ত প্রয়োজন। দেশ ও সমাজের প্রতি মানুষের দায়িত্ববোধ পালন করতে হলে জ্ঞান চর্চার বিকল্প নেই আর একটি জাতীর সাহিত্যে সংস্কৃতিতে লুকিয়ে থাকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এ ক্ষেত্রে নারী সমাজ পিছিয়ে থাকলে চলবে না। নূরন্নেসা খাতুন তাঁর ‘আমাদের কাজ’ প্রবন্ধ এ কথা বলতে চেয়েছেন। বাঙ্গালি যে ভীরু, বাঙালি বলে পরিচয় দিতে সংকোচবোধ করে আজ সে থেকে বের হতে হবে। তিনি লিখেন, জাতীয় জীবনকে গড়ে তুলবার একমাত্র উপায় হচ্ছে জ্ঞানচর্চা। আমাদের এই পথ অবলম্বন করতে হবে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন নূরন্নেছার লেখায় বিস্ময়াভিভূত হয় তিনি বলেন, ‘সেই অন্ধকার যুগে মহিলা সওগাতে নূরন্নেছা খাতুনের ‘আমাদের কাজ’ এই স্বাধীনচিন্তাসুলভ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে এর প্রতি শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি যথেষ্ট আকৃষ্ট হয় এবং তাঁর সাহসিকতাপূর্ণ উক্তির জন্যে প্রগতিপন্থীরা তাঁর প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে।’
নূরন্নেছা খাতুনের উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা প্রসংগে মুহাম্মদ আব্দুল হাই সৈয়দ আলী আহসান রচিত ‘বাংলা সাহিত্যর ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বলা হয়েছেÑ‘সংসার ও সমাজজীবনে কিংবা পথ চলতে তিনি চোখ দিয়ে যা দেখেছেন, সাহিত্যর উপকরণ হিসেবে সে ছবি এবং সে অভিজ্ঞতা তাঁর জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে তাঁর মনে পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে। সাহিত্য রচনা কালে স্মৃতি বেশ আলোড়িত করে তাঁর অভিজ্ঞতার জবাব আপনা থেকে তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে আপনাকে বিকশিত করে তুলছে। অভিজ্ঞাতালদ্ধ গার্হস্থ্য জীবনের ছবি, জ্ঞানলদ্ধ তথ্য এবং ভূয়োদর্শনজাত অনুভূতির অভিব্যক্তই তাঁর সাহিত্যকে রঞ্জিত করেছে।’
দেশ বিভাগের পর নূরন্নেছা খাতুন সপরিবার ঢাকায় এসে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন। ১৯৬১ সালে তাঁর স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। বার্ধক্যের কারণে তিনি কাজকর্মে ও সাহিত্যে সক্রিয় ছিলেন না। বিদেশী সাহিত্যের অনুবাদ ও উপন্যাসে তাঁর আগ্রহ ছিল। বাংলা একাডেমি তাঁর সাহিত্যকর্ম ‘নূরন্নেছা গ্রন্থাবলী’ হিসেবে প্রকাশ করেছে। ১৯৭০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে বেগম ক্লাবে নূরন্নেছা খাতুনকে এক সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়।
মানপত্রের জবাবে নূরন্নেছা খাতুন বলেছিলেন, ‘যে যুগে কলম ধরেছিলাম, সে যুগের মেয়েরা ছিলেন অন্তরালবর্তিনী। সেই অবস্থার মধ্যেও যথাসম্ভব সাহিত্য চর্চা করেছি। পরবর্তীকালে সমাজের পট পরিবর্তন ঘটেছে অনেক। মানুষের মূল্যবোধও সে সঙ্গে হয়েছে পরিবর্তিত। তখন বৃহত্তর পৃথিবীর সাথে আমারও পরিচয় ঘটেছে। অনেক অদেখাকে দেখিছি, অজানাকে জেনেছি, কিন্তু সাহিত্যে তা ফুটিয়ে তোলার অবকাশ আর মেলেনি। আজকের সাহিত্য ভাল কি মন্দ তা নিয়ে তর্ক করতে চাই না। যুগ পরিবর্তিত হয়েছে সাহিত্যও নিশ্চয়ই আগের মতো নেই। তবে ভালো সাহিত্য বলতে একটা জিনিসই বুঝি যে তাতে জীবনের বিশ্বস্ত প্রতিফলন থাকবে।’
নূরন্নেছা খাতুন সারা জীবনই নারীদের সত্য, সুন্দর ও প্রগতির জন্যে উদাত্তকণ্ঠে আহবান জানিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যের লক্ষ্য ছিল উন্নতি ও সংস্কারমুখী। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বলেছেন, ‘১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৬৬ নং লয়ালস্ট্রীট, সওগাত অফিসে আমার সাথে নূরন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনীর শেষ দেখা। তাঁকে সেদিন খুবই উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। তিনি সেকালের কথা নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করেছিলেন।’
১৯৭৫ সালের ৬ এপ্রিল রোববার ঔপন্যাসিক নূরন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান। এ মহান সাহিত্যিক আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু এক অন্ধকারে যুগে সাহিত্য সাধনায় বাংলার মুসলিম নারীদের সম্মুখে তিনি যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা চিরদিন রবে অম্লান।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।