মাতোয়ালা রাইতই শুধু নয় মাতোয়ালা দিনও তাঁর
২৩ অক্টোবর বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন। কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁকে নিয়েই এবারের আয়োজন।
শীতের রাত। সম্ভবত ঝালকাঠি কিংবা পিরোজপুর যাচ্ছিলাম। লঞ্চের আলস্যময় একটা দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত তখন তিনটা-সাড়ে তিনটা। হঠাৎ চুড়ির ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে এল। খসখসে একটা শব্দও টের পাচ্ছি। আমি কেবিন থেকে বের হয়ে এলাম। আস্তে আস্তে বের হয়ে দেখি, শাড়ি পরে এক নারী রেলিং ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন। অবাক দৃষ্টি তাঁর চোখে। কাছে গিয়ে দেখি ভাবি—কবি শামসুর রাহমানের স্ত্রী। লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে ঘাটে। ঘাটের দিক থেকে নিয়নের আলো পড়েছে সামান্য—আলোছায়ার খেলায় পানি তিরতির করে কাঁপছে। কুয়াশা ছিল। সেই সঙ্গে জ্যোৎস্নাও। অপার্থিব এক পরিবেশ। আমি আরও কাছে গেলাম। আমাকে দেখেই ভাবি বলে উঠলেন, ‘দারিয়া কিতনা সুনদার।’ পরিষ্কার উর্দুতে বলেছিলেন কথাটা। সে সময় ঢাকার অনেকেই উর্দু বলতেন। ভাবির চোখে-মুখে তখনো বিস্ময়, কণ্ঠেও তা আছড়ে পড়েছিল। আমি কিছুটা চমকে গেলাম। বললাম, ‘হ্যাঁ, নদী আসলেই সুন্দর।’ আমার পেছন থেকে তখনই শোনা গেল শামসুর রাহমানের গলা, তিনিও জেগে আছেন। জেগে আছেন স্ত্রীর জন্য—স্ত্রী জেগে আছেন বলে। স্ত্রী রাতে একা নদী দেখছেন, এ জন্য হয়তো কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তাও ছিল তাঁর। রাহমান আমাকে বললেন, ‘আসাদ, ঘুমাননি?’ তারপর যেন ব্যাখ্যা দেওয়ার সুরেই বললেন, স্ত্রীর দিকে মুখ করে, ‘আপনার ভাবি এই প্রথম নদী দেখল।’
শামসুর রাহমানের এই এক অভ্যাস ছিল—দুশ্চিন্তা করা এবং চিন্তা করা। তিনি সবার জন্য চিন্তা করতেন। বাবরি মসজিদ ভাঙল যেবার, তার পরদিনই আমাকে ফোন দিলেন। দুপুরের পর তাঁর বাসায় যেতে বললেন। তাঁর কণ্ঠে স্পষ্ট উদ্বেগ। আমি তাড়াহুড়ো করে বের হলাম। কবির বাসায় গিয়ে দেখলাম নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা আগে থেকেই বসে আছেন। রাহমান ডেকেছেন তাঁদেরও। দেখলাম, চিন্তাক্লিষ্ট মুখে পায়চারি করছেন তিনি।
একটা কথা এখানে বলে নিই, কবিকে আমি নাম ধরে ডাকতাম। তিনিই চাইতেন। সম্ভবত নির্মলেন্দু গুণ আর মহাদেব সাহাই তাঁকে ভাই ডাকতেন, আর অন্যরা ডাকতেন নাম ধরে। তিনি চিরযৌবনা ছিলেন, এবং সেটা ছিল একদম সাবলীল, কৃত্রিমতার ছিটেফোঁটাও তাঁর মধ্যে ছিল না।
যা হোক, পুরোনো প্রসঙ্গে আসি। তাঁর বাসায় ঢুকতেই আমার উদ্দেশে রাহমান বললেন, ‘আসাদ, এই সাম্প্রদায়িক হুমকির বিরুদ্ধে কী করা যায়, বলেন তো?’ সেদিনের সেই অসহায় মুখ আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না। সে মুখ অকৃত্রিম ছিল। তাঁর ভেতরে যে অসাম্প্রদায়িকতা আমি দেখেছি, সেটা মোটেই কেতাবি ছিল না। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ, এবং সেটা নিষ্কলুষ।
দাউদ হায়দারের ঘটনাটা যখন ঘটল, গেলাম শামসুর রাহমানের কাছে। বললাম স্বাক্ষর দিতে। সামান্য দোনোমনা করেছিলেন, কিন্তু স্বাক্ষর তিনি দিয়েছিলেন ঠিকই। এ ব্যাপারে আল মাহমুদ আমাকে বিস্মিত করেছিলেন। তাঁকে ফোন করেছিলাম। ফোন পেয়েই তিনি বললেন, ‘আপনাকে আসতে হবে না কষ্ট করে। আপনি এক কাজ করেন, আমার হয়ে স্বাক্ষর দিয়ে দেন। আমি অস্বীকার করব না।’
অনেকেই বলতেন, শামসুর রাহমানের সঙ্গে আল মাহমুদের একটা রেষারেষি ছিল। এটা আমার সত্য মনে হয় না। আমি কখনো মাহমুদের বিরুদ্ধে রাহমানকে কিছু বলতে শুনিনি। দুজনই পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতেন। আসলে কারও বিরুদ্ধেই পেছনে কিছু বলার অভ্যাস ছিল না শামসুর রাহমানের।
সৈয়দ শামসুল হক তাঁর একটি লেখায় ‘যে পর্যন্ত এই যুদ্ধাপরাধীরা নিশ্চিহ্ন না হয়, সে পর্যন্ত ঘরে ফিরব না’ বলেছিলেন যে উদাত্ত ও উচ্চ কণ্ঠে, সেই কণ্ঠ সোচ্চার ও বলিষ্ঠ—কবিতায় শামসুর রাহমান বলিষ্ঠ হলেও তাঁর কণ্ঠ অতটা উচ্চকিত ছিল না। তবে নিজের জায়গা, নিজের অবস্থান, আদর্শ থেকে কেউ তাঁকে একচুল নাড়াতে পারেনি। আমার ভুল হয়ে না থাকলে, তাঁর একটা দুর্বলতা ছিল ছাত্র ইউনিয়নের ব্যাপারে। কম্যুনিজম বা ন্যাপের ব্যাপারে কতটা ছিল, সেটা জানা নেই, কিন্তু ইউনিয়নের অনেকে তো সংস্কৃতির দিক থেকে বেশ এগিয়ে ছিলেন, ফলে এঁদের প্রতি স্পষ্টত দুর্বলতা ছিল তাঁর। উল্টোটা ছিলেন আবার আল মাহমুদ। তিনি তখন সব সময় ছাত্রলীগের পক্ষে।
২০০৬ সালে শামসুর রাহমানের মৃত্যুর ঘণ্টাখানেক আগে কোনো এক বেসরকারি টেলিভিশনে আমার একটা অনুষ্ঠানের শুটিং ছিল। এ জন্য ছড়াকার ওবায়দুল গণি চন্দন—আহা, তিনিও আজ বেঁচে নেই—ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলেন আমার বাসায়। আমি শুটিংয়ের জন্য বসেছি, এমন সময় চন্দনের কাছে একটি ফোন এল। ফোনালাপ শেষে তিনি বললেন, ‘আসাদ ভাই, আজ শুটিংটা না করি, অন্য এক দিন করব। একটু বেরোচ্ছি।’ কতক্ষণ পর চন্দনই ফোনে আমাকে জানালেন, শামসুর রাহমান মারা গেছেন। বললেন, লাইভে এসে কবিকে নিয়ে আমাকে কিছু বলতে হবে। তাঁকে বলেছিলাম, যাব। কবিকে শেষ শ্রদ্ধাটুকু জানাব।
আদতে শামসুর রাহমানের মৃত্যুর সংবাদে আমি থ মেরে গিয়েছিলাম। এমনিতেই মৃত্যু আমাকে বড় বেশি বিচলিত করে। এ প্রসঙ্গে রাহমানের সঙ্গে করা একটি অনুষ্ঠানের কথা বলি। অনুষ্ঠানটি ছিল আবুল হাসানকে নিয়ে, ১৯৭৫ সালে হাসান মারা যাওয়ার দিনই। রাহমান আমাকে বললেন, ‘আসাদ, আপনি কবিতা ভালো পড়েন, আবুল হাসানের “কুরুক্ষেত্রে আলাপ”টা আপনি পড়েন।’ আমি বলেছিলাম, অন্য একটা পড়ি বরং। তিনি সম্ভবত তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই এটা পড়তে বলেছিলেন। পরে এসব ভেবে এটাই পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। মনে আছে, আমরা কথা বলছিলাম। কথা বলতে বলতেই অকস্মাৎ আমার চোখে ভেসে উঠল হাসানের শেষযাত্রার ছবি। নাকে তুলা গোঁজা। কেন জানি না হঠাৎই ভাবনা এল, হাসানের নাকে তুলা গোঁজা, সে কি শ্বাস নিতে পারছে? হায়! সেই মুহূর্তে ভিজে উঠেছিল আমার চোখ। দরদর করে পানি ঝরতে লাগল। আমি আর কথা বলতে পারলাম না। পরে অনুষ্ঠান শেষে রাহমান আমাকে বললেন, ‘আসাদ, আপনি এতটা ইমোশনাল! আমি ভাবিনি তো!’
শামসুর রাহমান বাংলাদেশের প্রধান কবি কি না, সে তর্কে যাব না, কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, তাঁর কাছে আমার ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। শুধু আমারই নয়, বাংলাদেশের কবিতার ঋণের পরিমাণ যাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি, তাঁর নাম শামসুর রাহমান। এটা ঠিক অঙ্ক করে বোঝানো যাবে না। তিনি আমাদের গুরু ছিলেন। সবচেয়ে বড় বিষয়, তিনি আমাদের পদ্য এবং কবিতার পার্থক্য কী—এটা শিখিয়েছিলেন। প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে; বিধ্বস্ত নীলিমা; রৌদ্র করোটিতে; বন্দী শিবির থেকে—তাঁর বইগুলোই এর প্রমাণ।
জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে তিনি আমাদের পরিচয় ঘটিয়েছিলেন। মনে আছে, টানা পড়ছেন তিনি জীবনানন্দকে। পড়ছেন আর আমাদের বলছেন। আমাদের সৌভাগ্য যে জীবনানন্দকে আমরা পড়েছিলাম আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ—এঁদের পড়ার পর। ফলে আমাদের একটা ধারাবাহিকতা ছিল, প্রস্তুতি ছিল। আমরা তৈরি হতে পেরেছিলাম। কিন্তু শামসুর রাহমান তো আর শামসুর রাহমানকে পাঠ করার পর জীবনানন্দকে পড়তে বসেননি। আল মাহমুদও জীবনানন্দের কথা বলতেন। শামসুর রাহমান প্রথম যখন জীবনানন্দ পাঠ করেন, বলেছিলেন নাওয়াখাওয়া ঘুমের মধ্যেও জীবনানন্দ দাশ তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন।
বাংলা একাডেমিতে যোগদানের পর রফিক আজাদই আমাকে অনেকটা আগলে রেখেছিলেন। একটা লেখা জোর করে লিখিয়ে কোথাও ছাপানো—এগুলো তিনিই করেছেন। এই লেখালেখির সুবাদেই কোথায়, তখন ঠিক রাহমানের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল, মনে নেই। তবে তাঁকে দেখে খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। দারুণ হ্যান্ডসাম, কথা কম বলেন, নীতিকথা বলেন। আমার খুব ভালো লাগল তাঁকে। এরপর তো তাঁর সঙ্গে টেলিভিশনে অনেক অনুষ্ঠান করেছি।
তিনি যখন দৈনিক বাংলার সম্পাদক। ছবি: নাসির আলী মামুন।
একসঙ্গে অনেকবার কবিতাও পড়েছি। যখন ‘পদাবলী’ করতাম, দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা শোনার একটা রেওয়াজ গড়ে উঠেছিল। সে সময় বিভিন্ন জায়গায় নানা রকম অনুষ্ঠান করত পদাবলী। সব মিলিয়ে কবিতার একটা জোয়ার তৈরি হয়েছিল যেন। আমরা সেজেগুজে, সুন্দর পাঞ্জাবি পরে কবিতা পড়তাম। কবিতা পড়ার আগে রিহার্সাল করতাম। তখন এই পদাবলীর প্রাণ ছিলেন শামসুর রাহমান। নিয়মিত তিনি রিহার্সালে থাকতেন। পাঞ্জাবি পরে আসতে বলতাম, তিনি আসতেন। একবার বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোনো এক অনুষ্ঠানে কেন যেন তিনি একটা ফেল্ট হ্যাট আর নীল রঙের ব্লেজার পরে এসেছিলেন। ভীষণ সুন্দর লাগছিল তাঁকে। আমি বললাম, ‘শামসুর রাহমান, আপনাকে রাজপুত্রের মতো লাগছে। তিনি বললেন, ‘আসাদ, উই আর বেসিক্যালি এন্টারটেইনার।’ খুব অবাক হয়ে তাঁর কথার পিঠে বলে উঠেছিলাম, ‘এন্টারটেইনার!’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। ইংল্যান্ডে কবিদের তালিকা থাকে এন্টারটেইনারদের সঙ্গে।’ এটা ওঁর কাছে খুব লেগেছিল, সেই ক্ষোভ ঝাড়লেন আমার ওপর। আফসোসেরও একটা ভঙ্গি ছিল তাঁর। কণ্ঠে সামান্য হতাশা। যদিও হতাশা খুব বেশি ছিল না তাঁর। আমিই বরং তাঁকে একবার হতাশ করেছিলাম। তখন জাতীয় কবিতা পরিষদ ছেড়ে দিতে চাইছিলেন কবি। আমাকে বলেছিলেন, আমি যদি জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিই, তাহলে তিনি থাকবেন। আমি না করেছিলাম। আদতে আমার তখন অনেক ব্যস্ততা, চাকরি করি। রাহমান ব্যথিত হয়েছিলেন।
অবশ্য আমি তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে কখনো কার্পণ্য করিনি। বিভিন্ন সংগঠন থেকে তাঁর কাছে লোক আসত, উঁচু গলায় কথা বলত। আমি তাদের ধমকাতে যেতাম। প্রতিবাদ করতাম। একবার তো কলার চেপে একজনকে বলেছিলাম, ‘কবিতা লিখেছেন কয়টা? লেখালেখি তো করেন না, সংগঠন করছেন দেখে কবির পাশে বসতে পেরেছেন। কে চিনত আপনাকে?’
প্রথম যখন ঢাকায় আসি, থাকার জায়গা ছিল না। প্রথম মাস দেড়েক সদরঘাটে নৌকায় কাটিয়েছি। বড় নৌকা। সে সময় সদরঘাটে কোনো মোটরগাড়ি গেলে আমরা পেছন পেছন দৌড়াতাম, পেট্রলের ঘ্রাণ নেব বলে। যতক্ষণ ঘ্রাণ পাওয়া যেত, ছুটতাম। ভাবি, কোথায় গেল সেই সব সোনালি সময়! ঢাকা আজ কত বড় হয়ে গেছে! পাল্টে গেছে সব। এ শহরের মানুষও বদলে গেছে এখন।
একদা এ শহর ছিল একটা বিভাগীয় রাজধানী। ১৯৪৭–এর পর বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিল ঢাকা, আর ঢাকাকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের মানুষগুলো যেভাবে আস্তে আস্তে নিজেকে চিনতে চিনতে বাড়তে বাড়তে নিজেরা বিকশিত হচ্ছিল; জাতিসত্তার বিকাশ ঘটছিল; রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি হচ্ছিল; অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মানবিক মূল্যবোধ বাড়ছিল; অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখেছিল—এর প্রতিটি স্তরেই শামসুর রাহমান নিজেকে দেখেছেন, রেখেছেনও। রাহমানের স্বপ্ন ও স্মৃতির শহর ঢাকা। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নানা প্রেক্ষাপটে এ শহর বিকশিত হওয়ার প্রতিটি স্তরে কবি তাঁর স্পর্শ রেখে গেছেন।
আরেকটি ঘটনা বলে লেখাটির শেষ টানি। আমার মেয়ের বিয়ের দিন সম্ভবত একটা অনুষ্ঠান ছিল—একজনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎকার। গিয়ে দেখি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বসে আছেন। প্রসঙ্গক্রমে ওই অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম, ‘জেমস জয়েসের যেমন ডাবলিন, শক্তি-সুনীলের কলকাতা, তেমনই শামসুর রাহমানের ঢাকা।’ আমার কথায় রাহমান হেসে উঠেছিলেন হো হো করে। ফিরে আসার সময় বলেছিলাম, ‘আজ আমার মেয়েটার বিয়ে। দোয়া করবেন। আপনাকে নিমন্ত্রণ করতাম। কিন্তু ইচ্ছে করেই করিনি। আপনার তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা নষ্ট হবে। এই সময়টুকুও মূল্যবান। আপনি লিখবেন, কিংবা বিশ্রাম নেবেন, চিন্তা করবেন। আপনি গেলে আমার মর্যাদা বাড়ত, কিন্তু তার চেয়ে বেশি জরুরি আপনার সময়টা বাঁচানো, লেখা।’ শামসুর রাহমান আমার পিঠে হাত রাখলেন। ভালোবাসার হাত। মাতোয়ালা দৃষ্টি তাঁর চোখে। তাঁর চোখ এমন দৃষ্টি নিয়েই দেখেছিল ঢাকার এক ‘মাতোয়ালা রাইত’কে। আমি জানি, ঢাকার এই মাতোয়ালা রাইতই শুধু শামসুর রাহমানের নয়, মাতোয়ালা দিনও তাঁর।
বুক তাঁর বাংলাদেশের হৃদয়
জন্মপুরান ঢাকার মাহুতটুলি এলাকার ৪৬ নম্বর বাড়িতে ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর সকাল ১০টায় জন্ম। মা আমেনা বেগম, বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী। ১৩ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ।
পড়াশোনা
১৯৪৫ সালে পোগোজ স্কুল থেকে মাধ্যমিক। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ১৯৪৭-এ। ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি। তবে টানা তিন বছর পড়াশোনা করেও ফাইনাল পরীক্ষা দেননি। ১৯৫৩-তে পাস কোর্সে বিএ পাস করেন। ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হলেও শেষ পর্বের পরীক্ষা দেননি।
যৌবনে স্ত্রীর সঙ্গে কবি
পরিবার
১৯৫৫-এর ৮ জুলাই জোহরা বেগমের সঙ্গে বিয়ে। এ দম্পতির ছেলেমেয়ে সুমায়রা আমিন, ফাওজিয়া সাবেরিন, শেবা রাহমান, ওয়াহিদুর রাহমান মতিন ও ফাইয়াজ রাহমান।
সাংবাদিকতা
১৯৫৭-এ ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ-এ সহসম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকজীবন শুরু। ১৯৬৪-তে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তান-এ (পরে দৈনিক বাংলা)। ১৯৭৭-এ যুগপৎ দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক পদে নিয়োগ লাভ। ১৯৮৭ সালে সামরিক সরকারের শাসনামলে এ দুই পত্রিকার সম্পাদকের পদ ছেড়ে দেন।
কবিতাময় জীবন
১৯ বছর বয়সে ১৯৪৮ সালে কাব্যচর্চার শুরু। নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় ‘উনিশশ ঊনপঞ্চাশ’ শিরোনামে প্রথম কবিতা প্রকাশ। ১৯৬০-এ বেরোয় প্রথম কবিতার বই প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে।
মুক্তিযুদ্ধকালে আত্মগোপনরত অবস্থায় লিখেছেন একের পর এক কবিতা, কলকাতা থেকে ১৯৭২-এ যা প্রকাশিত হয়েছে বন্দী শিবির থেকে শিরোনামে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর প্রতিবাদ করেছেন গ্রিক পুরাণের রূপকে ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থে। আবার নিজের কাব্যভঙ্গির বাঁক পাল্টে আগাগোড়া সনেটনির্ভর বই মাতাল ঋত্বিকও রচনা করেছেন। স্বৈরাচার-নিষ্পেষিত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লিখেছেন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ বা ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’-এর মতো কবিতা। স্বৈরশাসকের ঘাতক বাহিনীর হাতের নিহত নূর হোসেনকে অমর করে রেখেছেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ পঙ্ক্তির মাধ্যমে। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।
ছদ্মনাম
একাধিক ছদ্মনাম ছিল তাঁর। বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লেখার জন্য সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক—এই নামগুলো ব্যবহার করতেন। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে মজলুম আদিব ছদ্মনামে ছাপা হয়েছে তাঁর কবিতা। কবিতার পাশাপাশি গদ্যেও ছিলেন সাবলীল। লিখেছেন গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ–আত্মজীবনী এবং শিশুতোষ রচনা। করেছেন অনুবাদও।
মৃত্যু
২০০৬-এর ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায় ৬টা ৩১ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সূত্র : প্রথম আলো।